সাধক আয়নাল মিয়া বয়াতি ।। গালিব রহমান

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

বাংলার লােকসংগীতের ধারায় এক অনন্য নাম, সাধক আয়নাল মিয়া বয়াতি। যাকে সারাদেশের মানুষ ‘ফরিদপুরের আয়নাল বয়াতি’ নামে চেনেন। এই নামের পেছনে তার প্রায় ৭০ বছরের সাধনা। প্রথম দিকে তিনি ঢোল বাজাতেন কমলা বয়াতির সঙ্গে। কমলা বয়াতিই বােধহয় দেশের প্রথম নারী বয়াতি। তাঁর নিবাস ছিল ফরিদপুরের বােয়ালমারী থানার মহিষশালা নামক স্থানে। আয়নাল মিয়ারও জন্মভিটা মহিষশালা। ১৯১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি (জন্ম তারিখ নিয়ে মতান্তর আছে) তাঁর জন্ম। বাবা- গােলাপ মিয়া, মা- আবিদুননেছা। একটু বয়সকালেই তিনি গানের সাধনায় ঢুকেছিলেন। জীবনের শুরুতে তিনি পুলিশের চাকরি করেন। বাউল-মনঙ্ক এই মানুষটির সে-কাজ বেশিদিন করা হয়নি। ভালাে লাগেনি। কয়েক বছর চাকরি করার পর ইস্তফা দেন সে কাজে। চলে আসেন তার গুরুর কাছে। বেশিদিন নয়, বছর খানিক বা তার একটু বেশি তালিম নিয়েছেন গুরু ইয়াসিন ফকিরের কাছে। গুরুর মুখে লালন সাঁইজির “বেঁধেছে এমনাে ঘর শূন্যের উপর পােন্তা করে/ধন্য ধন্য বলি তারে” শােনার পর তিনি বিভাের হয়ে পড়েন। এ-গানের তত্ত্ব জানতে চান। গুরু বলেন, এখনই কী আর বুঝবে, গানের মধ্যে থাকো। সাঁইজির এই গান দিয়েই আয়নাল বয়াতির সংগীত-জগতের সূচনা।

বাংলার লােকসংগীতের নানান ধারার গান তিনি করেছেন। ঘেটু গান, জারি গান, শরিয়ত মারেফত কাম প্রেম বিচ্ছেদিসহ নানান পালা গেয়েছেন, লিখেছেন। ‘কয়দিন রইবি পরবাসে দেশের মানুষ দেশে যাই/ আর কতকাল খাইবি মনা বিদেশের কামাই’ বা ‘আমার পিঞ্জরা ভাঙ্গিয়ারে পাখি উড়িয়া গেছে/ না জানি কার নতুন খাঁচায় ধরা পড়েছে’ কিংবা ‘ পৃথিবী তোমাকে সালাম/আমি কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম’ এসবসহ অসংখ্য তাঁর প্রিয় গান রয়েছে। আয়নাল বয়াতির লেখা গান সাড়ে তিনশয়ের ওপরে। তাঁর সন্তানের অকাল মৃত্যুর শোক হাতড়ে তিনি লেখেন ‘আমার পিঞ্জরা ভাঙ্গিয়ারে পাখি উড়িয়া গেছে’। এই শােক তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

আায়নাল বয়াতি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে রাজবাড়ীতে ছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষে গান গেয়েছেন নানান জায়গায়। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। একটা সময় পাক হানারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। কোনাে কারণবশত তিনি বেঁচে ফিরেছেন। লুকিয়ে থেকেছেন। বিজয়ের পরেই লেখা তার একটি গান- ‘শহীদের রক্ত দিয়ারে/জীবনের ইতিহাসের কাগজে ভরে/ লিখেছি সােনারবাংলা নাম।’

যুদ্ধের আগে ও পরে রাজবাড়ীর বিখ্যাত হেকিম লুৎফর রহমানের সাথে কাজ করেছেন। একটা সময় পাবলিক হেলথেও কাজ করেছেন। জনসচেতনতামূলক গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। জীবনের তাগিদে অনেক কিছু করেছেন দীর্ঘজীবনে। মূলত তিনি সুফি দর্শনে সহজিয়া ধারার সাধক।

বাউল সাধনা বা সুফি দর্শনের সাথে যুক্ত মানুষেরা সহজ জীবন চেয়েছেন। একে অন্যে ভালবাসায় বেঁধে থাকতে চেয়েছেন। নিজেকে তুচ্ছ করে প্রাণের সমষ্টিকে পূর্ণতা দিতে চেয়েছেন। এই সহজ মানুষেরা কখনাে কখনাে সহজ থাকতে পারেননি সমাজের কিছু স্বার্থবাদীর কারণে। এই তরিকায় মানুষ কিছুটা মানবিক হয়ে নিজেকে চিনতে শেখে। তাতেই ধর্ম বা রাজনীতির ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সময়ে সময়ে বাউলদের বিরােধীতা বাড়ে বা তাদের প্রতি আঘাত আসে। তারপরও তারা মানুষকে আনন্দ দিয়ে লােকসংগীতকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যাচ্ছেন।

সাধক আয়নাল মিয়া বয়াতি এমন একজন শিল্পী যিনি ৭০ বছরের দীর্ঘ সময় একটানা গান গেয়ে গেছেন, যা বাংলার ইতিহাসে বিরল। বর্তমানে গানের মানুষ হিসেবে লােকসংগীত শিল্পী হিসেবে যারা দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাদের অনেকেরই গুরু বা পিতা তুল্য ফরিদপুরের আয়নাল মিয়া। এই গুণি মানুষটির রয়েছে দেশব্যাপী অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী। অনেক শিষ্যও আছে তাঁর। এদের মধ্যে আবুল সরকার, অসীম বাউল, লােকমান দেওয়ান, আব্দুল মজিদ সরকার প্রমুখ তার খাস শেষ্য। যারা সারাদেশে বহুল পরিচিত।

আয়নাল বয়াতি ১০০ বছর ৬ মাস বয়সেও মঞ্চে গান গেয়েছেন। তখন তার দমকিছুটা কমে এলেও গলায় জোর ছিল। ভক্ত অনুরাগী শিষ্যরা তাকে এ-বয়সেও দেশের নানা প্রান্তে টেনে নিয়ে গেছেন। দীর্ঘজীবনে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য অসুস্থতা ছিল না তাঁর। মৃত্যুর ৩ বছর আগে মাগুরায় একটি মঞ্চে গান করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। নিয়ে আসা হয় ফরিদপুরের ডায়াবেটিক হাসপাতালে। এই হাসপাতালের বেডে তিনি তাঁর শেষ গানটি লেখেন- ‘পৃথিবী তােমাকে ছালাম’। তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এরপরও গান করেছেন। গত ৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ফরিদপুরের শহরতলী সাদীপুরস্থ তাঁর নিজ বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ডায়াবেটিক হাসপাতালে ভর্তি করান তাঁর পরিবার। রাত ১০টার দিকে তিনি বিদায়ী সালাম জানান পৃথিবীকে। সে-সময়ে দেশের অনেক স্থানে গানের আসর চলছিল। গানের পাখির বিদায় সংবাদে সেসব আসর স্তব্ধ হয়ে যায়, কেটে যায় সুরের চলমান রেখা। এমন একজন সাধক শিল্পীর প্রয়াণে বাউল জগতের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা হয়তাে পূরণ হবার নয়। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর গানের সুরে, ভক্ত-শিষ্যের হৃদয়ে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০০ বছর ১০ মাস ১ দিন।

তাঁর শেষ গানটি এখানে রাখা হলাে-

পৃথিবী তােমাকে সালাম

আমি কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম।

কী ছিলাম আর কী হয়েছি আরও কিবা হবাে

মা জননী নাইরে ঘরে দুঃখ কারে কবাে

এ ভব মায়ায় পড়ে আমি সকল হারাইলাম।

কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম…

বুদ্ধি গেছে বিবেক গেছে যৌবন পরলাে ভাটি

রাস্তায় আমার পাও চলে না হাতে ধরছি লাঠি

মাটির দেহ হবে মাটি খাটি জানিলাম।

কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম…

মন হরষে দরবার ঘরে বসতাম আমি যাইয়া

থাকতাে ভক্তবৃন্দ আশেপাশে দেখতাম চাইয়া চাইয়া

আমার মুখে মধুর বাণী তাদের শুনাইতাম।

কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম…

ফরহাদ রইলি হারুন রইলি অসীম আর আবুল

আমার মতাে জেনে শুনে কেউ করিস না ভুল

অধম আয়নাল মিয়ার ভুলের মাতল শেষকালে পেলাম।

কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম…

তথ্যসূত্র: আয়নাল বয়াতির পরিবার

মন্তব্য: