সবুজ বাতি।। আসমা আক্তার

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

অনুভবেই প্রেম হয়েছিল তাদের। মধু আর মানবী। দেখা বলতে কয়েকটা ছবি আদান প্রদান আর ২/৪ বার ভিডিও কল। মানবী অনার্স পড়ুয়া মেয়ে। অনলাইনে পোশাক কসমেটিক বিক্রি করে, একটা গ্রুপের সদস্য হয়ে। মধু বিদেশে থাকে। ফেসবুক বন্ধু। পোষ্টে লাইক কমেন্ট ছাড়া কোন কাজ ছিলনা মধুর। কিন্তুু ভালোলাগার পারদ চড়ছিল দিন কে দিন। একদিন দ্বিধা নিয়েই ইনবক্সে সালাম দিল। মানবী কাজের চিন্তায় ব্যস্ত। তবুও ২ দিন পরে সালামের জবাব  পেল মধু।
সেই থেকে সপ্তায় ২/১ দিন কুশল বিনিময়। আস্তে ধীরে কুশল বিনিময়টা বাড়লো। এরপরে আলাপ-পরিচয়।দিনে দিনে কুশলের সাথে যোগ হলো ভালোলাগার আলোচনা। ৬ মাসের মাঝেই দুজন জেনে গেল পারস্পরিক ভালো লাগা মন্দ লাগা। মধু কথাবার্তায় শালীন একটা ছেলে। খুব ভালো লাগলো মানবীর
কেমন একটা নির্ভরতা তৈরি হলো দুজনের আনন্দের নির্ভরতা। যত কাজই থাক মধুর অবসরের সময়টা ফ্রি থাকতে চেষ্টা করে মানবী। তার মেসেনজারের সবুজবাতি টা আনন্দের উৎস। ভাবের বিস্তার এখন রাতকেও দখল করে নিয়েছে। সম্বোধনেও বদল আসলো। তুমি দখল করলো আপনির জায়গা। আধো রাত কেটে যেত গল্পে।

-মানবী, একটা কথা বলি?
-বলো।
-তোমার কোন ভালোবাসার মানুষ নেই বলেছো বিয়েও ঠিক নেই। আমাকে যদি পছন্দ করো তবে দেশে ফিরে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব করতে চাই তোমার মা-বাবার কাছে। এখনি বলতে হবে না। পরে জানিও।
-ঠিকমতো জানলেই না বিয়ে? মানুষ তো আগে ভালোবাসতে চায়।
-যতোটা ভালোবাসলে তার সাথে সারাজীবন কাটানোর লোভ জন্মে, তার জন্য সমগ্র সত্তা আকুল হয় ততোটা ভালোবাসি তোমাকে।
-আমি যদি না বলি?
-তোমার ইচ্ছা বলতেই পারো, তবে আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। আমি অন্যকারো হবোনা কখনো। আমার এই বুকে মাথা রেখে অন্যকেউ ঘুমাবে সেইটা আর হবেনা। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
-আমি কিছুই জানিনা, তুমি এসে যা ইচ্ছা করো।
-বুঝতে পেরেছি, আমার লজ্জাবতীর গাল লাল হয়ে গেছে প্রেমে আর অনুরাগে। মাকে তোমার ছবি পাঠাবো?
-তোমার ইচ্ছা।
-তুমিও বাড়িতে বলো।
-আমি পারবো না।তুমি বলবে এসে।

এরপরের দিনগুলো স্বপ্নের দিন। প্রজাপতির সাতটি রঙে ছেয়ে গেল দু’জনের চারপাশ। একবেলা খোঁজ না পেলে অস্হির হয় দু’জন। মনে স্বপ্ন সাজালো ঘর বাঁধার স্বপ্ন। বিয়েতে কেমন শাড়ি গয়না পরা হবে সব ঠিক করলো দুজন। বিয়ের পরে কোথায় বেড়াতে যাবে সে প্লানও হলো। মধু দূর থেকেও মানবীর সব খোঁজ রাখতো। গোসল,খাওয়া, ঘুমে কোন অনিয়ম হলে রাগ করতো। আর ১৫ দিন পরেই দেশে ফিরবে মধু। 

-মানবী, জানো ইচ্ছে করে দৌড়ে তোমার কাছে চলে যেতে। এতদিন এমন হতো না এখন একটা দিন ও কাটতে চায় না।
-আমারো দিন কাটেনা, কবে তুমি আসবে তোমায় দেখবো সারাদিনই এ ভাবনায় কাটে। আর রাততো তোমার দখলে। 
-তোমার জন্য কী কী আনবো?
-তুমি আমার সামনে আসলেই আমি খুশি আর কিছুই লাগবে না। তুমি যখন অনলাইনে থাকো তোমার নামের পাশে জ্বলা ওই সবুজবাতিটা আমাকে আশ্বস্ত করে শান্তি দেয়। ওই সবুজ বাতিটা তোমার প্রতিনিধি। সুখ আর ভালোলাগার উৎস।
-তাহলে তো বিয়েতে তোমার জন্য লালের পাশাপাশি সবুজ বেনারসিও কিনতে হবে কি বলো?
-দুর তুমি যে কেমন খালি লজ্জা দাও।
-শাড়ি গয়না দুজন একসাথেই কিনবো তোমার পছন্দে।আমার পছন্দে আনবো একজোড়া নুপুর। শাড়ি পরে, চোখে কাজল, খোলা চুলে পায়ে নুপুর পরে তুমি আমার সামনে ঘুরে বেড়াবে। আমি প্রতি মুহুর্তে তোমার প্রেমে পড়বো।
-আমি তো শাড়িই পরতে পারিনা, তবে শিখে নেবো।
-না পারলে আমি পরিয়ে দেবো।
-কী বললে? কতজনকে শাড়ি পরিয়েছো?
-আরে এতদিন তো বউ ছিলনা,বউ হলে পরাতে পারবো।
আনন্দে আর খুনসুটিতে দিন যায় ওদের। আর ৭ দিন পরে আসবে মধু। হঠাৎ একদিন লাইনে এলো না মধু, ২/৩/৪ এভাবে ৯ ঘন্টা চলে যায়। মানবীর লেখার কোন উত্তর আসেনা। খুব অভিমান হয় তার। যাহ,আমিও আর লিখবো না। তবু্ও না লিখে পারেনা। ঘন্টায় ঘন্টায় মেসেজ পাঠায় সে। দিন চলে যেয়ে রাত আসে। কিন্তুু সে আজ আসেনা সবুজবাতি টা আর জ্বলেনা।
বাতাসে বিষ লাগে মানবীর, আকাশ যেন বিরক্তিকর। খাবার গলার নিচে নামেনা। শান্ত স্বভাবের মেয়েটি দু’দিনেই রুক্ষ হয়ে উঠলো। মা,বোনের সাথে ঝাড়ি দেয়। কাস্টমারদের সাথে আচরণও ঠিক নেই। বসের ঝাড়ি খায়। হোয়াটস এ্যাপ থেকে নম্বর নিয়ে কল দিতে চেষ্টা করে মধুকে। বৃথা চেষ্টা।
সে কি আমাকে মিথ্যা বলেছে ভুলে গেল আমাকে? আপন মনে ভাবে মানবী। রাগ করে নিজের আইডি ডিএ্যাকটিভ করলো। তবুও মনের ব্যাথা কমেনা। ভালোবাসা এক অদৃশ্য জাল, একবার জড়িয়ে গেলে আর ছাড়ানো যায় না। কাজকর্ম শিকেয় উঠলো। খাবারে অনিয়ম, ঘুম হয়না, চোখের নিচে কালি পড়লো। ছোট বোনটা সব জানে। ওকে জড়িয়ে কাঁদে মানবী। এ এক অবর্ণনীয় অনুভূতি, প্রিয়জনের বিরহ যেন অগ্নিগিরির ফুটন্ত লাভার দহন। জ্বলে পুড়ে মনে মনে নিঃশেষ হতে লাগলো সে।

এক সপ্তাহ গেল এখন ও মধুর আইডি অফ। সেই আশা জাগানিয়া সবুজ বাতিটা আর জ্বলেনা। সে আমাকে ভুলে গেলে আমি কেন পারবো না? একটু কাজে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে মানবী। তবে মন কিছুতেই মানে না। তাহলে কী সে আমার সামনে এসে আমাকে চমকে দেবে? ভাবতে থাকে সে। দিন কষ্টের হোক আর সুখেরই হোক থেমে থাকেনা। এক মাস পার হলো। মনটা বিদ্রোহ করে উঠলো মানবীর। 
-সে এভাবে আমাকে ভুলে যেতে পারেনা। আমি তার বাড়িতে যেয়ে খোঁজ নেবো। ভালো না বাসুক তার সামনে অন্তত একবার দাঁড়াতেই হবে। ছোটবোনের মাধ্যমে বাবা মায়ের সব জানা হলো। বাবা বললেন,  
-আচ্ছা মা আমি নিজে গিয়ে খোঁজ নেবো তবে একটা শর্তে সে যদি ইচ্ছে করে তোমার থেকে দূরে থাকতে চায় তবে আর কোন পাগলামি করবে না। আর ৩ দিন পরে শুক্রবারেই আমি যাবো।
-বাবা আমি তাকে খুব ভালোবাসি, সে এমন করতে পারে, মন বলে না। কোন সমস্যও হতে পারে।
-ঠিকআছে আমি দেখছি। আর মন খারাপ নয়।
শুক্রবারের আগেই খবরটা এলো। একটা ছেলে মানবীর খোঁজ করে দেখা করতে চাইলো। মধু পাঠিয়েছে তাকে।
-এই প্যাকেটটা নিন। আর এই রেকডিং টা শুনবেন।মোবাইলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ন কিছু একটা চাপ দিতেই মধুর গলা ভেসে এলো।
-মানবী, ওরা বলছে আমার কিছুই হয়নি, তবে আমি জানি আমার সময় নেই। খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সাথে বাঁচার। সবুজ বেনারসিতে তোমায় দেখা আর হলো না।আমার অপেক্ষায় থেকো না তুমি। নিজের জীবনটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিও।

এরপরে পাষাণভারের মতো নীরবতা। ডুকরে কাঁদলো না মানবী। প্যাকেটটা খুললো, একজোড়া নুপুর, আর একই রকম দেখতে ২ টা লাভ ব্যান্ডস। নুপুরগুলো পায়ে পরতে পরতে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো।
-কিভাবে হলো?
-এক্সিডেন্ট, কোথাও কাটেনি, ছেড়েনি। ফোনটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। আর ভিতরে ভিতরে ভেঙেছিল বুকের পাজর।

মধুর কথা রেখেছিল মানবী। সত্যই জীবনকে সাজিয়েছিল নতুনভাবে। কয়েক বছর পার হয়েছে। মানবী ঘরবন্দি। চুলে জট, পোশাক ছেড়া, ময়লা, জোর করে খাওয়ালে ২/১ দিন পরে খায়। কারো সাথে কথা বলেনা। পায়ে সেই নুপুরগুলো, সাথে শিকল। হাতে নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইল। বিড়বিড় করে শুধু বলে, 
-সবুজবাতি জ্বলবে, একদিন ঠিক সবুজবাতি জ্বলবেই। আমার মধু ঠিক আসবেই আমার কাছে।

মন্তব্য: