মাগুরার কিংবদন্তিঃ শতখালীর চন্ডিদাস-রজকিনীর ভিটে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এক
শতখালী গ্রামের পাশ দিয়ে এক সময় প্রবাহমান ছিল একটি খরশ্রোতা নদী। ঐ নদীর নাম কি ছিলো তা কালের অতলে হারিয়ে গেছে। ঐ নদীর এক পাড়ে ছিলো প্রেমের সম্রাট চন্ডীদাস আর অপর পাড়ে ছিলো প্রেমের সম্রাজ্ঞী রজকিনীর বাড়ি। রজকিনী ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। তিনি ছিলেন ধোপার মেয়ে। অপরদিকে চন্ডীদাস ছিলেন হিন্দু কুলীন বংশের ছেলে। রজকিনী প্রদিদিন নদীর ঘাটে কাপড় ধুতে যেতেন। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন চন্ডীদাস। কিন্তু সমাজ সংস্কারের কারণে তার ভালোবাসার অভিব্যক্তি প্রকাশের কোন মাধ্যম ছিলো না। রজকিনীও মুগ্ধ ছিলেন চন্ডীদাসকে দেখে। তাকে আপন করে পাওয়ার তীব্র বাসনা জাগে তার। কিন্তু মনে যদি প্রেম বাসা বাধে তা কি আর চাপা থাকে? কোন না কোন সময় তা প্রকাশ পেয়ে যায়। আর প্রকাশ না পেলে সে প্রেমের স্বার্থকতাই বা কোথায়? তাই একদিন রজকীনি তার বান্ধবী শঙ্করীর কাছে সব কথা খুলে বলে। সেদিন ছিলো জোছনা রাত। নদী থেকে ভেসে আসছিল ছোট ছোট ঢেউয়ের কলকল ধ্বনী। দূর বাগানে শোনা যাচ্ছিল রাতজাগা পাখিদের ডাক। চাঁদ তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। সুদূর মাঠ থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। চারিদিকে নিরব নিস্তব্ধ এক পরিবেশ। রজকিনী ও শঙ্করী নদীর ঘাটে এসে সিঁড়ির ওপরে এসে বসলো। শঙ্করী বললোÑ

  • তুই অমন করে আছিস কেন? সারাদিন তোকে মনমরা দেখি। কাজকর্মে মন নেই। ভাবলিতো মরলি।
  • আমি মরতেই চাইরে শঙ্করী।
  • মরলেই কি সব সমস্যা সমাধান হয়?
  • তাহলে আমি কি করবো? তুই আমাকে বলে দে শঙ্করী।
  • আমি যে কি করবো তা তোকে বোঝাতে পারছি না। বামন হয়েতো চাঁদ ধরা যায় না। আকাশকে ভালোবাসলে তাকে কি ছোঁয়া যায়?
  • তোর এসব তত্ত্ব কথার মানে আমি কিছুই বুঝি না।
  • তোকে কিছুই বুঝতে হবে না। শঙ্করী, আমার বুঝ আমাকে বুঝতে দে।
  • শোন, রাজা নিজের কথা অনেক সময় নিজে বুঝতে পারে না। নিজের সমাধান অনেক সময় নিজে করা যায় না। তার জন্য আর একজনের সাথে কথা বলতে হয়। বলতো তোর কি হয়েছে?
  • আমার কিছুই হয়নি।
    এই বলে রজকিনী উঠে দাঁড়ায়। শঙ্করী আবার তাকে টেনে বসায়। তরপর বলে-
  • তুই আমাকে সব খুলে বল রজো। দেখি, আমি তোকে সাহায্য করতে পারি কি-না।
  • আমি জানি, তুই আমাকে সাহায্য করতে পারবি না।
  • এটা তোর ভুল। আমি যদি না পারি, প্রয়োজনে আর একজনের সাহায্য নেবো। তবে আমি যতদূর শুনেছি, মানুষ কানাকানি করছে তোকে আর চন্ডিদাসকে নিয়ে।
  • যদি সবই শঙ্করী, তা নিয়ে এতো প্রশ্ন করছিস কেন আমাকে? বল, আমি এখন কি করতে পারি? আমিতো চন্ডিদাসকে ভালোবেসে ফেলেছি। চন্ডিদাস আমাকে ভালোবাসে কি-না তাও আমি জানি না। চন্ডীদাসকে না পেলে আমি বাঁচবো নারে শঙ্করী।
  • এই কথা? কেন পাবি না চন্ডিদাসকে? তাকে তোর পেতেই হবে। সবুর কর। সবুরে মেওয়া ফলে। তুই আজ বাড়ি চল। রাত অনেক হয়ে গেছে। আমাকে একটু চিন্তা করতে দে রজো, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।
    চন্ডীদাস ছিলেন জমিদারের ছেলে। অনেক শিক্ষিত। তিনি পদাবলী গান রচনা করতেন। তিনি ছিলেন বাঁশরী বা বিশালক্ষী দেবীর পূজারী। প্রেমে পড়লেও কাউকে কিছুই বলতে পারলেন না। রাতের গভীরে কাঠের প্রদীপের তেলের সলতেই আলো জ্বালিয়ে নিজের ঘরের মধ্যে পায়চারী করতেন। পদাবলীর কিছু লিখতেন আবার ছিঁড়ে ফেলতেন। আবার কোন পদাবলী রেখে দিতেন। অনেক সময় লেখার আসনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন। ভাবতেন রজকিনীর কথা। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে-
  • রজকিনীকে কি আপন করে পাবো? রজকিনীকে কি ভালোবাসতে পারবো? রজকিনী কি আমাকে ভালোবাসবে?
    হঠাৎ চন্ডীদাস মনে করতেন যেন রজকিনী তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রজকিনী হাসছে। নথ নেড়ে নেড়ে কথা বলছেÑ
  • আমি তোমার। তোমারই থাকবো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ভালোবাসায় আমি ধন্য হতে চাই। আমি তোমার সাধন সঙ্গিনী হতে চাই। আমি গোপাল মন্দিরের সেবাদাসী হতে চাই।
    এসব কথা চন্ডীদাসের কানে বেজে উঠতো। অনেক সময় ভাবতেন রজকিনী হয়তো তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। অবচেতন মনে উঠে দাঁড়াতেন। রজকিনীকে স্পর্শ করার জন্য ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দেখতে পেতেন না কিছুই। একটা শূন্যতার মাঝে কি যেন একটা শব্দ করে চলে যেতো। আবার তিনি তার লেখার আসনে এসে বসতেন। এভাবেই কেটে যেতো রাতের পর রাত।

দুই
রজকিনী আর চন্ডিদাসের বাড়ি ছিলো নদীর এপার ওপার। রজকিনীর বাড়ি ছিলো নদীর উত্তর পাশে। আর তারই সোজাসুজি সামান্য পূর্ব-দক্ষিণ পাশে কোণে ছিলো চন্ডিদাসের বাড়ি। রজকিনীর বাড়ির সোজাসুজি নদীতে পাকা ঘাট ছিলো। সে ঘাটে প্রতিদিন রজকিনী কাপড় ধুতে যেতো। প্রথমে চন্ডীদাস নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে রজকিনীকে দেখতেন। কিন্তু রজকিনীর সাথে কোন কথা বলতে সাহস পেতেন না। সামাজিক বাধাও ছিলো প্রবল। নিচু বর্ণের মেয়ের সাথে কথা বললে সমাজের মানুষ তাকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে এটাও তার একটা শঙ্কা ছিলো। কিন্তু প্রেমতো কোন শঙ্কা মানে না। বাঁধা মানে না। কোন সংস্কার বোঝে না। প্রেমের গতি নিজ গতিতেই মহিয়ান। একবার জেকে বসলে হৃদয় থেকে তা আর তাড়ানো যায় না। চন্ডীদাস যে রজকিনীকে ভালোবেসে ফেলেছেন। এখন কি করবেন তিনি? রজকিনী ছাড়া তার সবকিছুই অচল হয়ে পড়েছে। কারো কাছে প্রকাশও করতে পারছেন না তার প্রেমের কথা। জ্বালাবুকে তিনি ছটফট করছেন। বিষয়টি গ্রামের মানুষ কম-বেশি জেনে ফেলেছে। ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, নলখাগড়ার জীবন যায়’। চন্ডীদাস জমিদারের ছেলে । তাকে কিছু বলারতো কেউ নেই। তারা দশটা অন্যায় করলেও তাদের বিচার করার মতো কেউ নেই। কিন্তু সামান্য একটু অন্যায় হলেও রজকিনীদের বিচার এই জমিদার বাবুরা করেন। চাপ সৃষ্টি করেন সাধারণ মানুষের উপর। রজকিনী আর চন্ডীদাসের প্রেমের লুকোচুরি খেলা একদিন চন্ডীদাসের জমিদার পিতার কানে পৌছে গেলো। তিনি তখন ধোপাপাড়ার লোকজনদের ডেকে পাঠালেন। কড়া সুরে ঘোষণা দিলেনÑ

  • রজকিনীকে ঘাটে কাপড় কাঁচতে আসা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ধোপা পাড়া আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হবে।
    ধোপা পাড়ার লোকজন মাথা নিচু করে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে এলো।
    পরদিন সকালে ধোপাপাড়ার সব লোক রজকিনীদের বাড়ির সামনে হাজির হলো। রজকিনীর বাবা রজককে ডাকা হলো। তারপর ধোপা পাড়ার মাতবর পঙ্কজ মল্লিক রজককে উদ্দেশ্য করে বললেন-
  • তুমি কি কিছু জানো রজক?
  • না, আমিতো কিছুই জানি না। কি জন্য তোমরা এখানে উপস্থিত হয়েছো তাওতো জানি না। পঙ্কজ মল্লিক রেগে গেলেন। তারপর বললেন-
  • সবকিছু জেনে না জানার ভান করছো যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না। মেয়ে রজকিনীকে নিয়ে কি শুরু করেছো?
    মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমতা আমতা করে রজক বললেনÑ
  • আমার রজকিনী আবার কি করলো? আমার রজকিনীতো লক্ষী মেয়ে। আমি অসুস্থ মানুষ, কাজ করতে পারি না ভালোভাবে। ওই কাপড় কাঁচে। ওর পয়সাতেইতো সংসার চলে। ও যে কিছু করবে তার সময়টাই বা ওর কই?
  • ওসব কথা চলবে না। তোমার মেয়ে মৌচাকে হাত দিয়েছে। জমিদার নন্দিনী চন্ডীদাসের প্রেমে পড়েছে। জমিদার বাবু হুকুম দিয়েছেন এর একটা বিধিব্যবস্থা না হলে ধোপাপাড়া পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। হয় মেয়েকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো, না হয় ধোপাপাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও।
    এসব কথা পাশে দাঁড়িয়ে রজকিনী শুনছিলো। রজকিনীর বিরুদ্ধে এসব অপবাদ সে সহ্য করতে পারছিলো না। সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো-
  • আমি চন্ডীদাসকে চিনি না, চন্ডীদাস কে তাও জানি না। আপনাদের কাছে শুনলাম চন্ডীদাস জমিদারপুত্র। যাকে জানলাম না, শুনলাম না, বুঝলাম না, তার সাথে কি করে আমার সম্পর্ক হবে? আর তারই বিচার করা হচ্ছে এটা কি চন্দ্র রাজার গরু চন্দ্র মন্ত্রির শাসন? আপনারা বাড়ি যান। তারা জমিদার হয়েছে বলেই যা করবে তাই আমাদের শুনতে হবে?
    পঙ্কজ মল্লিক এবার রেগে গিয়ে রজককে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ
  • দেখ তোমার মেয়ের কথাবার্তার শ্রী, তোমার মেয়ের জন্য আমরা কিন্তু মরতে পারবো না। একথা ভালো করে মনে রেখো। প্রয়োজনে তোমার মেয়ে এবং তোমাকে জোর করে এ পাড়া থেকে রাতের অন্ধকারে হাত, মুখ চোখ বেঁধে এমন জায়গায় দিয়ে আসবো যেখান থেকে কেউ কোনদিন ফিরে আসতে পারবে না। আমি বাড়ি যাচ্ছি, দুই একদিনের মধ্যে বিষয়টা ফয়সালা করবা।

তিন
ধোপাপাড়ার এ বিচার আচার যখন অনুষ্ঠিত হয় তার খবর চন্ডীদাসের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। চন্ডীদাস রেগে গিয়ে মনে মনে ভাবলেন, আমি একজন কবি। সৌন্দর্য ও সুন্দরকে আমি ভালোবাসি। সুন্দরের প্রতি আমার আকর্ষণ আছে। সুন্দরকে নিয়ে ভাবতেতো অন্যায় নেই। ভগবান পৃথিবীতে অনেক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন। সে সৌন্দর্যকে উভোগ করলে, সেই সৌন্দর্যকে নিয়ে কবিতা লিখলে ভগবানতো বিচার বসাতে আসেন না। বাদ দিলাম ভগবানের কথা। কারোর রোপিত গোলাপের বনে যদি সুন্দর সুন্দর নানা জাতের গোলাপ ফোটে আর সেটি যদি রাস্তার পাশে হয়, কোন পথিক যদি সেই বাগানের পাশ দিয়ে যায়, ফুল দেখে যদি তার চোখ জুড়ায়, যদি সে বলে ওঠে, আহা! কী সুন্দর ফুল, সৃষ্টির কী মহিমা! আর সেই বাগানের পাশে যদি মালিক দাঁড়িয়ে থাকেন, তিনি যদি এ কথা শোনেন, নিশ্চয়ই তিনি লাঠি নিয়ে ওই পথচারিকে তাড়াতে আসবেন না। তাহলে রজকিনী সুন্দর, তার রূপ আছে, সেই দেখে রূপ যদি আমি মুগ্ধ হই তাহলে আমার অপরাধটা কি? আর সেই অপরাধে ধোপাপাড়া আগুনে ভস্ম হয়ে যাবে এটাতো হতে পারে না। একথা জানাতে হবে আমার জমিদার বাবাকে। তখন চন্ডীদাস উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে যান জমিদার পিতার সামনে।

  • বাবা, অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করতে এসেছি। এজন্য তুমি আমাকে মার্জনা করো। আমি বলতে চাই, কি অপরাধে তুমি ধোপাপাড়া আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছো? কি অপরাধ তাদের?
    (চলবে………..)
    {লেখকের কৈফিয়তঃ মাগুরা জেলার শতখালী গ্রামের চন্ডীদাস-রজকিনীর ভিটা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে। কেউ হয়তো বলতে পারেন আজগুবি গল্প। তবে এ ভিটার সাথে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। কিংবদন্তি কোন যুক্তি-তর্ক- এর শ্রোতধারায় প্রবাহিত হয় না। কিংবদন্তিতো কিংবদন্তিই}
মন্তব্য: