হোসনে আরা মণি

স্থান- রাজধানী। কাল- গণতন্ত্রের উন্মেষ। পাত্র- কোন এক পথকলি।

ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে। চিরকালের তরে ঘুম।

মেটে রঙের নধরকান্তি দেহ। গলায় কালো তাগিতে ঝোলানো তাবিজের গোছা। তামার মাদুলিটার পেটে কী দোয়া লেখা কাগজ ঠুসে রাখা আছে তা জানে না জননী। জানার কথাও নয়। ফিনফিনে কাগজের বুকে জাফরানি কালিতে নূরানি চেহারার হুজুর কী পাক কালাম লিখে তামার মাদুলির পেটে ঠেসে ঢুকিয়ে মোম গলিয়ে মুখ সীল করে দেয় তা না জানে কেউ। তাবিজের গোপন রহস্য জানতেও চায় না তারা। শুধু জানে যে আল্লাহ্র পাক কালামের তাবিজ খাস নিয়তে ধারণ করলে বালা-মুসিবত থেকে পাওয়া যায় আসান।

আসান মেলে শেরেকি মাদুলিতেও। শ্মশানের মাটি, জাইরোর হাড়, কাছিমের খোল, তক্ষকের লেজ, শকুনের ঠোঁট, শুওরের নাদি, বনরুইয়ের আঁইশ, রজঃস্রাবের রজঃ আর কুফরি কালাম মিলিয়ে যে কবজ তৈরি হয় তার ক্ষমতা বড় কম নয়; কোন কোন ক্ষেত্রে পাক তাবিজের চেয়েও বেশি। তবে ওসব ব্যবহার হয় আসে-দশে, বড় বিপদে- পাককালামে কাজ না হলে তবেই; কিংবা বদনিয়তের কাজে- যে ক্ষেত্রে পাককালাম এমনিতেই কোন কাজ করে না।

ছেলেটি যখন নিতান্তই শিশু ছিল তখন তাকে দেখলে লোকেদের মনে বদচিন্তা, বদনিয়ত, বদখাসলতসহ যাবতীয় বদবিষয় মাথা চারিয়ে উঠতে চাইতো। জীবনের বিভিন্ন সময়ে শেরেকি মাদুলির প্রয়োজন যখন অনস্বীকার্য তখন চোখের সামনে শত শত মাদুলি তৈরিসম্ভব জীবন্ত উপকরণ ঘোরাফেরা করতে দেখলে কার মনে না ভাবনাটা উঁকি মেরে ফিক করে হাসি দিয়ে যায়? অতএব, শিশুটি তাবিজলোলুপ চোখসমূহের সমুখেই নির্দ্বিধায় বেড়ে উঠছিল।

দ্বিধা ছিলো না শিশুর মায়ের ব্যবহারেও। মনে তার কী হতো বা মন বলে তার আদৌ কিছু ছিলো কি না তা জানা না গেলেও চেনা যেতো তার মেজাজ। সেটা এমনই সাংঘাতিক যে পাড়ার অতিকুঁদুলে রাইবাঘিনীও তাকে ভয় পেতো। তার সমান মুখরা হয়তো পাড়ায় আরো মিলবে, কিন্তু মেলানো যাবে না অতখানি নির্লজ্জ্বতা। তা সে কি আজন্ম নির্লজ্জ্ব? কে জানে! তার পনেরো বছর বয়সের আগের ইতিহাসে তো কারো কোনো মন নেই। তার জীবনইতিহাস সবাই শুধু মনে রেখেছে সেই দিন থেকে যেদিন সে তার নপুংশক স্বামীকে পুরো গ্রামের মুখের সম্মুখে উদ্ধতভাবে অস্বীকার করেছিলো।

এর পরই সবার নজর পড়েছিল তার দিকে। তখন থেকেই সবার মনে হতে থাকে যে তার একটা শরীর আছে, সেই শরীরে চাহিদা আছে। এবং দেখা যায় সেই সাংঘাতিক চাহিদায় যোগান দেয়ার জন্য পুরুষশরীর প্রস্তুত আছে এবং যথারীতি নারীগণের নাসিকা কুঁচকে আছে।।

অতএব যা ঘটবার তাই ঘটেছিল।

এক ভোরে এ খবর দাবানলের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কাল রাতের সালিশে কাজলির ‘প্যাট বাঁধানোর নাগরের’ নাম জানা গেছে, এমন কি বিচার-আচার শেষে সে রায়ের ফয়সালাও হয়ে গেছে।

লোকেরা হতাশ হয়েছিল। তা হতাশ হওয়ার কথাই বটে। দেশে কী এক আইন হয়েছিল – গ্রাম্য সালিশ, ফতোয়া এসব আর চলবে না। কেউ কারো মুরগীর ঠ্যাং ভেঙ্গে দিলে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে সোজা চলে যাও উপজেলা কোর্টে। একখানা মামলা ঠুকে দাও। ব্যাস, এরপর আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। কিন্তু আইন যে আসলে কোন গতিতে চলে তা গাঁয়ের লোক ভালোই জানতো। তাই গোড়ালি জলের মাছ ছাড়া কেউ ফাল দিয়ে উপজেলা সদরে ছুটতো না। ছোট-বড় যে কোন বিবাদের বিচারে চিরকাল সালিশই মানুষের প্রথম ও প্রধান ভরসা। আর এই ভরসাতেই কদিন ধরে খুব তোড়জোড় চলছিল কাজলির ব্যাপারটা নিয়ে। গাঁয়ের মানুষ বড় আশা করেছিল যে বহু দিন পর তারা একটা চোর্ব্য-চুষ্য-লেহ-পেহ বিষয়ে তামাশা দেখতে পাবে। রসাল তামাশার থিকথিকে থকথকে রস চোখ-কান দিয়ে চেটে নিয়ে মুখ দিয়ে উগরে দেয়ার দুরন্ত বাসনায় তারা এতটাই দুর্দম হয়ে উঠেছিল যে তাদেরকে হতোদ্যম করা অসম্ভব হবে ভেবেই কিনা চেয়ারম্যান সাহেব বিচার বসিয়েছিলেন গভীর রাত্রে, গুটিকয় সাগরেদ এবং কাজলি ও তার অভিভাবক নিয়ে। জিজ্ঞাসাবাদে কাজলির মুখ থেকে যে নাম জানা গিয়েছিল সে এমনই একজন যার সাথে কাজলিকে বাকি জীবনের জন্য জুড়ে দেয়ার চিন্তা কোন বোধসম্পন্ন মানুষ করবে না। আর বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সে সময়ের(পল্লীবন্ধুর আমলের) কলেজ পাস শিক্ষিত যুবক। চেয়ারম্যান বাপের অকালমৃত্যুতে জনসহানুভূতির জোরে সে চেয়ারম্যান। কপালের ফেরে চেয়ারম্যানি করতে না হলে সে তদ্দিনে হয়তো শহরে সরকারের কোন বড় দপ্তরে বড় চাকরিই করতো। কাজেই ব্যাভিচারের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে এগারো সন্তানের পিতার সাথে নিকাহ্ পড়িয়ে দেয়া যে কোন কাজের কাজ নয় তা সে চেয়ারম্যান বুঝেছিল।

অতএব, বিচার একটা হয়েছিল। রায়ও। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক চেয়ারম্যান সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙ্গে নীতিতে কুল ও শ্যাম দুই বজায় রাখতে চেয়েছিল। অর্থাৎ কিনা- আইনও অমান্য না হয়, আবার আমজনতার আশার গুড়েও বালি না পড়ে। চেয়ারম্যান জানত আমজনতা কী চায়। কিসে তাদের ভেতরকার আদিমতা অভ্যস্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে একটু উল্লাসনৃত্য করতে পারে। জনমানসের আদিম উল্লাসের রূপ চেয়ারম্যানেরা চেনে। আর তারা এও জানে যে, কোন একটা উপলক্ষ করে সেই ঝিমুতে থাকা দানবটা হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে খানিক দাপাদাপি করে নিতে না পারলে কী ঘটে। তুচ্ছ ব্যাপারে শক্তিক্ষয়ের সুবিধা না পেলে পুঞ্জিভূত শক্তি যে হঠাৎ কোন রূপে আবির্ভূত হয় তা কেউ অগ্রিম অনুমান করতে পারে না। তাই জনতার শক্তিকে নানা উপলক্ষে একটু খেলিয়ে-বাজিয়ে নেয়াটা রাজনীতির ব্যায়াম। এতে করে বাড়তি ক্যালরি ঝরিয়ে জনতা যেমন সুস্থির থাকে, তেমনি রাজনীতিকেরাও মোটাদাগে জনতার সাম্প্রতিক প্রবণতা বুঝতে পেরে পরবর্তী কর্মকৌশলে মনেযোগী হতে পারে। কাজেই ব্যাভিচারের অপরাধে শরীয়া আইন মেনে একশ’ দোররা মারার প্রচলিত বিধান কাজলির বেলাতেও প্রযোজ্য হয়েছিল। কেউ যেনো বলতে না পারে যে, শরীয়ার বরখেলাপ করে চেয়ারম্যান হারাম কাজ করেছে।

শরীয়া রক্ষা হয়েছিল কিনা জানি না তবে কাজলি প্রাণে বেঁচেছিল। আপদমস্তক সাত পরত ছালা জড়ানো মানবদেহ লিকলিকে বেত দিয়ে কষে পেটালেও তো বেতব্যথা অঙ্গে পৌঁছার কথা নয়। বরং বালিয়াডাঙ্গা মসজিদের পেশ ইমাম ষাট বছরী নুরুদ্দিন হুজুরের বাতব্যথাময় অস্থিসন্ধি চল্লিশ র্দোরার পরেই কনকনাতে শুরু করেছিল।

কিন্তু মানুষের মুখের দোররা হুজুরের সুতরো হস্তের তেলপাকা বেত্রের চেয়েও যে বেশি নির্মম, অন্তর্ভেদী! কাজলির মুখের পরে তা পড়তে থাকে দ্বিধাহীন সপাসপ। বয়সের নখরের অগুণতি নির্মম কাটাকুটি যার তোবড়ানো গালে, সেই বয়োবৃদ্ধা হতে শুরু করে টোপাকুলের মতো গালওয়ালী- সবাই কাজলিকে মুখের পরে জিভের সুখ মিটিয়ে করতো গালাগাল। দোররা বস্তুটা যে আসলে কী সেই বোধ হয়নি যে উঠতি কিশোরীর সেও কাজলিকে দেখে হাসি চাপতে দেহ বেঁকে-চুরে এমন ভঙ্গি করত যা দেখে কাজলি বুকে-পিঠে অনুভব করত দশ-বিশ ঘা দোররা। ওদিকে পুরুষমহলে তো কাজলিই তখন প্রথম আলোচ্য। তাদের কল্পলালায় কাজলির অনুপস্থিত দেহ সিক্ত হতে থাকত নিয়ত। এত দিন যারা কাজলির দিকে দ্বিতীয়বার তাকাবার মতো আগ্রহ বোধ করেনি তারাও তখন শুরু করেছিল উঁকি দিতে। অতএব অল্প দিনেই কাজলি পরিণত হয়েছিল- গোটা গাঁয়ের যৌন প্রতীকে।

সন্তান প্রসবের পর সুস্থ বোধ করতে যে কটা দিন, তার পরই কাজলিকে বেরুতে হয়েছিল পেটের ধান্ধায়। বাপ তার তখন বেঁচে, ছিল ভাইও। কিন্তু সম্পদহীন বাপ-ভাই নারীজীবনের বিড়ম্বনা বাড়ানো ছাড়া আর কোন কাজের কাজটাই বা করতে পারে? তাই কাজলিকে পথে বেরুতে হয়েছিল সন্তান বুকে নিয়ে। বুক থেকে কাঁখে, কাঁখ থেকে মাটিতে নেমে সন্তান যখন এক পা-দুই পা হাঁটতে শুরু করল তখন কাজলি তাকে রেখে একাই ধান্ধা করতে শহরে যেতে শুরু করল। আর পৃথিবীর কর্কশ পথে কালাচান ওরফে দুখু একাই শুরু করল হাঁটতে।

হাঁটতে হাঁটতে দুখুও এক সময় পৌঁছে গেল শহরে। মা তাকে শহরে আসতে নিষেধ করলেও শহর তাকে বড় টানতো। তা শহর তো টানেরই স্থান। গ্রামে যা মাথা খুঁড়লেও মেলে না, তাই নাকি শহরের পথে পথে ছড়াছড়ি। গাও-গেরামে যার তার কাছে হাত পাতলেই পয়সা মেলে না, হাতে পয়সা থাকলেও যা মন চায় তা চট করে কিনে খাওয়া চলে না। চলবে কী করে? ধান-পাট-গম-কলাই আর তিল-তিসি-সর্ষে ছাড়া গ্রামে তখন ছিলটাই বা কী? কিন্তু শহরে চিরকালই সব পাওয়া যায়, সব। মা শহর থেকে দুখুর জন্য কত কী কিনে আনে! সেসব জিনিস গ্রামের কয় জন চোখে দেখে? কুড়মুড়ে বিস্কুট, পাঁপরভাজা, লাঠি লজেন্স থেকে শুরু করে আপেল-আঙ্গুর পর্যন্ত আনে মা। সব দিন মা ফিরতে পারে না বাড়ি। হয়তো কোন কোন বার দুই-চারদিনও পেরোয়; তবু তো ফেরে। মা আসবে এই আশায় আশায় দুখুর কত রাত, কত দিন কাটে। দুখু যত বড় হতে থাকে, মায়ের বাড়ি ফিরে আসা ততই কমতে থাকে। শেষে এমনও হয় যে পুরো এক সপ্তাহ কেটে যায় মায়ের দেখা নেই। দুখুর বুকের ভেতরটা যে কেমন করে!

একদিন মা বাড়ি ফেরে খুব মলিন মুখে। সেদিন মায়ের হাতে দুখুর জন্য কোন কাগজের ঠোঙ্গা কি পলিথিনের পুঁটুলি নেই। মায়ের হাতে ঝোলানো চটের ব্যাগটা আঁতিপাতি করে খোঁজার দুর্দম ইচ্ছেটা দুখু দমিয়ে রাখে কারণ মুখ দেখেই বোঝা যায় যে মায়ের মন ভালো নেই। পাটশাক সিদ্ধ আর খুদের জাউ রাঁধতে রাঁধতে নানী আর খালাদের সাথে মায়ের যা কথা হয় তা থেকে দুখু ঘটনা অনেকটাই বুঝে ফেলে। তার মা শহরে কিছু একটা করে যে কাজের নাম সে ঠিক জানে না। তবে কথা শুনে বোঝা যায় যে কাজটা খুব গোপন কিছু যা সবার কাছে বলা যায় না। দুখু শুনতে পাবে বলেই কিনা বড় খালা গলা খাটো করে নানীর কানে বলে, গতরখাগী মাগী ইবার রোগ বাঁধায়ে ফিরছে। 

নানী চুপচাপ পাটশাক ঘুঁটতে থাকে। ওদিকে মাকে দেখা যায় কেমন বিমর্ষ হয়ে মাটির দাওয়ার এককোনায় পা ছড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে। বসার ভঙ্গিটা এমন যা আগে কখনো দুখু দেখেনি।

ছয় মাস পর… … …

দুখু ঢাকার রাজপথে। মা তার হাত ধরে এনে ছেড়ে দিয়েছে মহানগরীর বিশাল উদোম বুকে। যে বুক দেশের তাবৎ অনাথের নাথ হয়ে সকলকে বুক পেতে গ্রহন করতে গররাজি না হলেও মাঝে মধ্যেই নারাজ হয়ে বুক ঝাড়া দিতে দ্বিধা করে না, সেই বুকে এক-দেড় কোটি আদম সন্তানের সমুদ্র মন্থনসম কিলবিলের মধ্যে দুখু এক অদৃশ্য সংযোজন মাত্র।

কারওয়ান বাজারে দুখুর ঠাঁই। ঠিকানাবিহীন সে ঠাঁইয়ে বাস করে দুখুর মা-খালা-নানীর বিশাল পরিবার। আরো তিন খালাত ভাইবোনের সাথে দুখুও তার পেটের ভাতটা যোগাড়ের চেষ্টায় ফেরে। নানী তাদের পষ্ট জানায়, যার যেমন কামাই তার তেমন ভাত। নিজের পেটটা ভরাবার মত ভাত থালায় পেতে দুখুকে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রায় দিনমান, এমন কি রাতেরও প্রথম দুই পহর। রাজধানী বুকে সবচে বড় কাঁচামালের আড়ত কারওয়ান বাজার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় বড় ট্রাক বোঝাই কাঁচামাল এসে উপস্থিত হয়। রাত দশটা-এগারোটার পর সারে সারে ট্রাক ঢোকা শুরু। মনকে মন, টনকে টন মাল নামিয়ে দিয়ে শুন্য ট্রাকেরা ফিরে যায় খালাসের আরাম নিয়ে। জেব ভরা টাকা নিয়ে হাজির হয় পাইকারের দল। ট্রাকভর্তি মাল ডাকে ওঠে। নিমেষে বিক্রয়। চলে সারারাত। ভোর নাগাদ সেসব মাল ঢুকে পড়ে শহরের যত কাঁচাবাজারে। আরেকটু বেলা হলে তো ফেরিঅলারা ভ্যানে বয়ে গিন্নীদের হাতে সরাসরি তুলে দেয় টাটকা-বাসী সব সবজি। তো এই আড়তে সন্ধ্যার পর থেকেই ঘুর ঘুর করে দুখু ও তার ক্ষুদে দল। মধ্যরাতে পাইকারী বাজার জমবার আগে খুচরা বিকিকিনির বাজার যায় গুটিয়ে। দুখুরা এ সময়টায় মাঠে নামে। দোকানগুলো গোটানোর সময় কি ঝুড়ি-ঝাঁকা তুলে নেয়ার কালে দু-চারটে আলু-পটল গড়িয়ে পড়া তো খুব স্বাভাবিক। শুধুই কি আলু-পটল? বেগুন-মুলা-টমেটো কি না গড়াগড়ি খায় এ বাজারে? আর এই বিনে পয়সার আলু-মুলা দুখুদের মত দুঃখীরা হাতড়ে-পাতরে বাগিয়ে নিয়ে মা-খালাদের কোচড়ে ঢেলে তবেই পাতে পায় এক টুকরো বেগুনভাজা কি পাতলা ঝোলে দুই টুকরো আলু।

খুচরা বাজার বন্ধ হতে না হতেই ট্রাকের গর্জন শুরু। পাইকাররা কড়ে আঙ্গুলে লুঙ্গির প্রান্ত তুলে ধরে আসরে নামতে না নামতেই কুলিদের সাঙ্গপাঙ্গ হাজির। দুখুদের অনেকেই এ সময় শুধুই দর্শক। টোকাই বাচ্চাদেরকে ট্র্যাকে তুলতে কোন মহাজনই ভরসা করে না। অধিকাংশ মহাজনের আবার থাকে বাঁধা কুলি। মোটামুটি বিশ^স্ত কুলির দল মাল নামায়। প্রথমদিকে দুখু কিছুক্ষণ বেকার এসব চেয়ে দেখতো। এখন আর সে সময় নষ্ট করে না। তার বড় খালাত ভাইয়েরা মাল নামানোর কাজে হাত লাগানোর অনুমতির আশায় মহাজনদের চ্যালাদের পিছে ঘুর ঘুর করে। দুখু ঘরে ফিরে ভাতের আশায় নানীর কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে। রাত গভীর হলে দুখুর নানী ভাত চড়ায়। সারাদিন ছানাপোনা যে যার মত চরে খাও, সন্ধ্যার পর সারাদিনের রোজগার নানীর হাতে তুলে দাও। সবার কামাই হাতে পাওয়ার পর রোজগার অনুযায়ী নানী করে রাতের বাজার। বাজার সেরে রান্নার যোগাড় করে আলোক চুলোয় লাকড়ি ধরিয়ে রান্না সারতে সারতে রাতের বয়স বাড়ে। দুখুরা এ সময় চুলোর পাড়ে অধীরভাবে অপেক্ষা করে থাকে। চুলো থেকে ভাত-তরকারি নামতে না নামতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ সময় নানীর কঠোর তত্ত্বাবধানে শুরু হয় বন্টন। যার যার বাসনে আয় অনুপাতে ভাগ বুঝে নাও, কেউ কারোটা কেড়ে নিও না, হল্লাচিল্লা কম কর- দুখুর নানীর দক্ষ ব্যবস্থাপনা।

খাওয়া-দাওয়া সেরে দুখু ঘুমায়। যে রাতে ভরপেট খায় সে রাতে ঘুমটা বড় জমে। ট্রাকের গর্জন, আড়ৎদারদের ডাকাডাকি, কুলি-টোকাইয়ের চিল্লচিল্লি কিছুই দুখুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। কিন্তু শান্তিমত ঘুবাবারই কি জো আছে? ভোরবেলা দুখুর খালাত ভাইয়েরা ফিরে এসে কান ধরে টেনে তোলে- লবাবের ছাওয়াল লবাব, বালিশ মাথায় দে ভারি আরামের ঘোম ঘুমাইচ্ছো, না? কেউ একজন একটানে তার মাথার তলা থেকে বালিশ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে পায়ের এক ধাক্কায় সরিয়ে জায়গা করে শুয়ে পড়ে। দুখুর ঘুম চটে যায়, তবে তা সামান্য ক্ষণের জন্য। ফের ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়ার কালে সে শুনতে পায় খালার গজরানি- মাগী উদিক সারারাত পারকে পারকে মাঙে বেড়ায়, মাগীর বিয়ানো জাইরো হারামি সারা দিন-নাত্তির ঘুমায় কাটায়। ঘুমের গাঢ় টান দুখুর মজ্জা ধরে না টানলে দুখু এ সময় খালার মুখে ঠিক ছুঁড়ে মারতো একখান আধলা ইট। এরপর দুখুর ঘুম ভাঙ্গে নানীর ডাকাডাকি আর ছোট খালাত ভাইগুলানের ঠেলা-ধাক্কাতে। খালারা তখন যে যার কাজে মহানগরের বিশাল শ্রমধারায় মিলিয়ে গেছে।

বেলা দশটা বাজতে না বাজতেই তাড়া দেয় নানী । বয়সে বছর পাঁচেকের বড় খালাত ভাই গলায় ঝুলায়ে দেয় এলুমিনিয়ামের ইয়া বড় এক চ্যাপ্টা গামলা। গামলা ভরা থাকে শশা ও আমড়ায়। প্রচ- গরমে ওষ্ঠাগত চলন্ত মানুষদের হাতে ছিলা-কাটা, ঝাল-নুন ছিটানো শশা বা আমড়াগুলো গছিয়ে দিতে সে প্রাণান্ত হয়। তার চেয়ে বয়সে ছোট খালাত বোন ফুলি-দুলি-সোনিয়া বাসি ফুলের মালা হাতে বড়লোকদের গাড়িতে গাড়িতে উঁকি দেয়। বড়লোকেরা মালা না কিনলেও ফুলের দিকে তাকিয়ে ফুলি-দুলিদের হাতে দুই-পাঁচ টাকা ধরে দেয়। কিন্তু দুখুর আমড়া না খেয়ে কেউ তো দুখুরে এক টাকাও দেয় না। এ দিকে দুখুর শরীর আর চলতে না চায়। গলায় ঝুলানো গামলার ভর তাকে টানতে থাকে মাটির দিকে। আর দুরন্ত ক্ষুধারাক্ষস তার পেটে প্রথমে হামাগুড়ি পরে ডিগবাজি খেতে শুরু করলে সে গামলাটা গলা থেকে নামিয়ে পার্ক বা ফুটপাতে বসে কচকচিয়ে খেয়ে নেয় অবিক্রিত শশা বা আমড়া। এভাবে সারাদিনে যা উপার্জন হয় সন্ধ্যায় তা তুলে দেয় নানীর হাতে। দুখুর যা কামাই তা দিয়ে এক সন্ধ্যা পেটপুরে খাওয়া নাকি হয় না- নানীর ভাষণ ও খাবার বন্টন থেকে তা জানা যায়।

দুখুর মা সারারাতই কাটায় কোথায় কোথায়। সকালে যখন সে ঠাঁইয়ে ফেরে তখন থাকে বড় ক্লান্ত। ঘুম জড়ানো চোখেও সে ঠিক হনহনিয়ে হেঁটে আসে। তারপর চাটাইয়ে শুয়ে দেয় এক ঘুম। সে ঘুম এমন যে জেগে ওঠা শহরের তর্জন-গর্জন-আহ্বান-আকর্ষণ কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। এভাবে ঘন্টাকয়েক কাটিয়ে দুপুর নাগাদ সে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। রান্না করা কিছু পেলে গপগপিয়ে খায়। না পেলে আঁচলের গিঁট খুলে বের করে তার গত রাতের আয়-উপার্জন। বড় খালা এ সময় তার দিকে ঠারেঠারে তাকায়, দেখতে চেষ্টা করে টাকার পরিমান। দুখুর মাকে বড়খালা বেশ ভয় করে। এমন কি ভয় করে নানীও। মা কাছাকাছি থাকলে দুখুর সাথে কেউ তেমন খারাপ ব্যবহার করে না। বিকাল ঘনালে মা কোত্থেকে যেন গোছল করে ধোয়া কাপড় পরে পরিষ্কার চেহারা করে আসে। এসময় তার গা থেকে ভুরভুর করে বের হয় লাক্স সাবানের টাটকা গন্ধ। দুখু এ সময়টা মায়ের কাছাকাছি কাটাতে চায়। মন চায় মা এ সময় তাকে একটু কাছে বসিয়ে গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে কিছু একটা খেতে দিক। সেই কোন সকাল দশটা-এগারোটায় আধথাল খিচুড়ি পেটে ঢুকেছিল, তারপর দুয়েকটা অবেচা শসা কি আমড়া; তাতে কি দুখুর পেট ভরে? তা মন-মেজাজ ভালো থাকলে মা দুখুর মন পড়তে পারে। মুখে স্নো ঘষতে ঘষতে দুখুকে কাছে ডেকে হাতে ধরিয়ে দেয় গোটা দশটা টাকা। কিন্তু যেদিন মা অন্য মেজাজে থাকে, মানে যেদিন দুখুর মা-খালা বা মা-নানীতে কাইজা লাগে সেদিন দুখুর কপালেও খারাবি। অন্য সময় দুখুকে কেউ বেজন্মা বলে গাল দিলে মা তার পেটের নাড়ি পিছনদ্বার দিয়ে বের করে আনে, কিন্তু এসব দিনে মাই দুখুরে গালায়, ‘এই হারামি, এই জাইরোর ছাও জাইরো…..’। খালা-নানী মিলে প্রায় দিনই মায়ের কানে বিষ লাগায়- দুখুর নিন্দা-মন্দ সাতকাহন করে বলে। দুখু যে কতটা আলসে আর বদমায়েশ, দৃষ্টান্তযোগে তার ফিরিস্তি শুনে আর তার রাক্ষুসে খাই খাই স্বভাবের বর্ণনায় তেতে উঠে মা যদি তাকে ধরে আচ্ছাসে পিটিয়ে দেয় তবে সেদিনের মতো ব্যাপারটা ওখানে যায় থেমে। কিন্তু যেদিন মা দুখুকে ধরতে ব্যর্থ হয় কিংবা তার পক্ষ নিয়ে বসে, সেদিন ঘটে যত বিপত্তি। মা-খালা-নানীর চিলচিৎকার অগণিত গাড়ির গর্জন আর রিক্সার ক্রিং ক্রিংকেও ছাপিয়ে ওঠে। ভীত-বিমর্ষ দুখু মায়ের নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে- আজকের ঝড়টা কখন কার মাথায় বাজ ফেলে থামবে। হয়ত শেষে মা খালারে ধরে কিলাবে কিংবা খালা মায়েরে। নানী-মায়ের মাঝে চুলোচুলি হওয়াটাও বিচিত্র না। দুখু জানে এমন সময় গ্রামে থাকলে ঝগড়া দেখতে ও থামাতে উঠোনে ভীড় জমে যেতো। কিন্তু রাজধানীর বুকে মানুষের কাজ এত বেশি যে অকাজে এক মিনিট নষ্ট করার মতো সময় কোনো নুলো ভিক্ষুকেরও নেই। কাজেই মা-খালা-নানী এক সময় অবসন্ন হয়ে নিজেরাই ক্ষান্ত দেয়। দুখু স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।

এরপর সময় তার আপন নিয়মে গড়িয়ে সন্ধ্যায় নামে। পৃথিবীর আর সব প্রান্তের মতো মহানগরীর নাগরিক সন্ধ্যাও এক রাশ বিষণœতা নিয়ে হাজির হয়। ঘরে ফেরার তাড়ায় যে সকল মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি তাদের মনে হয়তো সে বিষণœতা তেমন পাত্তা পায় না কিন্তু তা ভর করে দুখুর মতো আলসে প্রকৃতির কোন শিশুর মনে, যে তার সমবয়সীদের সাথে খেলতে পছন্দ করে না, আপন মনে চেয়ে চেয়ে দুনিয়াদারি দেখতে ভালোবাসে এবং যাকে কি সকাল কি সন্ধ্যে- সব সময়ই পেটের ধান্ধায় ফিরতে হয়।

এক সন্ধ্যায়……..

দুখুর খালাত ভাই গামা কোত্থেকে যেন রাজ্য জয় করার ভঙ্গিতে ফিরে এসে ছোট বোনটাকে ডেকে তার হাতে ধরিয়ে দেয় কী একটা প্যাকেট। ছোট বোনটা এক মুহূর্ত থমকে থেকে চোখ বড় করে ভায়ের মুখে চেয়ে একটা অতিখুশি ও কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়েই ছুট লাগায়। না, ওকে আর ধরতে পারে না ওর ছোটরা। কারওয়ান বাজার পেরিয়ে মহানগরীর কোন চিপা গলিতে ঢুকে যে সে হাঁপাতে হাঁপাতে প্যাকেট খুলে সব গপগপিয়ে সাবাড় করবে সে ঠিকানা জানে না সে নিজেও।

গামা এবার নানীর হাতে কিছু টাকা দেয়। নানীর খুশি-অখুশি চেহারায় চট করে ধরা পড়ে না। তবু টাকাগুলো আঁচলের খুঁটে বাঁধবার ধরণ দেখে মনে হয় যেন খুশিই হয়েছে নানী। হঠাৎ গামার চোখ পড়ে দুখুর বিমর্ষ মুখে। চোখ-মুখ কুঁচকে দুখুর উদ্দেশ্যে সে বুঝি খারাপ কিছুই বলতো, কিন্তু কী একটা মনে পড়ায় সামলে নিয়ে দুখুর দিকে চেয়ে হাসে।

‘কী রে মুর্গা, কুইচ্চে মুর্গীর মতন বসে বসে ঝিমাস ক্যা রে?’ দুখুর মাথায় একটা চাটি মেরে গামা দুখুর পাশেই বসে পড়ে। তারপর গলা নামিয়ে বলে, বিরেনি খাবি? দুখু চমকে তাকায় গামার মুখে। দুখুর লোভ চকচক চোখের দিকে তাকিয়ে গামা বলে, আজকে সোনিয়ারে আইনে দিলাম। কালকে তোরে দেব। মেজবানির আঁইটে বিরেনি না, হোটেলে রান্ধা ড্যাগের বিরেনি। ফুল প্যাগেট। গরম গরম। খালি একখান কাম…… । কী কাম? প্রবল আগ্রহে দুখু উঠে দাঁড়ায় প্রায়। গামা তাকে থামিয়ে দেয়, ‘আরে থাম, এহন না। কাইল।’ হতাশ দুখু মলিন মুখে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে পড়ে।

এ রাতে দুখুর ভালো করে ঘুম হয় না। কোত্থেকে যেন বিরানির খুশবাই এসে তার নাকে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। আর সেই সাথে হোটেলের ডেকভর্তি বিরানির ছবি কেবলই তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। গামা তাকে কাজের কথা বলেনি। কিন্তু যে কাজই হোক সে তা করতে রাজী। কয়েকদিন হয় মার মন-মেজাজ ভালো না। দেশ জুড়ে আন্দোলন না কী হচ্ছে- রাস্তায় মিছিল, পুলিশ, ব্যারিকেড লেগেই আছে। ঘন ঘন হরতালে শহরের ছবি বেশ পাল্টে গেছে। মানুষজন দরকারি কাজ সেরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরছে। কারওয়ান বাজারের কাঁচামালের কারবারে লেগেছে ভাটা। দূরদূরান্ত থেকে কাঁচামাল বয়ে আসা ট্রাকের সংখ্যা নেমেছে অর্ধেকে। কাঁচা তরকারির দামে আগুন। দোকানদাররা এখন আর আধপচা আলু-বেগুন ফেলে দেয় না। এক শ্রেণীর ক্রেতারা কম দামে ওগুলো কেনে। এমন মন্দার বাজারে নিশ্চয় মার কামাই-রোজগার খুব কমে গেছে। আর দুখুর তো রোজগারপাতি প্রায় কিছুই নেই। রাস্তায় গাড়িই চলে না- শসা খাবে কে? কিন্তু গামা ভাইয়ের রোজগার মনে হয় এ কয় দিনে বেশ বাড়ছে। কী করে গামা ভাই অত টাকা আনে, আর কী করেই বা বিরানির প্যাকেট পায়? দুখুও কাল তাই করবে।

পরদিন……….

কাক ভোরে দুখুর ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়ে গামা ভাইয়ের কথা। আর গামা ভাইয়ের কথা মানেই এখন তার চোখে ফুল প্যাকেট বিরানির ছবি। এমন নয় যে দুখু কোনদিন বিরানি খায় নি। মা তার জন্য আগে মাঝে মাঝেই নানা পদের খাবার কিনে আনতো। আঁচলের আড়ালে প্যাকেট লুকিয়ে এনে দুখুকে চোখের ইশারায় ডেকে দূরে কোথাও বসিয়ে খাওয়াতো। খালাতো ভাইবোনদের লোলুপ দৃষ্টির আড়ালে বসে ভালো ভালো খাবার খেতে দুখুর কী যে ভালো লাগতো! কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মার কামাই-রোজগার যে ভালো যাচ্ছে না তার প্রমান- আগের মতো মা তার শুকনো মুখ দেখে হাতে দশ-বিশ টাকা গুঁজে দেয় না। আর আঁচলের আড়ালে প্যাকেট লুকিয়ে আনার কথা তো মা বুঝি ভুলেই গেছে। টাকা নিয়ে মা আর নানীর ইদানীং প্রায়ই বচসা হচ্ছে। এমন দুর্দিনে গামা ভাই দুখুর চোখের সামনে ফুল প্যাকেট বিরানি এমন অদৃশ্য মায়া শিকায় ঝুলিয়ে দিল!

সারারাত বাজার ঘেঁটে ক্লান্ত গামা শেষ রাতে ঘরে ফিরেছে। বেলা বেশ একটু না চড়লে তার ঘুম ভাঙ্গার কথা নয়। কিন্তু দুখুর কি আর তর সয়! গামার হাতে চড় খাওয়ার সম্ভাবনা জেনেও দুখু তাকে ডাকে। না, গামা তাকে আজ মারে না। বরং আড়মোড়া ভেঙ্গে লাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, কয়ডা বাজে রে?

কী জানি! নয়ডা-দশটা হবি মনে অয়। 

কইস কী!! গামা তড়াক করে উঠে বসে ঝাঁপ তোলা দরজার বাইরে দৃষ্টি চালান করে। তারপরই তার মুখে খানিকটা বিরক্তি ফোটে। বালিশটাকে বুকের তলে চেপে ফের শুয়ে সে বলে, শালা নেইল, বিরেনির লোভে সাতসহালে আমার ঘোম ভাঙ্গায়। মারব এক লাত্থি। যা শালা। বাজারে যাইয়ে ঘড়ি দেখ। আটটা বাজলি তয় আমারে ডাক দিবি। তার এক মিনিট আগেও না।

মলিন মুখে দুখু ঝুপড়ির বাইরে গিয়ে বসে থাকে।

তবে এর কিছু পরেই গামা বেরিয়ে আসে। দুখুর মাথায় টোকা মেরে বলে, যা, রেডি হ। হাফ প্যান ছাইড়ে এট্টা ফুল প্যান পিন্দে আয়।

আহ্লাদে আটখানা দুখু দুই মিনিটেই প্রায় ফুলবাবুটি হয়ে তৈরি। তার লাল শার্ট আর চুলে সিঁথির বাহার দেখে গামা রসিকতা করে, কী রে ছুঁছো, ডেটিংয়ে যাইতাছিস মুনে লয়? মেজাজ ভালো থাকলে গামা ঢাকাইয়া টানে কথা কয়। দুখু তাই জবাবে একটু লাজুক হাসে।

মিছিলটা শুরু হয় পল্টন মোড় থেকে।

সামনে ফিনফিনে পাঞ্জাবী, হাতকাটা কালো কোট, চোখে সানগ্লাসঅলা মানুষেরা নাকি নেতা। ওদের মাঝে দুখুর মা-খালাদের বয়সী দুজন মেয়েমানুষ। মিছিল শুরুর আগে তারা বক্তৃতা করে। বাপরে! মেয়েমানুষগুলোর গলায় কী জোর! তারা নাকি স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র আনবেই আনবে। ‘স্বৈরাচার’, ‘গণতন্ত্র’- দুখুর কানে শব্দগুলো কেমন অচেনা ঠেকে। গামাকে প্রশ্ন করলে সে অভ্যাসমতো দুখুর মাথায় চাটি মেরে বলে, শালা তোর অত কতায় কী কাম? বিরেনি খাতি আইছিস, মিছিল শ্যাষ হলি পর বিরেনি দিবি, সেই আশায় খাড়ায় থাক। যহন মিছিল শুরু হবি, মানে সামনের নেতারা হাঁটা দিবি, তহন তুইও ওগের পিছন পিছন হাঁটা ধরবি। ওরা যেদিক যাবি, তুইও সেদিক যাবি। ওরা যহন থাইমে গাড়িতি উঠে বাড়ি যাবি, তুই তহন বিরেনির প্যাকেট নিতি লাইনে খাড়াবি। এট্টু সামনের দিক খাড়াইস, যাতে প্যাকেট পাইস। বেশি পিছনে পড়লি কলাম কপালে নাও জুটতি পারে। শালার মিছিল শ্যাষে কহানেত্থে এত টোহাই পুলাপান আইসে জোটে, পেরাইই প্যাকেট শট পড়ে।

মিছিল এগিয়ে চলে। 

মিছিলের আগে পিছে অনেক পুলিশ। মাথায় হেলমেট, হাতে ঢাল, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর বন্দুক-পিস্তলে সজ্জিত দাঙ্গাপুলিশের দল দেখে দুখু অবাক হয়। এরকম পুলিশ এর আগে তার চোখে পড়েনি।

দুখুরা হাঁটতে থাকে। নেতারা অনেক দূর এগিয়ে যায়। বড় নেতাদের পিছনে সুন্দর প্যান্ট-শার্ট-পাঞ্জাবি পরা কত নেতা-উপনেতা-পাতিনেতা-ছাত্রনেতা-শ্রমিকনেতা! গামা তাকে বলে, একদিন তোর এই গামা ভাই দেখবি নেতা হবি। পেরথম ছরমিক নেতা। তারপর কপালে থাকলি এমনি নেতা, মানে সগলের নেতা। কিরে, কতা কইস না ক্যা? তোর কি মনে অয়, আমি চাটাম দিচ্ছি? দ্যাশে গণতন্তর পরতিষ্ঠিত হলি দেখবি আমরা নেতা হবার পারমো।

আমরা! মানে দুখুও কি নেতা হবি নাকি? ধুর! নেতা কিভাবে হতে হয় তার কিছু কি দুখু জানে? ওসব গামা ভাই হবি। দুখু খালি গামা ভাইর সাথে থাকবি আর বিরেনি খাবি। ভরপেট বিরানি পেলে দুখু আর তো কিছু চায় না।

প্রেসক্লাব পার হয়ে মিছিল মৎস্য ভবনও অতিক্রম করে। এমন সময়……

কোত্থেকে যে কী হয় দুখু তার কিছুই ধরতে পারে না। পটপট, দুড়–ম-দাড়াম কিছু শব্দ, মিছিলের মানুষদের উদভ্রান্ত দৌড়াদৌড়ি। কে যেন বলে, পালা, শালারা গুলি করতেছে, পালা। বেদিশা দুখু কোনদিকে পালাবে তা বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে গামা ভাইকে খুঁজতে থাকে। এই তো গামা ভাই তার পাশেই ছিল। এক মুহূর্তে কোথায় গেল? হঠাৎ কার ধাক্কায় দুখু মুখ থুবড়ে পড়ে। পিছঢালা কঠিন রাজপথে দুখুর নাক বুঝি থেতলেই যায়। উঠতে চেষ্টা করে দুখু। এটুকু বুঝতে পারে যে তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে, তারপর ছুটতে হবে। প্রাণপন চেষ্টায় দুখু একসময় উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু কী এক ধোঁয়া লেগে তার চোখে এমনই অশ্রু গড়াতে থাকে যে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে আলোর ঢলে ঝলমল মহানগরীতে নিকষ আঁধার ছাড়া সে আর কিছু দেখতে সক্ষম হয় না। এখন কোনদিকে যাবে দুখু? কোথায় পালাবে? এমন সময় তীক্ষè-গরম কী যেন তার পেটের ভিতর ঢুকে বুঝি পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। নাকি বেরিয়ে যায় না? কেবল দুখুর বিরানি লোভাতুর পেটটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে তাকে শুইয়ে দেয়? একবার দুখু হাত দিয়ে পেটটা চেপে ধরে। কলকল করে বেরিয়ে আসা লহুর ধারার উষ্ণতা দুখু টের পায় কি পায় না। তারপরই হাত দুটো আকাশ পানে উঁচিয়ে বাতাসে কী যেন ধরতে নাকি তাড়াতে চেষ্টা করে। 

আকাশে তখন দিকভ্রান্ত-উড়ন্ত কাক আর বাতাসে তাদের ভয়ার্ত কা-কা এবং দূরে কোথায় সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ ছাড়া অন্য কোন শব্দ ছিল না।

মন্তব্য: