জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

নাহিদা আশরাফী

অতীতের অতলান্ত

আমি দূর থেকেই বাবাকে চিনেছিলাম। ভাদ্রের চিটচিটে গরমেও পরনের ফুলহাতা শার্ট, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লম্বা ঘাড় বাবাকে চেনার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। যদিও এই ফুলহাতা শার্ট বা লম্বা ঘাড় কোনটাই খুব একটা জরুরী ছিলো না। আমি আমার বাবার চতূর্থ ও সর্বশেষ সন্তান; সম্পূর্ণ সজ্ঞানে ও সুস্থ মস্তিষ্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নন্দীরপাড় বাজারেরর প্রায় কোল ঘেঁষে যে নদী বেহায়ার মতন বয়ে গেছে সেই নদীর বুকে ভাসমান বেদে বহরের নৌকায় বাইদানীদের চুড়ি-ফিতার ঝোলার সামনে উপুর হয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে চুড়ি খুঁজছিলেন যেই মানুষটি সে আমার বাবা মোঃ আলী আকবর মুন্সী। কিন্তু তিনি চুড়ি কেন কিনছিলেন? কেন আবার। মা’র জন্যে। সাত বছর বয়সী তখনকার এই আমার জন্যে এটাই ছিলো সবচেয়ে সহজ ও স্বস্তিদায়ক উত্তর। মাকে দৌড়ে গিয়ে খবরটা পৌঁছে দিয়ে যে আনন্দ পেতাম সে আনন্দের কাছে মক্তবের হুজুরের বেতের মারও কিছু ছিলোনা। প্রশ্ন উঠতে পারে দৌড়ে গিয়ে মাকে আনন্দের খবর দেবার সাথে মক্তবের হুজুরের মার খাওয়ার সম্পর্ক কি। সম্পর্ক আছে। মক্তবের প্রতি আমার অনিহা বরাবরই। আমি আর সেজ ভাই ছিলাম নন্দীর পাড় হাইস্কুলের ছাত্র। তিনটায় স্কুলছুটি হলে বাড়ি ফিরে ক’টা ভাত মুখে দিয়ে আবার মক্তবে পড়তে যেতে কোনভাবেই মন, শরীর সায় দিতোনা। তাছাড়া ঝিমধরা এই দুপুরগুলো আমায় বেশ টানতো। কেমন এক নির্বিরোধী মায়া জড়িয়ে থাকতো এই দুপুরগুলোতে। মায়ের মমতার মতো। এই সেই করে তাই মক্তবে যাবার সময়টুকু কাটাতে পারলেই যেন আমি বেঁচে যেতাম। কিন্তু বাঁচা কি এতই সহজ?

– বাজান অক্ষনও খাড়াইয়া রইছোস। তাড়াতাড়ি যারে বাজান। হুজুরের নামাজ শ্যাষ হইলো বইলা।

আমি তবু গো ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। গোবর দিয়ে উঠোন লেপতে থাকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেখানে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপর রোদের করুণা খেলা করতো। ওই মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যেতনা। আমি যন্ত্রের মতন মক্তবের দিকে পা বাড়াতাম। 

মক্তবে যাবার রাস্তা ছিলো দুটো। এক সড়ক পথ আর এক নরক পথ। পূবপাড়ার মল্লিকবাড়ির উঠোন পেরুলেই খাল। খালের উপর আধভাঙ্গা বাঁশের সাকো। ওটা পার হলেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইট বিছানো পথ। পথে উঠে টানা দশ মিনিট হাটলেই নন্দীরপাড় হাইস্কুল। সেই হাইস্কুলের পাশেই নূর-ই-জামিয়া মসজিদ, মাদ্রাসা আর এতিমখানা। সপ্তাহে পাঁচদিন মসজিদের মক্তবখানায় বাদআসর আমাদের আরবি শিক্ষা দেয়া হতো। মোটকথা পঁচিশ মিনিট হেটে গেলে সড়ক পথে মক্তবে পৌঁছানো যেত। পঁচিশ মিনিটের এই পথ চাইলেই  দশ মিনিটে পাড়ি দেয়া সম্ভব ছিলো। কিন্তু তাতে গ্রামের মুরুব্বীদের ঘোরতর আপত্তি। আপত্তির কারন অই বেদেপাড়া বস্তি। তখন বুঝতাম না। বোঝাতো দূরের কথা বরং বিস্ময়ের সীমা থাকতো না যখন দেখতাম গ্রামের যে সব যুবক অথবা বয়সীরা আমাদেরও সব জায়গার ছায়া মাড়াতে দিতেও নারাজ তারাই আবার সবার অগোচরে, রাতের অন্ধকারে সেই বেদে বস্তিতে আসা-যাওয়া করছে। কি তাজ্জব ব্যাপার। বড়দের এসব ব্যাপার স্যাপার বুঝতে আমার অনেকদিন লেগেছিলো। ওই বেদে বস্তির মাঝখান দিয়ে হেটে একটু এগোলেই ধলারখালের একটা অংশ অযথাই ধুম করে গ্রামের খানিকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। কার্যত এই অংশের কোন অবদাননেই। এক ঘাড়ত্যাড়া কিশোরের মতন, ইচ্ছে হয়েছে তো ধরণী দ্বিধা করে ঢুকে পড়েছে।  

খাল পেরুনো কোন ব্যাপারইনা। এত এত বেদে নৌকো একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকে। তার উপর দিয়ে দিব্যি ওপারে চলে যাওয়া যায়। ওপারে উঠে মাতবরের করাতকলের পিছন থেকে পাঁচ মিনিট এগোলেই মসজিদের অজুখানা। দেয়াল টপকে উঠে গেলেই ঝামেলা শেষ। কিন্তু বললেই তো আর ঝামেলা শেষ হয়না।ওপথ দিয়ে যেতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই বাবাকে দেখতে পেতাম চুড়ি, ফিতা, শাড়ি আরো কত কি কিনতে। তক্ষুনি অজুখানার দেয়াল টপকে না গিয়ে উল্টো পথে দৌড়ে এসে মাকে খবর দিতাম বাবা আজ তার জন্যে কী কী আনছে তার ফর্দ শোনাতে। মা খুশি হলেও কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, ‘ তুমারে না কইছি ওই পথ দিয়া যাইবা না। ময়মুরুব্বির কতা হুনতে অয় বাজান। আর এই যে ফিরত আসলা অক্ষন যাইতে যাইতে দেরী অই যাবোনা? হুজুরে আইজকাও বেজার অইবো। সব কিছু দেখতে নাই । সব পথে যাইতেও নাই। যাও দৌড়াও বাজান জোরে দৌড়াও।

আমি তৃপ্তি নিয়ে আবার দৌড় শুরু করতাম। দেয়াল টপকাতে গিয়ে প্রায়ই ধরা খেতাম। হুজুর দেরীর জন্যে আর দেয়াল টপকানোর জন্যে দুই হাতে গুনে গুনে বেতের গোটাচারেক বাড়ি দিতেন আর অবাক হয়ে আমার মুখে খেলে বেড়ানো আনন্দের সূত্র আবিস্কারের চেষ্টা করতেন। 

আমার মানে আমাদের কোন বোন নেই। আমরা চারভাই। চাতক আর কতটা হাপিত্যেস করে জলের জন্যে। আমার বড় তিন ভাই নাকি তার চেয়েও বেশি হাপিত্যেস করেছিলো একটা বোনের জন্যে। আমায় দেখে তারা এতটাই দুঃখ পেয়েছিলো যে আমার দিকে দু’তিন মাস পর্যন্ত ফিরেও তাকায়নি। ভাইদের দুঃখটা কমলেও আমার দুঃখটা এখনও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আহা কেন আমি মেয়ে হয়ে জন্মালাম না। তাহলে তো বাবা আজ আমার জন্যেও চুড়ি কিনতো, ফিতে কিনতো। বাবাকে আরও একদিন দেখলাম স্কুল থেকে ফেরার পথে। নারায়ণ বস্ত্রবিতান থেকে ডুরেছাপার শাড়ি কিনতে। ইশ কীভাগ্য আমার মায়ের। মায়ের একটা  টিনের ট্রাঙ্ক ছিলো। বেশ রংচঙা। চারপাশে লাল রঙের মধ্যে নীল নীল লতা আকা।  ট্রাঙ্কটার উপরের দিকে দু’টো বড় বড় ঢোল কলমি ফুল। মা বাবার দেয়া সব চুড়ি, ফিতা, শাড়ি ওটার মধ্যেই রেখে দিতেন। কাউকে দেখাতেন না। কতদিন হ্যাংলার মত টিনের অই  ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে থেকেছি, মায়ের অগোচরে কতবার এটার তালা ধরে নেড়ে চেড়ে দেখেছি যদি ভুল করেও কখনও খোলা পেয়ে যাই।  

চৈত্রের ছাতি ফাটা গরমে একদিন স্কুল থেকে ফিরে খেতে বসেছি। মা আচল বাড়িয়ে মুখের ঘাম মুছতে গেলেই মেজাজ বিগড়ে গেল।

– মা বাবায় এত সুন্দর সুন্দর কাপড় কিনে, চুড়ি কিনে। এইগুলা না পইড়া তুমি এমন ছিঁড়া শাড়ি পইরা থাকো ক্যান? মাইন্সে দেখলে কি কয়? বাবারেওতো গেরামের মানুষ মন্দ কইবো। তুমি এক্ষণি শাড়ি বদলাইয়া নতুন শাড়ি পিন্দা আসো। নইলে কইলাম ভাতই খামুনা।

মা আমার ঘামের বদলে নিজের চোখ মুছতে মুছতে দাওয়া ছেড়ে ঘরে চলে যান। আমার বড় ভাই আমাকে প্রথমে আদর করে পরে আদরে কাজ না হওয়ায় ধমকে ভাত খাওয়ান। 

মায়ের শাড়ি দিনদিন আরও ছিঁড়তে থাকে। বাবার বাড়ি না ফেরার রাতগুলোও বাড়তে থাকে। শয্যাশায়ী মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতেই বুঝি বাবাকে এতটা পরিশ্রম করতে হয়। ঠিক মতন বাড়ি আসতে পারেনা, খাওয়া দাওয়াতেও নিশ্চই অনেক কষ্ট হয়। সেইসব কষ্ট কল্পনা করে বাবার জন্যে বুকের ভেতরটায় ব্যথায় টনটন করে আমার। বাবার অসহায়ত্ব, দুর্দশা ভেবে ভেবে মায়ের উপর যতটুকু করুণা জন্ম নিতো তার অনেকটাই চৈত্রে ওঠা হঠাৎ ঘূর্ণি ধুলোর মত উড়ে যেত। আমি বুঝতাম আমার ভেতরে এক কন্যামন বাস করে যে তার বাবার জন্যে একবুক ভালোবাসা পুষে রাখে। আমাদের সংসার আর আত্মমর্যাদা  তখন মায়ের শাড়ির মতন শত চ্ছিন্ন আর রংচটা। দুই ভাই সকাল বেলাতেই বেড়িয়ে যায়। বড় আর মেজ ভাই রিক্সা গ্যারেজে কাজ করে। সেজ ভাই আর আমি পালা করে স্কুলে যাই। সেজ ভাইই বেশির ভাগ দিন স্কুলে যায়। আমি সপ্তাহে এক বা দুইদিন যাই। সন্ধ্যে বেলা বড়ভাই চাল-ডাল নিয়ে ফিরলে তবেই রান্না হয়। কোন কোন দিন শুধুই চাল নিয়ে আসে। মাঝে দুতিনদিন চালও আনতে পারেনি। মায়ের অসুধেই সব ফুরিয়ে গেছে। পাশের বাড়ির রহমান কাকার বউ কিছু বাসী ভাত দিয়ে গেলে অই এক প্লেট বাসী ভাতের দিকে চারজোড়া চোখের কি তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। ভাই আমার দিকে তাকাতেই আমি নড়েচড়ে বসি। আশায় বুক বাঁধি। আমাকেই মনে হয় খেতে দেবে ভাতগুলো। কিন্তু আমার গালে দু’লোকমা ভাত দিয়েই ভাই প্লেটটি নিয়ে যায় মায়ের কাছে। জলের তৃষ্ণা আমি কোনদিন বুঝিনি। কিন্তু ভাতের তৃষ্ণা কেমন তা আমি জেনে গেছি ততদিনে। কষ্টে, ক্ষোভে চোখের জল ঠোঁট বেয়ে মুখের মধ্যে রাখা ভাতের দলায় লাগে। ভাতে একটা নোনা স্বাদ পাই। অবশ্য তাতে দলাটা গিলতে বেশ সুবিধাই হয়। 

বর্তমানের বুক পকেট

মায়ের মৃত্যু আমাদের চার ভাইয়ের জীবনে সম্ভবত সবচেয়ে স্বস্তিও শোকের ঘটনা। নিশ্চই আমকে খুব নির্মম মনে হচ্ছে। তাইনা? তা হোক। যে সংসারে মৃতের সদ্গতির আয়োজনের চিন্তা শোক আর কান্নাকে ছাপিয়ে যায় এমন সংসারে যে কারো প্রস্থানই জীবন্মৃতদের ভেতর খুব বড় কোন আলোড়ন তুলবার অবকাশ দেয় না। মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে বড়ভাই টানা দেড়দিন ঘুমালেন। মেজভাইকে একবার কাঁদতে দেখেছিলাম মায়ের  লাঠি খানা তুলে রাখবার সময়। সত্যি বলতে দ্বিধা নেই আমরা চার ভাইয়ের তুলনায় মায়ের অবলম্বন হিসেবে লাঠিখানা কম বিশ্বস্তও নিষ্ঠাবান ছিলো না। মায়ের মৃত্যুর দু’বছরের মধ্যে আমাকে এতগুলো ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে যে আমি তখন আর কোন কিছুতেই আশ্চর্য হইনা। বড় ভাইয়ের বিয়ে, মেজো ভাইয়ের নিরুদ্দেশ, কোন এক গভীর রাতে বড় ভাবীর ঘরে বাবার খুন হয়ে যাওয়া, মাদক আর চোরাচালানের সহযোগী হিসেবে সেজ ভাইয়ের জেলে যাওয়া সব কেমন সিনেমার মতন একে একে ঘটতে লাগলো। সেই প্রথম আমার মনে হলো আমাদের মা মূলত একটা পাহাড় ছিলো। সব ঘটনা, দুর্ঘটনা, শোক, সন্তাপ, কষ্ট, হাহাকার চাপা দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলো এই সংসার নামক পৃথিবীতে। পাহাড় হেলে পড়ায় আমাদের বিপর্যয়গুলো এতদিনে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। 

বাবা যে রাতে খুন হলেন এবং ভাই-ভাবীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো সে রাতটা আমার জীবনটাকে আমুল বদলে দিয়েছিলো। আমার কান্না পাওয়া উচিৎ, ভয় বা আতঙ্কে কুঁকড়ে যাওয়া উচিৎ, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কারো সহযোগিতা চাওয়া উচিৎ অথচ আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করলোনা। পড়শিরা যারা সার্কাস দেখতে এসেছিলো তারা সার্কাসের পর সটকে পড়লো। একা একটা বাড়িতে, উঠোনভরা জোৎস্নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। আরে! কেবল্লো আমি একা। একাতো নই। এক দৌড়ে মায়ের টিনের ট্রাঙ্কটার কাছে পৌঁছে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আশ্বিনের সেই মনপোড়ানো জোছনা শুধু সাক্ষী হয়ে রইলো বারো বছরের এক একাকী ভীতু কিশোরের অসীম সাহসী হয়ে ওঠা গল্পের। এরপর শুধুই পথ পাড়ি দেবার পালা। হেটেছি, ঘেমেছি, ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছি, হোচট খেয়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি, দৌড়েছি, ভেসেছি, ডুবেছি। কিন্তু দুটো কাজ কখনই করিনি। এক কোথাও থামিনি আর দুই মায়ের সেই ট্রাঙ্কটা কখনই হাতছাড়া করিনি। যতবার বিপদে পড়েছি, সাহস হারিয়েছি ততবার  জাদুর এই ট্রাঙ্ক আমাকে মায়ের মমতায় আগলে রেখেছে। ট্রাঙ্কটা থেকে অদ্ভুতভাবে  মায়ের শরীরের ঘ্রাণ পেতাম আমি। মুষড়ে পড়া সময়গুলোতে কে যেন ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে আমায় করুণ কণ্ঠে বলতো, ‘বাজান অক্ষনই ভাইঙ্গা পড়ছো?  অনেক দূর যাইতে হবে। উঠো বাজান,। দৌড়াও… আরোজোরে… আরও…’। আর ঠিক তখনই আমার ভেতর একজন ফরেস্ট গাম্প জন্ম নিতো। আমি আবার দৌড়াতে শুরু করতাম।

দৌড়াতে দৌড়াতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জুনিয়র কর্পোরেট হিসেবে আমার জন্যে বরাদ্দকৃত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সুসজ্জিত এক অফিস রুমে এসে সাময়িক থেমেছি। এই এত বছরের নিরবিচ্ছিন্ন দৌড়ে আমার একবারের জন্যেও মনে হয়নি মায়ের ট্রাঙ্কটা খুলে দেখতে। শিশু বয়সের সেই ইচ্ছেটা ততদিনে সময়ের তীক্ষè ছুরির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত। ততদিনে আমি বুঝতে শিখেছি আমার বাবার চুরি,ফিতা কেনার রহস্য, মাপতে শিখেছি মায়ের চোখের জলের লবনাক্ততা, ধরতে শিখেছি ভাত খাওয়ানোর সময় ভাইয়ের ধমকের কারণ, অনুভব করতে শিখেছি নগ্ন আর কদর্য সত্যিকে লুকাতে আমার বিপন্ন মায়ের মুখের বিষণœ মানচিত্র।

আমার স্ত্রী খুব বুদ্ধিমতী  মেয়ে। ছোট্ট সংসারের প্রায় নতুন কেনা আসবাবের মধ্যে টিনের এই ট্রাঙ্কটা নিয়ে কিছুটা গাইগুই করেছে কিন্তু পরবর্তীতে সে বুঝে গেছে নিরীহ একটা টিনের ট্রাঙ্কের সাথে যুদ্ধ করাটা নিতান্তই বোকামো ও বেমানান। ইদানীং দেখি আমার চেয়ে আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীই ট্রাঙ্কটার বেশি যত্ন নেয়।

অফিস, মিটিং, প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশান, স্টাফ ম্যানেজমেন্ট সব মিলিয়ে মোটামুটি এক মেশিন জীবন বেছে নিয়েছি । তবে জমজমাট পার্টিতে , হুইস্কির শীতল গ্লাসে , শরীর ও মন জাগিয়ে দেবার মতন পেলব ও কর্পোরেট  সব সুন্দরীদের সান্নিধ্যেও আমি বেশ ভালোই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। রাত করে বাড়ি ফিরি। মাঝেমধ্যে রূপবতী পি এসকে লিফট দিতে গিয়ে তার হাতের এককাপ চায়ের অফারও ফিরিয়ে দিতে পারি না। ভেতরে ভেতরে একজন দূর্বিনীত, অহংকারী আর কামুক পুরুষ যে আমার ভেতরে বাসা বাঁধছে তা টের পাই। সন্তাপ বা অনুতাপ যে একেবারে কাজ করে না তা বলা যাবে না।  তবে সেটা কয়েক মুহূর্ত মাত্র ।

গত কয়েক দিন ধরেই লোয়ার এবডোমেনে পেইনের কথা বলছিলো আমার স্ত্রী। কাজেরচাপে গতএক সপ্তাহ যাইযাবো করেও ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবার সময় হয়নি। আজ নিয়ে যেতেই হবে। একটু তাড়াতাড়িই বের হলাম অফিস থেকে। বাসায় ফিরে স্ত্রীকে না পেয়ে কিছুটা অবাক হলাম। এই শরীর নিয়ে তার তো কোথাও যাবার কথা নয়। ভাবনায় ছেদ পড়লো এম্বুলেন্সের শব্দে। দ্রুত দরজা খুলে বেরুতেই দেখি এম্বুলেন্সের পেট থেকে বেড়িয়ে আসছে আমার স্ত্রী যার ফ্যাকাসে মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না যেমন তাকিয়ে থাকা যেত না ঘর লেপতে থাকা আমার মায়ের মুখের দিকে।

‘মিসক্যারেজ’ এই একটি শব্দই আমি শুনতে পেয়েছিলাম নার্সের মুখ থেকে। আর কোন কথাই  কানে তখন ঢোকেনি। কারন তখন আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম  বাবাকে। বাগানের কোণে দাড়িয়ে ঠা ঠা করে হাসছে আর এক পা এক পা করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি পালাতে চাইছি, তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইছি কিন্তু কে যেন আমার দৃষ্টির সব আলো কেড়ে নিয়ে শুধু এক দিকে স্থির করে রেখেছে। আমার পায়ে শিকল পড়ানো। আমি মুক্তি চাইছি, ছটফট করছি কিন্তু শত চেষ্টাতেও সে শিকল আমি ভাঙতে বা কাটতে পারছি না। যেন বাবার অনুপ্রবেশ না হওয়া পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই। বিপর্যয়ের কৃষ্ণ গহবরে তলিয়ে যেতে যেতে আমি আমার শেষ আশ্রয় হাতড়ে ফিরি।

ঠিক তখনি  যেন শুনতে পেলাম মায়ের কণ্ঠ। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে আস্তে করে বলছে, ‘সব কিছু দেখতে নাই রে বাজান। সব পথে যাইতেও নাই। দৌড়াও … জোরে দৌড়াও … আরো জোরে।’

সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। এক দৌড়ে মায়ের সেই ট্রাঙ্কটার কাছে পৌঁছুতেই দেখি আমার স্ত্রী ট্রাঙ্কটার উপরে মাথা রেখে অঝরে কাঁদছে। ওর কান্না আমায় শক্তি জোগালো। আমি এক হাতে মায়ের ট্রাংক অন্য হাতে ও’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ালাম।

মন্তব্য: