নিষাদ নয়ন 

কবিতা জারিত বোধ ও আবেগের মিশ্রণে লিখিত পঙক্তিমালা। কবিতার জন্ম আমার কাছে মনে হয় পরাগয়ানের গল্পের মতো। আর কবিতার জন্মসূত্র সমান উড়ে আসা বীজ কবিতার খনিজ। যার মানে কবিতা লেখা বা জন্ম হঠাৎ করেই হয়ে থাকে। জন্মের নেপথ্যে যেমন কিছু স্বাভাবিক কর্মপর্যায় থাকে একথা কবিতার ক্ষেত্রেও বলা যায়। কবিতার আকরগ্রন্থি- মন ও মননশীলতা প্রকারান্তে কবিমন। তবে একটি কবিতা লেখার প্রভাবক অনেক কিছুই হতে পারে- লেখার ঘোর বা পারিপার্শ্বিকতা। সাধারণত তার স্থায়িত্ব খুব অল্প সময়ের এবঙ এ কারণে অনেকেই কবিতার জন্ম প্রসঙ্গে মুহূর্তের আবেগ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। আবার কিছু কিছু সময় সত্যিই মুহূর্তের আবেগ কবিতা হয়ে ওঠে বা উঠতে পারে ; তার যথেষ্ট উদাহরণ আছে। একথা অনেক কবি প্রায়শ বলে থাকে কিন্তু আবেগ সর্বস্বতায় কবিতা হয়ে ওঠে না। তবে মাহূর্তিক আবেগ ও আবেগ সর্বস্বতা কবিতা হয়ে উঠতে পারে সেক্ষেত্রে দরকার হয় বিষয়কেন্দ্রিক স্বচ্ছতা, মথিত আবেগের শৈল্পিক বা নান্দনিক প্রকাশ। আবার এ নান্দনিকতার কোন স্থিতিস্থাপক বা নির্দিষ্ট মানদ- এখন আর নেই। তবে আপাত সুন্দর ও শ্রুতিমধুরতা তো হতেই পারে বিচার্য। মোটকথা কবিতার জন্মের জন্য বা জন্মদান প্রক্রিয়ার জন্য কবির মানসিক গঠন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণত কবির মধ্যে এক ধরণের নৈর্জন্য ও তন্ময়তা থাকে যা তাকে কবিতা লেখার জন্য তাড়িত করতে পারে। আর নির্জনতা ও তন্ময়তা তাকে সকলের মধ্যে একা করে রাখে। সে কোন কারণ ছাড়া মনমরা হয়ে থাকতে পারে বা কারো কষ্ট কবির কষ্ট হয়ে ওঠে আবার কখনো কখনো একা একা আনন্দে উদ্বেলিতও হতে পারে। একজন কবি বা আপাত কবি বা হবু কবির জীবনযাপনের সাথে কবিতা একত্রে গ্রথিত করে ফেলে সেক্ষেত্রে তার ভিতরে এক ধরণের উদাসীনতা বা একার সন্ন্যাস জন্ম নেয়। কবিতা আসলে কবির যাপন থেকে উঠে আসা স্বতঃস্ফূর্ত শব্দবন্ধ। ‘তোমরা যারা লেখক হতে চাও, আপন আপন সৃষ্টি-সামর্থ অনুযায়ী লেখার বিষয় বেছে নাও; ভাল করে ভেবে দেখ কোন কাজের দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা তোমার রয়েছে, আর কেনটাই বা তোমার সামর্থের বাইরে। আপন ক্ষমতায় কুলায় এমন বিষয় যে বেছে নেয়, তাকে কখনই শব্দের জন্য হাতড়ে ফিরতে হয় না; তার চিন্তারাজি স্বচ্ছ ও সুবিনস্ত হবেই। শৃংখলা ও বিন্যাসের মহিমা ও সৌন্দর্য এখানে যে কবি কোন বিশেষ মুহূর্তে ঠিক তাই বলবেন, যা ঐ মুহূর্তে কবিতার পক্ষে বলা প্রয়োজন; তিনি তখনকার মতো যা কিছু অবান্তর তা চেপে যাবেন অথবা একেবারে বাদ দিয়ে যাবেন এবঙ যা কিছু প্রশংসার যোগ্য আর যা কিছু তুচ্ছ করার মতো তাও নির্দেশ করবেন।’১

পুরোদস্তুর কবির কাছে এক সময় কবিতা ছিল শব্দ-খেলার মতো। এক সময় কবিরা তাদের আবেগ-অনুভূতি ছন্দ-অলঙ্কার সহযোগে লেখার পারঙ্গমতা অর্জন বা ক্ষমতায় নিজেদের রপ্ত করে নিত। এখন সে সময় নেই। এখনকার কবিতা অন্য রকম, অনেক রকম তার দ্যোতনা। যেমন বিষয়কেন্দ্রিক চিত্রকল্পকে সামনে রেখে কবিতা লেখা হত যা কিনা আধুনিক কবিতার একটি অন্যতম লক্ষণও বটে। অর্থাৎ চিত্রকল্প আবর্তিত করে কবিতা এগিয়ে যেত পরিণতির দিকে কিন্তু বিষয়হীনতা বা অনির্দিষ্টতাও যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে তার অনেক প্রমাণ অনেকের কবিতা পাওয়া যাবে। আর এটি অধুনান্তিক কবিতার একটি প্রবণতা। কবিতার সাথে আকস্মিকতার নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও সেখানে বাস্তব কল্পনা এবঙ আবেগ উপস্থিত থাকে। আকাশকুসুম ভেবে আর যাই হোক কবিতা হয় না। অর্থাৎ কবিতায় শেষ অবধি দৃশ্যকল্প বা ঘটনার কাব্যিক বয়ান বা পঙক্তি হয়ে ওঠে। কবিতার জন্মের জন্য কোন বিশেষ পন্থা এককভাবে অগ্রগন্য নয় সেটা এত সময়ে বোধগম্য হল বোধ করি।

এখন কবিতা শুধুমাত্র ভাললাগা বা না লাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাছাড়া কবিতা লেখা ও পড়া একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে দিন দিন। কবিতা পূর্বজ খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসছে। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা দিয়ে আর কবিতা বোঝার উপায় থাকছে না। কোন কবিকে লেখার প্রেরণা হিসেবে কাজ তার দেখার ক্ষমতা বা গভীর উপলব্ধির অভিজ্ঞান এবঙ শক্তিশালী প্রকাশ যা তাকে সারাক্ষণ তাড়িত করে ফেরে কারণে-অকারণে, সময়ে-অসময়ে। এক্ষেত্রে বলা যায় একজন লেখক বা শিল্পীর জীবনে কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতাই ফেলনা নয় তা কোন না যে কোন সময় তার লেখনী বা শিল্পের মধ্যে উঠে আসে বা আসতে পারে। কবিতা লেখার জন্য শুধুমাত্র চিত্রকল্প অভিজ্ঞতা বা আবেগই শেষ কথা নয়। তার জন্য প্রয়োজন ভাষাগত প্রকাশের দক্ষতা আর এর অভাব বা সংকটে পড়লে কবিতার জন্ম ব্যাহত হয়। কবি যা লিখতে চায় তার জন্য তাকে ভাষার কছে দ্বারস্থ হতেই হয়। কবিতায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে এক ধরনের দ্যোতনা বা সুর থাকে সেটা বুঝতে বা জানতে না পারলে বা নিঙড়ে নিতে না কখনো ভাল কবিতা লেখা সম্ভব হবে না। আর এক্ষেত্রে পড়ার কোন বিকল্প নেই। একটু শব্দ করে পড়লেই বা পড়ার সময় খেয়াল রাখলে এ গুণ রপ্ত করা যায়। যে যত বেশি ভাল কবিতা পড়বে তার ততো বেশি ভাল লেখার সুযোগ তৈরি হতেই পারে কিন্তু শুধু চোখ বুলিয়ে গেলে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। ভাল লেখার জন্য বেশি পড়া অবশ্যই জরুরি কিন্তু বাধ্যতামূলক নয় সবার ক্ষেত্রে। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে গেলে একজন তরুণের পক্ষে তার নিজস্ব ঘরনা তৈরি করা সহজ হবে। ‘আমি ভেবে দেখেছি যে লিখতে শেখার একটিমাত্র উপায় আছে-পড়া। লেখাতে হাতে ধরে শেখাবার কিছু নেই-ছবি আঁকায় আছে, গানে আছে। কথা ছাড়া লেখার আর- কোনো উপাান নেই এবং সব কথা সকলের সাধারণ সম্পত্তি। কথাগুলো প্রায় সবই আমাদের জানা, কিন্তু ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটি বসানোতেই লেখকের বিশেষত্ব।’২

অগ্রজ কবিদের কবিতা পড়তে পড়তে মূলত কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় সবার। তাই প্রথমে সব কবিই কারো না কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়। যারা এ প্রভাব কাটতে পারে কেবল তারাই নতুন করে কবিতা লিখতে পারে। কারো প্রভাব বা অনুকরণ ব্যতীত কেউ কবি হতে পারে না। লেখালেখির শুরুতে প্রভাব বা অনুকরণকে দোষের ভিতর ফেলা যাবে না তাহলে অঙ্কুরেই অনেকের কবি হওয়ার স্বপ্ন বিনষ্ট হতে পারে। তবে কবি বা শিল্পী হওয়ার জন্য সৃষ্টিশীল মন বা ক্ষমতা থাকতে হয় যা সবার থাকে না। সাধারণত কবিতা এমনিতে আসে না বা আকাশ থেকেও পড়ে না বা নাযিল হওয়ার মতো বস্তুও নয়। সেক্ষেত্রে কবিতা কোথা থেকে আসে বা তার বাড়ি বা ঠিকানা কোথায় এ ধরনের প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই। কবিতা লেখার বা জন্মদানের ক্ষেত্রে নিরন্তর চর্চার ভিতর থাকার কোন বিকল্প নেই। শুরুতে বলা হয়েছে কবিতার বীজ উড়ে আসা খনিজ যার তুলনা একমাত্র হাওয়াই মিষ্টির সাথেই দেওয়া যায়। কিন্তু হাওয়াই মিষ্টি যেমন হাওয়া থেকে তৈরি হয় না হাওয়া দিয়ে তৈরি হয়। আর উপকরণ হিসেবে থাকে চিনি ময়দা ফুলসোডা ও হাওয়া যন্ত্র বা কল তেমনি কবিতা লেখারও উপকরণ থাকে-আবেগ কল্পনা বাস্তব ও শব্দ। হাওয়াই মিষ্টির মতো কবিতা লেখার জন্য একটি নিরাকার যন্ত্র লাগে যাকে কবিমন হিসেবে অভিহিত করা যায়। কবিতা লেখার জন্য এটাই সবচেয়ে জরুরি। এই কবিমনের উপর ভিত্তি করে অনেকে যা ইচ্ছা তাই লিখছে ও কবিতা বলে প্রচার করছে। আর এখন তো কবিতা লেখার চেয়ে ছাপানোর সময় অনেক কম লাগে। এটাকে পুঁজি করে একশ্রেণির কবির উৎপাদন যন্ত্র অত্যাধিক ক্রিয়াশীল থাকছে। তারা মনে করে আমি যা লিখছি সেটাই কবিতা। তাদের কাছে মুহূর্তের আবেগই কবিতা। তারা প্রতিদিন কবিতার কারখানায় চালু করে এবঙ আট-দশটা কবিতা কলম পিষে বের করে। তারা বসলেই কবিতা বের হয় এবঙ বছরান্তে গাটের টাকা খরচ করে বইও করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মোটেই পড়ে না এবঙ তারা বলে রবীন্দ্রনাথ পড়ার কিছু নেই, জীবনানন্দ ভাল করে না পড়ে যদি আমার লেখা সব জায়গায় ছাপা হয় তো পড়ে কী লাভ না পড়ায় তো ভাল বেহুদা সময় নষ্ট…। তারা কেউ কেউ নিজেদের মৌলিক কবি বলে দাবি করে। অথচ তারা বুঝতে পারে না এখনকার কবিতা মৌলিক হতে পারে না বরং বিষয় প্রকরণ ও শৈলীর কারণে নতুন মেজাজের হতে পারে। তারা বুঝতে পারে না আবেগ কখন কবিতা হয়ে ওঠে। তারা জারিত বা তাড়িত হয় না কিন্তু কথিত কবিতা লিখতে তারে এতটুকু বেগ পেতে হয় না। তারা বলে অমুক অমুক মৃত কবি বা ওদের কবিতা পড়ার কিছু নেই। এ ধরনের কবির ক্ষেত্রে উপরের অনেক কথাই খাটে না। এরা ইচ্ছা করলেই লিখতে পারে। অর্থাৎ ইচ্ছামাফিক কবি। এ রকম অনেকে চিনি এবঙ জানি যারা যতটুকু পড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি জাবর কাটে, মুখে ফেনা তুলে নিজেকে একাকার করে বা করতে চায়। আর এদের সম্পর্কেই বোধ হয় বীতশ্রদ্ধ হয়েই কবি ভাস্কর চক্রবর্তী তার এক কবিতায় লিখেছেন- ‘সকলেই কবি আজ কেউ কেউ নয় কবি’। কথাটি বহুল কথিত জীবনানন্দ দাশের ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি…’ অংশের সাথে সংঘর্ষিক তবে এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে একবারেই অমূলক নয় তা অনেকের বোধগম্য হবে।

অন্যের কবিতা পড়ার পর কারো কারো কবিতা লেখার ঘোর তৈরি হয় বা হতে পারে। মুহূর্তের আবেগ তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন তা মুহূর্তের মধ্যে কবির বোধ বা তাড়নায় রূপান্তরিত হয়ে আলোর প্রতিসরণের মতো কবিতার আকারে লেখা হয়। মোদ্দাকথা কবিতা লেখার জন্য দরকার-প্রেরণা ও প্রচেষ্টা যা একজনের ভিতরে জন্মে প্রতিনিয়ত অভ্যাসের মাধ্যমে। আর কবিতা আসলে জোর করে লেখার বিষয় নয়। যে কোন ভাল লেখা অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কলমে বা লেখনীতে উজিয়ে আসে। তার জন্য কোন প্রকার ধস্তাধস্তি বা আত্মপীড়নের প্রয়োজন হয় না। কবিতা রচনার পদ্ধতি সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন-‘যখন ‘ভাবাক্রান্ত’ হই সমস্ত ভাবটা বিভিন্ন আঙ্গিকের পোশাকে ততটা ভেবে নিতে পারি না, যতটা অনুভব করি- একই এবং বিভিন্ন সময়ে। অন্তঃপ্রেরণা আমি স্বীকার করি। কবিতা লিখতে হলে ইমাজিনেশনের দরকার; এর অনুশীলনের।… কেউ হয়তো বলবেন কল্পনা কিংবা কবিকল্পনা অথবা ভাবনা। আমার মনে হয় ইমাজিনেশনের মানে কল্পনাপ্রতিভা বা ভাবপ্রতিভা।’৩ অনেকটা এ কথার সূত্র ধরেই বলা যায় কল্পনা আবেগ তন্ময়তার সিঁড়ি বেয়ে কবি ও কবিতার জন্ম। আর এক্ষেত্রে বিপুল পঠন পাঠন এবঙ যাপনই একজনকে সত্যিকার অর্থে কবি হতে ও নিজস্ব কবিতার বলয় নির্মাণে সাহায্য করে।

পাঠসূত্র- 

১। হোরেসের কাব্যতত্ত ¡(বিষয়বিন্যাস ও রচনারীতি-৪৯)- সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়

২। কালের পুতুল (লেখার ইস্কুল-২৯)- বুদ্ধদেব বসু

৩। কবিতার কথা (কবিতা প্রসঙ্গে-৩৫)- জীবননান্দ দাশ

মন্তব্য: