পরিতোষ হালদার: ধ্যানমগ্ন ঐশ্বর্যের রোমান্টিক কবি ।। শিকদার ওয়ালিউজ্জামান

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

হাজার বছর অতিক্রম করে বাংলা কবিতা পা রেখেছে নতুন শতাব্দির আঙিনায়। চর্যাপদের মাধ্যমে বাংলা কবিতা সূচনার পর থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিবর্তন ও বাঁক সৃষ্টির মাধ্যমে আজকের ঋদ্ধতর বাংলা কবিতা। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা কবিতায় বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের আবির্ভাব ঘটেছে আবার অনেক ভেঙেছে, বিলুপ্ত হয়েছে। সময়ের বাহন এমনই, কাউকে সারথি করে, কাউকে ফেলে দেয় কালের অতল গহ্বরে। বহু চিন্তক এসেছেন। বহু চিন্তক-মুকুল খসে পড়েছে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই। যাযাবর দিনলিপিতে বাংলা কবিতা ধ্বনি, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক প্রভৃতি অলঙ্কারে বিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্প কবিতা আজও বহমান তার নিজস্ব ধারায়।

কাব্যঘোর তৈরি করতে পারার সামর্থই কবিতা। এই ঘোরে আচ্ছন্ন থেকে পাঠক কবিতার রস আস্বাদন করেন। কবিতায় নিহিত রহস্যও উদঘাটন করতে সক্ষম হন। কবিতা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা কবিতায় গল্প বলার ধারাটি সূচিত হয়েছিল তা এখন বিবর্তিত হতে হতে বোধের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। বোধের অবক্ষয় হলে আধুনিক কবিতার গূঢ়ার্থও উদ্ধার করা অসম্ভব। তাইতো আধুনিক কবিতা দুর্বোদ্ধতার দায়ে দুষ্ট হলেও এই সীমাবদ্ধতায় পাঠকের দায়ই বেশি। রহস্যের প্রয়োজনীয় অন্ধকার না থাকলে কবিতা তার সৌকর্য হারায়। আর এটাই আধুনিক কবিতার মূলমন্ত্র। নব্বই কালপর্বের কবি পরিতোষ হালদার এর ‘নৈঃশব্দ্যের জলতৃষ্ণা পাণ্ডুলিপি’র প্রতিটি কবিতা পাঠককে ঘোরে আচ্ছন্ন করে তোলে। রহস্যের আলো-অন্ধকারে কবিতা হয়ে উঠেছে কলাসৌকর্যময়। রহস্যের আবহে মধুর হয়ে উঠেছে :
‘আমারও সুপ্রীতি আছে, আছে মানগন্ধী সুখ। তিন নদী খুলে রাখি- তুমি কোন অলকানন্দা জল, কতটুকু ভাসাতে পার আমার উপল। দীর্ঘ রাত্রি শেষে খুলে যায় জলের বুনন। টেরাকোটা মুগ্ধতায় আমিও চন্দ্রচাঁদ প্রাচীন তুষার। কে তুমি সুদূরগামী।’
(স্বজন)

পরিতোষ হালদার রোমান্টিক কবি। তার কবিতায় রয়েছে রোমান্টিক আমেজ। আধুনিকতার মৌলিকতা তার কবিতাকে স্পর্শ করেছে। কবিতা হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র ও বিস্ময়কর। কবিতার কাঠামোতে তার আত্মনির্মানে আপন ঐশ্বর্যের মহিমা উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। রোমান্টিক চেতনায় জীবনানন্দের সুর বাঁজে তার কবিতায়। কবিতার নান্দনিকতা দার্শনিক চেতনায় আলোড়িত হয়েছে। ফুটে উঠছে ব্যক্তিক যন্ত্রনা। প্রকাশিত হয়েছে হারানো স্মৃতির উপলব্ধিতে স্বতন্ত্র নন্দন। প্রেম-বিরহ, নিঃসঙ্গতা ও নৈরাশ্যবাদী চেতনা ফুটে ওঠে তার কবিতায়। মৌলিকভাবে জীবনানন্দসহ অন্য কবিদের চেয়ে কোন অংশেই পরিতোষ হালদার কম দূরুহ নয়। বরং বলা যায় দুর্বোধ্য। তবে যতই দূরুহ হোক না কেন পরিতোষ হালদারের কবিতা নিঃশব্দ কাব্য সাধনা ফলস্বরূপ। আত্মমগ্ন দহনে প্রকাশ করেন দ্রোহ ও প্রেমচেতনা-
‘দূরে যাব। বিষণ্ণ রাতের মত দূর। গোল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিজেকে ডাক দেব ফের। অজুদ অতল খুঁজে নেব মেঘনাচের অতৈপুরাণ। রাংতা পাতার বনে কুসুমের মৃত হাহাকার- চন্দ্রধ্বনি নিশা। অগ্নিপারা ছুঁয়ে যাবে যৈবতির প্রথম সন্ন্যাস।’
(অথৈ পুরাণ)

পরিতোষ হালদার নিসর্গ-সৌন্দর্য ও অপরূপ উপলব্ধির মাধ্যমে কবিতায় নান্দনিক অবয়ব গড়ে তোলেন। কবিতার নন্দনতত্ত্বে প্রেম ও প্রকৃতি ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছেন-
‘আমি পাথরে-পাহাড়ে-গুহায়-হাড়ে লিখে নেব তোমার কাওয়ালি- ষোল কলায় গাঁথা পূর্ণবতী বাণী। তুমি আকাশে আকাশ হয়ে ডেকে যেও আমার বিস্ময়। জেনে রেখ আমি আর তুমি ছাড়া নিসর্গের সকলই পুরাণ।’
(আলোকলতা)

মিথ, লোক ঐতিহ্য, পুরাণ ও আধুনিক শিল্পজ্ঞান পরিতোষ হালদারের কবিতাকে করে তুলেছে ঐশ্বর্যময়। শব্দের নিপুণ ব্যবহার কবিতার শরীরে বিছিয়ে দিয়েছে বর্ণিল চাদর। অস্তিত্ব সচেতন ও দ্বন্দ্বজর্জর কবিপ্রতিভা মিথ-ঐতিহ্যকে সমকালীন জীবন-পরিপ্রেক্ষিতে রূপায়িত করেন। সমকালীন জীবন সামূহিক চৈতন্যের আধার। মিথ এই সামূহিক চৈতন্যেরই অংশ। মিথের প্রয়োগে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে কবিতা। কবি পরিতোষ হালদার তার কবিতায় ভারতীয় পুরাণের পরিচর্যা করেছেন। নিজেস্ব আবেগ-অনুভূতি-কল্পনার রথে চড়ে কবি এক শৈল্পিক সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। তার কবিতায় রয়েছে রহস্যের ধূসর জগৎ, যেখানে পাঠক প্রবেশ করে নিজস্ব বোধ ও মননের মাধ্যমে। তার কবিতায় ঐতিহ্য, ইতিহাস চেতনা এবং পুরাণ প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

ভারতীয় পুরাণে অর্জুন স্বর্গবাসকালে উর্বশীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় তার অভিশাপে তিনি এক বছর নপুংশক অবস্থায় অতিবাহিত করেন। মৎস্যরাজ ভবনে অর্জুন বৃহন্নলা নামধারী নপুংশক বেশে বিরাটকন্যা উত্তরার নৃত্য-গীত শিক্ষকরূপে এক বছর অবস্থান করেন। বিরাটরাজ উত্তরার সংগে অর্জুনের বিবাহ দিতে ইচ্ছুক হন। কিন্তু অর্জুন তার নপুংশক অক্ষমতায় উত্তরাকে বিবাহ করতে অসম্মত হন। অভিমন্যুর সংগে উত্তরার বিবাহ হয়। পরিতোষ হালদার অর্জুনের এই বিষাদ স্মরণে রেখে কাব্য-পংক্তিতে শিল্পসম্মতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন ‘চুমুক’ কবিতায় :
‘গাঙের পরাণ ছোঁয় জলধোঁয়া কুসুমের নিশা। মাছ ললনার চোখে আজন্মের অর্জুন বিষাদ’

একই কবিতায় ‘গান্ধারী’ শব্দটি ভারতীয় পুরাণের অংশ হিসাবে দৃশ্যায়িত। গান্ধার দেশের রাজা সুবলের কন্যা গান্ধারী। গান্ধাররাজ তার সুন্দরী ও শিক্ষিতা কন্যাকে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে বিবাহ দেন। মাতা-পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপত্তি না করে জন্মান্ধ স্বামীর হাতে নিজেকে সমর্পন করলেন গান্ধারী। স্বামীকে অতিক্রম করবেন না এই প্রতিজ্ঞা করে গান্ধারী বস্ত্রখণ্ড দ্বারা সর্বদা নিজের চোখ বেঁধে রাখতেন। উপরোক্ত পুরাণটি চুমুক কবিতাপাঠে একটি অনন্য চিত্রকল্প এঁকে দেয় পাঠকচিত্তে :
‘যে যাবে যায় না কেনো! মাঝখানে চোখবাঁধা গান্ধারী বিলাস।’

উড়াল কবিতায় ধ্যানগ্রস্থ বাল্মীকির মূর্তি চিত্রায়িত হয়েছে। যৌবনকালে বাল্মীকি রত্নাকর নামে এক দুর্দান্ত দস্যু ছিলেন। নারদের জিজ্ঞাসাবাদে রত্নাকারের চৈতন্যের উদয় হলে তিনি ষাট হাজার বছর তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেন। একদিন বাল্মীকি ভরদ্বাজসহ তমসার তীরে ভ্রমনরত অবস্থায় অকস্মাৎ দেখেন যে, বনমধ্যে কামক্রীড়ারত এক ক্রৌঞ্চ মিথুনের সময় ক্রৌঞ্চ জনৈক ব্যাধ শরাঘাতে বধ করলে ক্রৌঞ্চি করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে শোকাভিত বাল্মীকির মুখ থেকে আদি শ্লোক নির্গত হয়। প্রেম-বিরহের এই রূপকল্পটি পরিতোষ চিত্রায়িত করেছেন তার কবিতায় :
‘মৃত্যুও অমরত্ব পাবে এইসব খেয়ালী বেলায়, জ্যোৎস্নার তামাম বুকে মৃত অন্ধকার। বাল্মীকির ধ্যানে শরবিদ্ধ অন্য পাখি। ফুরাতে ফুরাতে দীর্ঘ হয় সময়ের আয়ু- শূন্যতার লবঙ্গ উড়াল।’

প্রেম-বিরহযাপন যেন পরিতোষ হালদারের কামনার বোধন। জীবনের সাধ মেটাতে তিনি কল্পিত ইন্দ্রপুরীতে বাস করেন। জলরূপী প্রিয়তমাকে খুঁজেছেন কন্যাকুমারী থেকে দ্রাবিড় বঙ্গ পর্যন্ত যা অহংকারী রাজহংসি ডানা নিজের করে নিয়েছে।

যে পথে বেহুলা লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে ইন্দ্রের সভায় গমন করেছিল সেই বলেশ্বর নদীর কিনারে দাড়িয়ে থেকেছেন। অন্ধকারে অন্ধ পরকীয়ার চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলেছেন পরকীয়া কবিতায়। কবিতাটি হয়ে উঠেছে পুরাণ নির্ভর-
‘বলেশ্বরের কিনার ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, এই পথে বেহুলাও গেছে বুঝি ইন্দ্রের সভায়। অন্ধকারে কেঁপে ওঠে অন্ধ পরকীয়া।’

যোজনগন্ধা কবিতাটি মিথতত্ত্ব বহন করে। মৎসকন্যা সত্যবতীর অপর নাম যোজনগন্ধা। দেহময় মৎস-গন্ধ ছিলো তার। ব্যাসদেব সেই গন্ধকে সুন্দর গন্ধে পরিনত করেছিলেন। কবিতার নামটি পৌরাণিক অর্থ বহন করে। আবার শিবপত্নী কামাক্ষ্যা দেবী দক্ষযজ্ঞে দেহত্যাগে বিষ্ণু সুদর্শণ চক্র দ্বারা তাঁর মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করেন। সতীর যোনীমণ্ডল কামাক্ষ্যায় নিক্ষিপ্ত হওয়ায় স্থানটি মহাতীর্থস্থানে পরিনত হয়। এই আদিমাতা নারী, তার পায়ের নাচ, চিত্ত হরণকারী কামরূপী মদনকুমার, ষড়ঙ্গ সাধনসহ পুরো কবিতাটি প্রতীকী অর্থ বহন করে। যোজনগন্ধা কবিতাটি মিথ সৌন্দর্যে আজন্ম যোজনগন্ধী হাওয়ায় ভেসে আসবে পাঠক চিত্তে-
‘কামসিন্দুরে লেখা তন্ত্রপুরাণ- মৃতের সজ্জায় ঘুমাও কামাক্ষ্যা সুন্দরী। তুমি কোন আদিমাতা নারী, তোমার পায়ের নাচ নিয়ে গেছে মদনকুমার। তারে দিও ষড়ঙ্গ সাধন। বিনিময়ে রাত্রি পাবে, পাবে জল; ঘুঘু অন্ধকার।’

এছাড়া পরিতোষ হালদারের বিভিন্ন কবিতায় ‘দশম আকাশ’, ‘ত্রিরত্ন রমনী’, ‘আম্রপালি’, ‘অলকা’, ‘উজ্জয়িনী’, ‘গন্ধম’, ‘অমরাবতী’, ‘অলকানন্দা’, ‘গন্ধর্ব’ ‘উর্বর্শী’, ‘কপিলাবস্তু’, ‘লুম্বিনী’ শব্দগুলো পৌরাণিক ঘ্রাণ বহন করে। কবিতাগুলো হয়ে ওঠে রহস্যঘেরা, সৌন্দর্যময় আর নান্দনিক।

নব্বই দশকের কবিতায় নারী প্রসঙ্গ নানা ব্যঞ্জনায় আমাদের মুগ্ধ করে। প্রেম, মিথ, ঐতিহ্য আর জীবনযাত্রার নানান পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে এই দশকের কবিদের কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে। নারী প্রেমের আঁধার, আত্মমুক্তির সাধনার চিত্র, সমন্বয়ের অংশ, কবিতা ও জীবনের প্রেরণাশক্তি। কবি পরিতোষ হালদারের কবিতায় নারী ও প্রকৃতি ক্রিয়াশীল। তীব্র আবেগে লোকজ সৌন্দর্যের রসনা নারী। জলের অপর নাম নারী। তৃষ্ণার জল নারী। এমন জলতৃষ্ণায় কবিহৃদয়ে সারাক্ষণ উপলব্ধি করেন এক অন্তর্দহন। নারী তার কামনার আঁধার, তৃষ্ণার আগুন আবার সে আগুন প্রশমিত করার একমাত্র একমাত্র জল। জলতৃষ্ণা কবিতাটি নারী-পুরুষের বাৎসায়নের ঘোরময় চিত্রকল্প :
‘একপুরুষের হাতে আগুন দেখে একজন নারী এসে বিছিয়ে দেয় জলের শরীর। পুরুষ সেই শরীরে রাত্রি আঁকে, জলকাব্য লেখে আর লেখে বাৎসায়ন কলা। নারী একসময় আগুনে যায়- সে কাঁদে আগুন-আগুন জলে।’

পরিতোষ হালদারের কাছে নারী ও নিসর্গ একই ঐক্যের তান যা রোমান্টিকতার নিপুণ সুষমা। নারীসৌন্দর্য ও নারীরহস্য উন্মোচন করতে তিনি কল্পলোকে বিচরণ করেছেন নির্দ্বিধায়। নারীকে কখনো পরী আবার কখনো দেবীরূপে উপস্থিত করেছেন কবিতায়। নারী তার কবিতায় যতটা না শরীরিনী তার চেয়ে বেশি কল্পলোকবাসিনী। তাইতো নারী পৌরানিক, নারী শ্বাশ্বত। নারীসৌন্দর্যেই তিনি শৈশবকাতর হয়েছেন ‘পাখি, সমুদ্র ও শূন্যতত্ত্ব’ কবিতায় :
‘কী ব্যাকুল ছিলো বেলা- তেতুল গাছের তলে কোন কোন পূর্ণিমায় পরী নামতো, যার শরীরভর্তি এলাচ গন্ধ। এইসব নারীদের দাদা দেখতো, আমি দেখেছি দাদিকে, তেল-নুন, লংকা দিয়ে তেতুল মেখে আমাদের হাতে বিলিয়ে দিতো।’

পরিতোষ হালদারের কবিতায় নারী, প্রেম ও নিসর্গ-ভাবনা জড়িয়ে থাকে পরমাত্ময়রূপে। নদী, সমুদ্র, জল, অন্ধকার, রাত, আম্রপালি, দিঘি, শূন্যতা প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ে নারীকেই রূপায়িত করেছে। আবার নারীকে তিনি আপন মহিমায় সাজিয়ে দেন প্রকৃতি সাজে :
‘চম্পক নগর ভাসে বিজু উৎসবে। তুমি কোন পৌরাণিক নারী। কানে আকাশফুল, চিবুকে ঘুমফসলের মায়া। পায়ে কাচলং জলঘুঙুর। রাজহংসী ছন্দদোলা তোমার শরীর’
(নেমন্ত্রণ)
‘কোনদিন ঘুম ভেঙে জেগে দেখি মাঝরাত শুয়ে আছে আমার শয্যায়, ঠিক যেন বউয়ের শরীর’
(উষ্ণতা)

পরিতোষ হালদার বৃক্ষকে নারীরূপে রূপ দান করেছেন। বৃক্ষের মতো নারীও হাজারো দায়িত্বকাঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘বৃক্ষ’ কবিতায় নারী ও বৃক্ষকে দায়িত্বশীলতার প্রতীক হিসাবে দাঁড় করালেও পরিশেষে একাকীত্বের অনুষঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন তিনি তাদের মধ্যে। আবার বৃক্ষরা অনেক নির্জনতয় পাখিরূপে রাত্রি আনে। সকাল আসে। নির্জনতার মাঝেই পরিতোষ হালদার আশান্বিত হয়ে জলমুগ্ধতায় অপেক্ষায় থাকেন-
‘তোমার প্রাণের রঙ ফুরাতে ফুরাতে মিশে যাবে বৃক্ষের কুসুমে। এইসব বৃক্ষরা আজন্ম নারী। আকাশ মাথায় করে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃসঙ্গ একা, আরো নির্জনে পাখি। শিশিরের জলমুগ্ধতায় এসো আমরাও সারি সারি নির্জন হয়ে যাবো।’
(বৃক্ষ)
‘নৈঃশব্দ্যের জলতৃষ্ণা’ পাণ্ডুলিপির কবিতার সুষমায় কবি প্রয়োগ করেছেন দেশজ রীতি। চিত্রকল্পের সুনিপুণ প্রনয়নের মাধ্যমে প্রতিটি কবিতা সূচনা করেছে নিজস্ব ধারা। তার নন্দনতত্ত্বে মনস্তাত্ত্বিক চেতনাপ্রবাহ লক্ষণীয়। পরিতোষ হালদার বিচিত্র বিস্ময়-অনুভবকেই নানাভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প বিবেচনা করার সময় বিশেষ দৃষ্টিগোচর হয় অন্ধকার, নদী, আকাশ, চাঁদ, নক্ষত্র, রাত, জল, জোছনা, অরণ্য, ফুল, সমুদ্র, পাখি, কুয়াশা, ঘাস, আগুন প্রভৃতি।

পরিতোষ হালদারের কবিতায় প্রকটতা পেয়েছে যতকিছু- জীবন তার কাছে অন্ধকার। মৃত্যু তার আরাধ্য। দুঃখ তার পরম বন্ধু। ধ্বংস আর ক্ষয়ে যাওয়াতেই তার মুক্তি। জীবনের অন্ধকারই যেন তার অস্তিত্বের ঘোষণা। প্রগাঢ় শূন্যতা, নিদারূণ অসহায়ত্ব, নিঃসঙ্গতা, সংশয় এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে, ধ্বংসের কিনারে এনে দাঁড় করায়। চুমুক কবিতায় পরিতোষ হালদার অন্ধকারের চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলেছেন। বিষাদের বনজুড়ে নির্মাণ করেছেন অন্ধকার প্রাসাদ। অন্ধকার তার তৃষ্ণা নিবারণের নিদারুণ পানীয়। তাইতো তিনি অন্ধকারেই ফিরে যেতে চান বারবার :
‘চারিদিকে ভীষণ চুমুক- ভীষণ কাজলরেখা অন্ধকার। প্রার্থিত আলোরা উড়ে গেছে বিহঙ্গের ডানায় ডানায় ….যারে ছুঁয়ে দেই সেই কয় আমিই বিহন। অরণ্য দিয়েছে ডাক, চল অন্ধকারে যাই, অন্ধকার আমার তৃষ্ণার জল।’

‘একাকী খনিজ’ কবিতায় কুয়াশা, সকাল, নদী, পাখি, ফড়িং, চিত্রকল্পগুলো শুধুমাত্র প্রকৃতির শোভা হিসেবেই নয় কুয়াশাকে নৈরাশ্যের চাদরে ঢেকে দিয়েছেন। ছায়ার ডাকে রোদের বেলা পার হলে পুঁজি হিসাবে শুধুই একাকীত্ব পড়ে থাকে। শ্রাবণের তিস্তা-বেগবতী-নিলাক্ষী নদীর চিত্রকল্প আর রূপালি শস্যের টানে পাখিদের এক মনোরম চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলেন পাঠকের মনে।
‘ঘনকুয়াশার বনে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে গেছে আমার সকাল। তিস্তা-বেগবতী-নিলাক্ষী কত শত নদীর নামের তোমারে ডাকতে গিয়ে প্রাণের শ্রাবণে কখন যে হয়ে গেছি জল। রূপালি শস্যের টানে সাঁই সাঁই উড়ে আসে পাখিদের ঝাঁক।
..তোমারে হারাতে গিয়ে অবশেষে জেনে গেছি তুমিও একা আর ভালবাসা একাকী খনিজ।’

পরিতোষ হালদার বারবার ছুটে গেছেন নদীর কাছে, ঝর্ণার কাছে, সমুদ্রের কাছে। জল তার তৃষ্ণা, অভিমান ও একাকীত্বের আঁধার। উপমায়, উৎপ্রেক্ষায় জলকে করেছেন প্রেমের স্মারক। অনুভবের একত্ম আঁধার। ব্রহ্মপুত্রের জলে দেবীদের স্নানে লাজধোয়া অমৃত শরীরে তার গোপন খোয়া গেছে। বুকের চরে মৃত শুয়ে থাকে কপোতাক্ষ। নদীকে অনন্য উপমায় পাথর বানিয়েছেন ‘অথৈ পুরাণ’ কবিতায় :
‘নদীও পাথর হয়, জলের গোপন জলে চূর্ণ পরকীয়া’

সুগন্ধার ঘোলাজল শতাব্দির পুরাণ হয়ে উঠেছে ‘চন্দদ্বীপ’ কবিতায়। মানস সরোবর ও বলেশ্বর নদী ও ভাগীরথী জলাঙ্গীকে বর্ণিল পুরাণ হিসাবে দাড় করিয়েছে ‘পরকীয়া’ কবিতাটি। হয়ে উঠেছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ :
‘স্বর্ণকুমারী থেকে দ্রাবিড় বঙ্গে আজও খুঁজি প্রিয়তমা জলের বালিকা। মানসের কুলে যাকে হারিয়েছি অহংকারী রাজহংসের ডানায়। বলেশ্বরের কিনার ছুঁয়ে দাড়িয়ে থাকি, এই পথে বেহুলাও গেছে বুঝি ইন্দ্রের সভায়। অন্ধকারে কেঁপে ওঠে অন্ধ পরকীয়া। নিদ্রার ওপারে ডাকে খুল্লনা সুন্দরী। ভাগীরথী-জলাঙ্গীর পারে ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান- হাতে বীজতত্ত্ব, পিঠে গন্ধমের ঝুড়ি।’

নদী তার আধ্যাত্ববাদ। ‘তিন নদী’ আধ্যাত্মিকতাকেই ফুটিয়ে তোলে ‘স্বজন’ কবিতায় :
‘তিন নদী কুলে রাখি- তুমি কোন অলকানন্দা জল, কতটুকু ভাসাতে পার আমার উপল। দীর্ঘ রাত্রি শেষে খুলে যায় জলের বুনন।’

ডাহুক ডাকা ভোরে নদীর বুক থেকে সূর্যের উত্থান মানসপটে এঁকে দেয় অপরূপ চিত্রকল্প। উপমায় নদী-সূর্যের ক্রিড়াকৌশল জীবন ছলনার একাংশ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এর পরেই আলোর দরজা খুলে যায়, বিকেল আসে শূন্যতা নামে। এ য্যানো জীবনের চরম ধাঁধাঁ। নদীর সাথে চাঁদের চিত্রকল্প ফুটে ওঠে ‘অন্য দীর্ঘশ্বাস’ ও ‘ছায়ামন্ত্র’ কবিতায় :
‘নদীর পাগলা জলে চাঁদের ঝিলিকবাজি- দীর্ঘতর রাতের বুনন।’ (অন্য দীর্ঘশ্বাস)
‘ও চাঁদ… ডুব দেও জলের গভীরে, জলকে কুমারী বলে ডাক। জেনে রেখ জল কভু জানে না ছলনা। ছায়ামন্ত্র শেষে কোন মৃত্যু জাগে জল ও কবির।’ (ছায়ামন্ত্র)

কবিতা তার জন্মকাল থেকেই নদীর মতো। এ কূল ভেঙে ও কূল গড়বে এটাই স্বাভাবিক। বাকবদল হবে। নতুন নতুন চর জেগে উঠবে। সে চরে কোন চাষী কোন ফসল রোপন করবেন সেটা তার নিজস্ব স্বকীয়তার উপর নির্ভর করবে। আবার এ চরেই কেউ কেউ গড়ে তুলবেন স্বপ্নের আবাস। কবি পরিতোষ তার কবিতার উর্বর চরে সফল চাষে নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। হয়ে উঠেছেন ধ্যানমগ্ন ঐশ্বর্যের রোমান্টিক কবি।

লেখক : কবি ও সম্পাদক (ছোটকাগজ)।

মন্তব্য: