মাগুরার কৃতি সন্তান পণ্ডিত প্রবর শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য সিদ্ধপুরুষ লোকনাথ গোস্বামীর জন্মকথা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

অনিল দে-মনি

অতি প্রাচীন যুগ হতে বৃন্দাবন বিশাল অরণ্যই ছিল, সেখানে মুনীদিগের তপোবন হয়েছিল। বৃন্দাবন ব্রজমণ্ডল বা পুরাতন শূরসেন রাজ্যের অন্তর্গত। মধূদৈত্যের নির্ম্মিত মধুপুরীই পরবর্তী নাম হয় মথুরা। শূরসেন বংশীয় যাদবগণ ছিলেন মথুরার অধিবাসী। সেই যাদবকুলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়। শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে মধুর লীলা প্রকটিত হওয়ায় পূর্ণতীর্থে পরিণত হয়। 

অর্জ্জুন পৌত্র মহারাজ পরীক্ষীত যখন ইন্দ্রপ্রস্থের সম্রাট তখন তিনি শ্রী কৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভকে ব্রজমন্ডলের রাজাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। বজ্রনাভই প্রপিতামহের স্মৃতিপূজার জন্য ও মদনমোহন, ওঁ গোবিন্দ প্রভৃতি শ্রী বিগ্রহের সৃষ্টি ও সেবা আরম্ভ করেন। কালক্রমে শতাব্দীর পর শতাব্দী নানা প্রাকৃতিক ও দেশী বিপ্লবে হিন্দু বৌদ্ধের কলহ ও পরে বৈদেশিক শক ও মুসলমানের আক্রমনে ক্রমে ব্রজভূমি পুনরায় গহন কাননে পরিণত হয়। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে উহার পুনরুদ্ধার সাধিত হয় এবং তাহা সাধন করেছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর শিষ্য ও ভক্তবর্গ। তন্মধ্যে অগ্রদূত ছিলেন প্রসিদ্ধ পন্ডিত মাগুরা জেলার কৃতি সন্তান লোকনাথ গোস্বামী। 

কান্যকুঞ্জ হতে আগত পঞ্চব্রাহ্মনের অন্যতম শ্রীহর্ষ ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্রীয়। তাহার অধস্তন ১২শ পুরুষ উৎসাহ মহারাজ বল্লালসেনের সভায় এবং উৎসাহের পুত্র আহিত লক্ষণ সেনের রাজসভায় প্রকৃষ্ট কুলমর্যাদা পান। আহিতের পৌত্র শিয়ো বা শিরোভ‚ষণের তিন পুত্র ছিলেন যথাক্রমে নৃসিংহ, রাম ও দ্যাকর বা দিবাকর। ফুলের মুখটি কবি কৃত্তিবাস উক্ত নৃসিংহের বৃদ্ধ প্রপৌত্র । তৎ প্রণীত রামায়ণের আত্মবিবরণ হতে জানা যায় পূর্ববঙ্গে বিপ্লব বা মুসলমান আক্রমণের জন্য (আনুমানিক ১৩১০ খ্রীষ্টাব্দে ) নৃসিংহ পূর্ববঙ্গ হতে নদীয়া জেলার শন্তিপুর থানার গঙ্গা তীরবর্ত্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। মধ্যম ভ্রাতা রাম ও সেখানে ছিলেন কালক্রমে গংগাতীরবর্তী এলাকার নাম হয় কবি কৃত্তিবাসের নাম অনুসারে নতুন নামকরণ হয় ‘কৃত্তিবাস’ তবে এই অঞ্চলটি ফুলিয়া নামে খ্যাত। পরে তাহার বংশধরগণ কেউ কেউ বৃহত্তর যশোরের কোথাও কোথাও বসবাস শুরু করেন। 

রামের বংশধরগণ কতক পীরালী দোষযুক্ত হয়ে যশোরের চেঙ্গুটিয়া বসবাস শুরু করে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্যাকর বা দিবাকর গঙ্গাতীরে কাঞ্চনপল্লী বা কাচ্না গ্রামে বসতি গড়েন। ঐজন্য তার অধস্তন বংশীয়রা কাচনার মুখটি দ্যাকরের সন্তান নামে পরিচিত। 

দ্যাকরের পুত্র “ধর্ম” বৃহত্তম যশোর জেলার নড়াইল মহাকুমার (বর্তমান জেলা) অন্তর্গত চিত্রা নদীর তীরবর্তী তালেশ্বর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ধর্মের পরবর্তী তিন পুরুষ এ স্থানে বাস করে। তালেশ্বর গ্রামে যে মধ্যপাড়ায় তাহাদের বাস ছিল। তাহা এখন মাঝপাড়া নামে খ্যাত। 

তথায় দ্যাকরের সন্তান বা ধর্মের বংশধরেরা এখনও মাঝপাড়ার “ভট্টাচার্য্য” নামে খ্যাত ও সম্মানিত। 

ধর্মের পুত্র পুরষোত্তম তৎপুত্র জগন্নাথ ঘটক, তৎপুত্র গোবিন্দ তালেশ্বর বাস করতেন। গোবিন্দের পুত্র “পদ্মনাভ চক্রবর্তী: শিক্ষা লাভের জন্য শান্তি পুরে গিয়ে মহাপণ্ডিত ইতিহাস বিখ্যাত শ্রী অদ্বৈতাচার্য্যরে কৃপা লাভ করেন এবং সাধারণ শাস্ত্রের সঙ্গে ভক্তি শাস্ত্রে অধিকার লাভ করেন। তিনি শ্রী অদ্বৈতাচার্য্যরে মন্ত্রশিষ্য হন। 

সম্ভবত সেই সময়েই তার গুরুদত্ত নাম থেকে পরমানন্দ নাম হয়েছিল। 

শ্রী অদ্বৈতাচার্য্যরে জন্ম হয় ১৪৩৪ খৃঃঅব্দে, পদ্মনাভ বয়সে তাহার ৫/৬ বৎসরের কনিষ্ঠ সুতরাং জন্ম ১৪৪০ খ্রী অব্দ ধরা যায়। 

পদ্মনাভ যখন শান্তিপুরে শিক্ষার্থী তখন তার পিতৃবাসের সন্নিকটে পীরালিদের অত্যাচার আরম্ভ হয়। এইজন্য পদ্মনাভ পাঠ শেষ করার পর তালেশ্বরে বাস করতে সাহসী না হয়ে বর্তমান জেলা মাগুরার শালিখা থানার অন্তর্গত তালখড়ি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং চতুষাপাঠী (বিদ্যালয়) খোলেন।

পদ্মনাভ মাঝে মাঝে শান্তিপুর ও নবদ্বীপে ভক্তিচর্চায় যেতেন এবং শ্রী চৈতন্যদেব অর্থাৎ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভ‚র জন্মের বহুপূর্বে অদ্বৈতাচার্যের প্রচারিত ভক্তিভাব লহরী হরির নাম এ দেশে প্রচার ও বিতরণ করতেন। 

পদ্মনাভ মাঝে মাঝে গুরুগৃহে সস্ত্রীক যেতেন। নিজ পত্নীর নাম ও গুরুপত্নীর নাম একই সীতা নাম ছিল তাই উভয় সীতাদেবীর মাঝে গড়ে উঠে মৈত্রীর ভাব ও সম্প্রীতি। উভয়েই ভক্তিমতী নারী। এই পদ্মনাভ ও সীতাদেবী দম্পতির চারপুত্র হয় ভবনাথ, প্রগলব বা পূর্ণানন্দ, লোকনাথ ও রঘুনাথ তৃতীয় পুত্র লোকনাথ চক্রবর্তী চৈতন্যযুগে সর্ব্বপ্রথম বৃন্দাবনে গিয়ে তীর্থোদ্ধারের কার্য্য আরম্ভ করেন এবং কালে লোকপাবণ- লোকনাথ গোস্বামী নামে গোড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরু বিবেচিত হন। আনুমানিক ১৪৮৩/৮৪ অব্দে তালখড়ি গ্রামে লোকনাথ গোস্বামীর জন্ম হয়। বয়সে তিনি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু থেকে ২/৩ বৎসরের বড় ছিলেন। 

পণ্ডিত পদ্মনাভ তার প্রতিভাসম্পন্ন পুত্র লোকনাথকে অল্প বয়সে বিদ্যা শিক্ষার জন্য নিজগুরু শ্রী অদ্বৈতাচার্য্যরে নিকট শান্তিপুরে পাঠান এবং কৃষ্ণলীলামৃত শ্রীমদ্ভগবত শিক্ষা রপ্ত করতে আদেশ করেন। লোকনাথকে আচার্য্য অদ্বৈতাচার্য্য শিষ্যরুপে গ্রহণ করেন। লোকনাথ ও গদাধর পণ্ডিতের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকা সময়ে সতীর্থ শিক্ষার্থী হিসাবে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে পান। ক্রমে ক্রমে লোকনাথের মাঝে কৃষ্ণভক্তি রসের উদয় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে শ্রী অদ্বেত্য প্রকৃত তথ্যানুসন্ধান শিক্ষার জন্য শ্রী গৌরাঙ্গের হাতে লোকনাথকে সমর্পণ করেন। লোকনাথ ক্রমে সকল শাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্বের অধিকারী হয়ে অবশেষে বৈরাগ্য  তাহার হৃদয় অধিকার করে এমনক্ষণে লোকনাথ শান্তিপুর ত্যাগ করে তালখড়ি গ্রামে চলে এসে শাস্ত্র চর্চা শুরু করেন। কিছুদিন পর স্বয়ং শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তালখড়ি গ্রামে এসে উপস্থিত হলে নিকটবর্তী বহু পণ্ডিত পদ্মনাভের বাড়ীতে সমবেত হয়ে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সঙ্গে জ্ঞান তর্ক যুদ্ধে লিপ্ত হন অবশেষে শ্রী গৌরাঙ্গ জয়ী হন, এবং পূর্ববঙ্গে বৈষ্ণব মতের ঐক্যধারা প্রচারিত হতে থাকে। এরপর শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু লোকনাথকে তালখড়ি গ্রামে রেখে নবদ্বীপ চলে যাবার অল্প কিছুদিন পর পণ্ডিত পদ্মনাভ ও সীতাদেবীর কালপ্রাপ্তি হয়। লোকনাথ অবিবাহিত হওয়ায় একদিন “কৃষ্ণ কৃষ্ণ” বলে গৃহত্যাগ করেন। এবং শ্রী গৌরাঙ্গের সহিত নবদ্বীপে এসে ভাবাবেসে বৃন্দাবন লীলারসে আত্মহারা হন। কিন্তু তখনও লোকনাথ কর্ম সন্ন্যাস হয়েও প্রকৃত সন্ন্যাস গ্রহন করেন নি। এই সময় শ্রী গৌরাঙ্গদেব বৃন্দাবন তীর্থ উদ্ধারের জন্য লোকনাথকে আজ্ঞা দেন। লোকনাথ সমরক্ষেত্রে সৈনিকের ন্যায় সে আদেশ প্রতিপালন করেন সঙ্গে ভ‚গর্ভ  গোস্বামী নামক একজন ভক্তকে সাথে করে বৃন্দাবন যাত্রা করে আর কোন দিন দেশে ফিরে আসেন নি।

অপরিমিত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও নিজে আতœপ্রকাশ না করে প্রভূর আদেশ পালন করেন। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ দাস কবিরাজ গোস্বামীর শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ রচনার কালে সকল ভক্ত পন্ডিত ও গোস্বামী প্রভ‚দিগের অনুমতি প্রার্থনা করেন। তখন লোকনাথ আশীষ দান করলেও কিন্তু তার কথা গ্রন্থে না রাখার কথা বলেন। লোকনাথ ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ জ্ঞানী কিন্তু গ্রন্থকার চৈতন্য চরিতামৃত অপূর্ণ হবার ভয়ে লোকনাথ প্রসঙ্গ গোস্বামী কবিরাজ লোকনাথের বৃত্তান্ত প্রকাশ করেন সেই বৃত্তান্ত প্রকাশের মাধ্যম থেকে লোকনাথ গোস্বামীর সাথে সাধারণের পরিচয় ঘটে। 

মহাপ্রভ‚র আদেশ মতে, বৃন্দাবনের বনে বনে ঘুরে তিন শতাধিক তীর্থের আবিষ্কার ও প্রচার করে অবশেষে নির্জন কুঞ্জ কুটীরে কঠোর সাধনা করতেন এবং লোক চক্ষুর আড়ালে থাকতেন । তিনি কাউকেও শিষ্য করতেন না। তা সত্ত্বেও তাহার পরাজয় ঘটে শিষ্যের একান্ত ভক্তির শক্তিতে। 

রাজশাহী জেলার জমিদার পুত্র “নরোত্তম দত্তঃ বিপুল ধন সম্পদ পরিত্যাগ করে গৃহত্যাগী হয়ে বৃন্দাবন গিয়ে লোকনাথের রূপ ও প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়ে লোকনাথকে গুরুরূপে মনে মনে গ্রহণ করেন। এবং তার চরণে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন কিন্তু লোকনাথও শিষ্য করবেন না প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারপরও লোকনাথ ভক্তিরসের কাছে পরাজিত হয়ে নরোত্তম দত্তকে শিষ্যরূপে গ্রহন করেন। পরবর্তী কালে নরোত্তম দত্ত থেকে “ শ্রী ঠাকুর নরোত্তম দাস নামে দেশ বিখ্যাত হন। নরোত্তম ঠাকুরের অপূর্ব ভাবমিশ্রিত কীর্ত্তনের দ্বারা উত্তরবঙ্গ ও আসামে বৈষ্ণব ভক্তিরস প্রচারিত হয়। ঠাকুর নরোত্তম দাসের জন্ম স্থান রাজশাহীর “খৈতুর তীর্থ” নামে বিখ্যাত।একমাত্র শিষ্য রেখে মহাপন্ডিত বৃন্দাবনে দেহ রাখেন। এই লোকনাথ গোস্বামী বাংলাদেশের মাগুরা জেলার কৃতি সন্তান মাগুরার গর্ব অথচ: এই মহাপুরুষ আমাদের স্মৃতির অতলে। 

তথ্যসূত্রঃ

ঐতিহাসিক শতীষ চন্দ্র মিত্রের রচিত ১ম খন্ড ১৩৩৫ সালের যশোর খুলনার ইতিহাস এর ৩৭৭ থেকে ৩৮৩ পৃষ্ঠার সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে ।   

মন্তব্য: