জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাদ কামালী

মহাযুদ্ধ শুধু সহস্র সহস্র প্রাণই কেড়ে নেয় না, যুদ্ধ শেষে ঘরে ঘরে প্রকৃত  যুদ্ধের সূচনা করে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য বিপর্যয় শুধু নয়, ক্ষুধা দারিদ্র রোগ জ্বরা রমহামারি মিলে জীবন ও মৃত্যুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মানবেতর সঙ্কটে শিকার হয় শিশু ও নারীসমাজ। এমন পটভূমিকায় প্রথম মহাযুদ্ধের পর মহাবিপদের মুখে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে নারীদের মধ্যেই প্রধানত সূচনা হয় নতুন এক আন্দোলন ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’  আন্দোলন। বড়োই স্পর্শকাতর এই আন্দোলনের রূপরেখা, দর্শন এবং নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবে নারীরাই প্রচার ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আফ্রিকা ও এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারতবর্ষে, এই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পশ্চিমের নারী নেতাদের বিলম্ব হয় না। দরকার নারীপুরুষ উভয়কে সমস্যার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে সচেতন করা, উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু সমস্যা বাধে ভারতের ধর্ম ও নৈতিকতার প্রধান প্রধান সংগঠন ও তাদের ইমাম পুরোহিতগণদের নিয়ে। ইউরোপ আমেরিকায় যদি রক্ষণশীল সংঘ ও ব্যক্তি প্রবল বাধা হয়ে উঠতে পারে তবে ভারতেই কেন কৃত্রিম উপায়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বাধা হবেনা! তবে ভারতের সমস্যা শুধু ইমাম পুরোহিত নয়। সাধারণ অনেক নেতার মতো রাজনীতির মূলকা-ারি মহাত্মাগান্ধী স্বয়ংও। গান্ধীজির ধর্মনৈতিকতা হয়ে ওঠে প্রবল বাধা। তিনি তীব্র ভাষায় কৃত্রিম উপায়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রতিবাদ করেন। ধর্মনীতির আদর্শে অটল থেকে স্বামী-স্ত্রীকে কঠোর ব্রহ্মচর্য ও সংযমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন, বলেন বিয়ের বয়স বৃদ্ধির কথা। অর্থাৎ তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। আশ্চর্য! দরিদ্র দেশের পড়ালেখা না জানা সাধারণ মানুষগুলি তেমন সচেতন হয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করার শিক্ষা কোথায় পাবে! তখন আমেরিকার সমাজসেবী জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডঃ মার্গারেট স্যাংগার শরণাপন্ন হলেন ভারতের আর একজন মনীষীর দরবারে যিনি তখন বিশ্বে অতি সম্মানিত ও সুপরিচিত- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মিসেস স্যাংগার হয়তো তখন জানতেন না পশ্চিমের অনেকের আগে এমন কি অনেক নারী নেতাদের আগেই তিনি মা ও শিশুর শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, তেমনই উদ্বিগ্ন ছিলেন ভারতেরে দারিদ্র নিয়ে। ভূমি ও সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যার অধিক হার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে মনে করছেন। তিনি জানতেন জনবিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দারিদ্র দূর সম্ভব হবে না। এমন ভাবনা থেকেই তিনি বিশ্বভারতীর বহুমাত্রিক সামাজিক কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে শিশুকল্যাণ, মাতৃকল্যাণ ও ধাত্রীবিদ্যার বিষয়ও রেখেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এলেন মিস্ গ্রীনকে। মিস্ গ্রীনের কাছ থেকে হাতেকলমে প্রাথমিক শিক্ষা এবং সচেতনা লাভ করেন হেমবালা সেন ও ননীবালা রায়। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে তাঁরা কলকাতার ক্যামবেল হাসপাতালে যান অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নিতে। এঁদের দিয়ে পরে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের আশেপাশে গ্রামে শিশু ও মাতৃকল্যাণের কাজ করাও ছিল রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য লিওনার্ড এলম হার্স্ট রবীন্দ্রনাথের পল্লীভাবনায় ও কর্মে শারীরিকভাবে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁর ধনবান আমেরিকান স্ত্রী মিসেস ডরোথি স্ট্রেট শ্রীনিকেতনে দিয়েছিলেন এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকা। আর এই মিসেস ডরোথি স্ট্রেট মাতৃসদন প্রকল্পেও অর্থ ও দুই স্বাস্থ্যকর্মীকে আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছিলেন শ্রীনিকেতনে।(৩) আমেরিকার ডঃ ম্যার্গারেট স্যাংগার, ইংল্যান্ডের ডঃ মেরি স্টোপ্স্, সুইডেনের এলেনকি প্রমুখ আলোচনা, প্রচার ও লেখালেখির ভিতর দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে জনমত গড়ে তুলছিলেন পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ভারতসহ দরিদ্র ও অধিক জনসংখ্যার দেশগুলোতে। পশ্চিমে তাঁদের এই কার্যক্রম বার্থ কণ্ট্রোল মুভমেণ্ট হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরপরই। ভারতের দারিদ্র ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ মিসেস স্যাংগারের পত্র পেয়ে তাঁর বিশেষ অভিমত জানাতে বেশি সময় ব্যয় করেন না। মিসেস স্যাংগার নিউইয়র্ক থেকে ১২ আগস্ট ১৯২৫ যে চিঠি লেখেন তাতে রবীন্দ্রনাথকে উজ্জীবিত করার মতো বিষয়টির গুরুত্ব ছাড়াও আরও অন্তত দুটি বিষয় ছিল- এক, এই সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির প্রতি গান্ধীর বিরুদ্ধমত ; দুই, মিসেস স্যাংগারের সম্পাদিত দি বার্থ কণ্ট্রোল রিভিউ পত্রিকায় The Beginning (TheCrescent Moon) কবিতাটি ছাপা হওয়ার খবর জানিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন The Birth Control Review পত্রিকার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে তাঁর অভিমত লিখে পাঠাতে। প্রশান্ত কুমার পাল-এর রবিজীবনী’র নবম খণ্ড থেকে ওই চিঠির উদ্ধৃতি পড়ে দেখা যেতে পারে :

  “The Indian Papers just received report that Mahatma Gandhi has been visiting you at Shantiniketan. Perhaps you have seen his recent statement in opposition to Birth Control . . . We take it granted that with your international outlook on life and human society you cannot but feel friendly towards Birth Control … We should feel highly honored if you would send us a statement regarding birth control for publication in our Birth Control Review.(4)

এর মাত্র মাস দুই আগে গান্ধীজি চরকা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মত দাবি করেছিলেন। তো সেই ‘চরকা’ এবং এর অল্প পরেই ‘স্বরাজসাধন’ নামে আর একটি রচনায় রবীন্দ্রনাথ এই দুইয়ের কার্যক্রম ও বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ করে তুমুল বিরুদ্ধমত লেখেন।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়েও গান্ধীজির বিরোধীতার খবর জেনে রবীন্দ্রনাথ মিসেস স্যাংগারের আহ্বানে সাড়া দিতে আর বেশি বিলম্ব করেন না। কারণ তিনি জীবনে বিজ্ঞানের নীতিবাচক অবদানকে গ্রহণ করার পক্ষপাতি ছিলেন। ভারতের প্রেক্ষাপটে, ধর্মনীতি, কঠোর ব্রহ্মচর্য, সংযম ও বেশি বয়সে বিয়ের অবাস্তব পরামর্শ রবীন্দ্রনাথের নিকট তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। অন্তত জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারতের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত মনে হলো না। তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ তারিখে মিসেস স্যাংগারকে লিখে দীর্ঘ অভিমত জানালেন। এই চিঠিরও বিশেষ অংশ পড়ে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টি ও বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সমস্যার প্রকৃতি ভিতর থেকে বোঝার ক্ষমতা কত বাস্তব ও যুক্তিপূর্ণ ছিল। তিনি লেখেন,

“I am of opinion that Birth Control movement is a great movement not only because it will save women from enforced and undesirable maternity, but because it will help the cause of peace by lessening the number of surplus population of a country scrambling for food and space outside its own rightful limits. In a hunger-stricken country like India it is a cruel crime thoughtlessly to bring more children to existence than could properly be taken care of, causing endless sufferings to them and imposing a degrading condition upon the whole family. It is evident that the utter helplessness of a growing poverty very rarely acts as a check controlling the burden of over-population. It proves that in this case nature’s urging gets better of the severe warning that comes from the providence of civil social life. Therefore, I believe, that to wait till the moral sense of man becomes a great deal more powerful than it is now and till then to allow countless generations of children to suffer privations and untimely death for no fault of their own is a great social injustice which should not be tolerated. I feel grateful for the cause you have made your own and for which you have suffered.(5)

ভারত-বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের এই বাণী কত প্রকটভাবে আজ সত্য হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের মতো নারীর জীবনেও তা ভয়াবহভাবে সত্য, অনাকাক্সিক্ষত সন্তান তার নিজের জীবন মায়ের জীবন বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যেমন, সমাজ রাষ্ট্রের অতিরিক্ত বোঝা হতে পারে তেমনি। অথচ গত শতাব্দীর কুড়ি দশকেই রবীন্দ্রনাথ ওই নারীদের ব্যক্তিগত বিপদের কথা বুঝতে পেরে অনাকাক্সিক্ষত জন্ম এড়ানোর জন্য নারীদের জন্মনিরোধক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর স্নেহধন্য দিলীপ কুমার রায়কে লেখা চিঠিতে অসাধারণ একটি মন্তব্য করেন, “সমাজে যদি অশান্তি না ঘটে, তাহলে ব্যভিচার ব্যভিচারই হয় না।” আরও লেখেন, “ব্যভিচারের ফলে যদি সন্তান সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আজকাল সেটাও সমস্যা নয়। কেননা কণ্ট্রাসেপটিভ বেরিয়ে গেছে। নিবারণের উপায়গুলোও সহজ। সুতরাং গর্ভধারণ করতে হয় বলে দেহকে সাবধান রাখার দায় আর তেমন নেই।” বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রতথ্য সংগ্রাহক, গবেষক অমিতাভ চৌধুরী দিলীপ কুমার রায়ের এই চিঠি উদ্ধৃত করেছেন তাঁর ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ, অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে পৃষ্ঠা ৩৩।

মন্তব্য: