বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসে মুন্সী রইচ উদ্দিন এক ক্ষণজন্মা সাধকের নাম। অবিনাশী অনন্য আলোর ছটা ওস্তাদ মুনশী রইচইদ্দিন। সুরময় সুদীর্ঘ পথ ধরে এই ব্যাক্তিত্বের আগমন।
যশোর জেলার তৎকালীন মাগুরা মহাকুমার বর্তমানে শ্রীপুর উপজেলার নাকোল গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুন্সী পরিবারে ১৩০৮ সালের ২৩শে পৌষ ওস্তাদ মুন্সী রইচইদ্দিন জন্মগ্রহন করেন। ছেলেবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি ছিল তার নিদারুণ ঝোঁক। জনশ্রুতি আছে তাঁর পিতা মুন্সী আব্বাস উদ্দিন ধ্রুপদী ও টপ্পা পারদর্শী ছিলেন। ১৭ বছর বয়সে মেট্রিক পাশ করার পর রইচউদ্দিন বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে যান সংগীত নেশায়। কলকাতার প্রসিদ্ধ সংগীতবিদ রাসবিহারী মল্লিকের কাছে ধ্রুপদ ও খেয়ালের উপর তালিম নেন। কিন্তু আর্থিক কষ্টের কারণে তার সংগীতশিক্ষা জীবন বারবার ব্যহত হতে থাকার কারণে তিনি সাতাশ টাকা বেতনে ‘ওয়েলম্যান স্টোর- এ চাকুরী নেন। এসময় তিনি এক বিদেশি কন্যার প্রেমে পড়েন। কিন্তু প্রেমবিয়োগে মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তিনি পুনরায় ফিরে আসেন নাকোল গ্রামে। পিতার আদেশে বিয়ে করেন এবং কুষ্টিয়া মিলে চাকুরী নেন। তিনি কুষ্টিয়া, মাগুরা, নড়াইল ও খুলনাতে সংগীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তিনি আবার কোলকাতা গিয়ে গিরিজা শংকর চক্রবর্তীল ভাগ্নে পণ্ডিত যামিত্রী গাংগুলীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে থাকেন। ১৯৪২ সালে কোলকাতা সঙ্গীত কলাভবন থেকে সম্মানসূচক সার্টিফিকেট লাভ করেন। তিনি দীর্ঘদিন রবিন মুন্সী(R. Munshi) নামে কোলকাতা বেতারে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে বেশ সুনাম অর্জন করেন।
‘সরল সংগীত সংগ্রহ’ এবং ‘সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি’ নামে তিনি দু’টি সংগীত গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্লেষণ করেন রাগের ধ্রূপদ ,খেয়াল, চতুরঙ্গ, ত্রিবট, তারানা, ঠুমরী,এবং বহু প্রকারের প্রচলিত ও অপ্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি। তিনি ‘পদ্মাবতী’ নামে এক অভিনব রাগ রচনা করেন।
দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা বেতারে নিয়মিত শিল্পী হন। ১৯৫৫ সালে রইচউদ্দিন বর্তমান খ্যাতনামা ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত কড়া স্পষ্টবাকের অধিকারী এই গুনি শিল্পীসুলভ ব্যবহারে সবার আদর্শ ছিলেন। ১৯৬০ সালে তার ‘প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি’ পান্ডুলিপি সরকারী শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে এবং সেই সাথে দেশের চারটি শিক্ষাবোর্ডের সংগীতের প্রধান পরীক্ষকের সম্মানও লাভ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে ছোটদের ‘সা-রে-গা-মা গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রকাশ করেন ‘সংগীত পরিচয়’ ‘অভিনব শতরাগ’ ‘গীত লহরী’ সংগীত গ্রন্থ। ১৯৬৬ সালে ‘অভিনব শতরাগ’ গ্রন্থের মাধ্যমে ‘দাউদ সাহিত্য’ পুরষ্কার লাভ করেন। অনন্য অবদানের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাকে ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ সম্মানে ভূষিত করেন। দেশে বিদেশে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
মুন্সী রইচইদ্দিন ‘আলম প্রিয়া’ নামে রাগ রচনা করেন। শত শত সৃষ্ট রাগের একটি মাত্র গ্রন্থ প্রকাশ করে গেছেন মুন্সী রইচইদ্দিন। ‘অভিনব শতরাগ’ -১ম খন্ড আসাবরী ঠাঁট সিরিজ। রাগগুলির নামঃ ভীম কোষ , শোভাবতী, যশোহরী, শোভা, যশোমতী, মধুমতী, শোভারঞ্জনী, জিলানী, পদ্মাবর্তী, ঢাকেশ্রী। মুন্সী রইচইদ্দিনের অন্যতম গানের ছাত্রী ফেরদৌসী রহমান দেশে বিদেশে গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করছেন।
অবিভক্ত বাংলার সুবিশাল সংগীত জগৎ জুড়ে মুন্সী রইচইদ্দিন এর সুদীর্ঘ শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন ও সাধক জীবনের পরিধি বিস্তৃত। তার নাম আজ সংগীতের সুবিশাল ভুবনে সংগীতপ্রিয় সর্বজনবিদিত। তার সুশিক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই সংগীতের ভুবনে গৌরব সুনামের আসন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই তার সার্থকতা।
আমাদের সংগীত ভুবনে যাদের প্রভাব ও ব্যাক্তিত্ব গৌরবের, এমন অনেকেরই সংগীত এর ভিত্তি রচিত হয় মুন্সী রইসইদ্দিনের হাতে। সানজিদা খাতুন,ফেরদৌসী রহমান,মরহুম আবু বকর খান,মালেকা আজিম ,লতিফা চৌধুরী,নাসরীন শামস্,সাহিবা মাহবুব,তাজিন চৌধুরী,মিলিয়া আলী,রশিদা চৌধুরী,খুরশিদ আজিম,খুরশিদ আজিম সিদ্দিকী, শওকত আরা ইসলাম। যারা তার কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেছেন তাঁরা কোনদিনই তাঁকে ভুলতে পারবেন না।
মুন্সী রইচইদ্দিন ছিলেন একনিষ্ঠ সমাজক সেবক ও ধার্মিক। যে কোন অবস্থায় তিনি যথাসময়ে নামাজ আদায় করতেন। ছাত্রদেরকে নামায পড়ার উৎসাহ দিতেন। অনেক পরিশ্রমী এই সাধক ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় অবর্ণনীয় কষ্টভোগে ১৯৭২ সালে চরম অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। বিশাল সংগীত কর্মজীবনের ইতি ঘটে ১১ এপ্রিল ১৯৭৩- এ তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে। তিনি রেখে যান তিন পুত্র ও দুই কন্যা এবং অসংখ্য শিষ্য ও ভক্ত।
আজিমপুর নতুন গোরস্থানে ঢুকলেই হাতের ডানদিকে নাতিদীর্ঘ কদম গাছ। তার ছায়ায় নিরবে নিরবে ঘুমিয়ে আছেন ওস্তাদ মুন্সী রইচইদ্দিন।
[তথ্যসূত্র সহায়কঃ রাশেদুল ইসলাম সাজ্জাদ সম্পাদিত মাগুরা জেলার শিল্পী সাহিত্যিক ও সাপ্তাহিক মাগুরা বৃত্তান্ত]