কবি-লেখকশূন্য ছোটকাগজ: গ্রন্থ প্রকাশের মহোৎসব

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

বঙ্গ রাখাল

কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বপ্নকে ধারণ করে প্রকাশিত হয় ছোটকাগজ। এই কাগজ ধারণ করে বিদ্রোহের ভাষা, যার মধ্যে লুকানো থাকে বারুদ। যুগে যুগে ছোট কাগজ হয়েছে আন্দোলনের হাতিয়ার আর কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লালায়িত স্বপ্ন বা দর্শন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমও হয়েছে এই ছোট কাগজ। ছোট কাগজ সেই স্বপ্নদর্শনকেই ধারণ করে যা মানুষের মান, সম্মান আর প্রেমকে নির্বিকারে পাখির মতো হত্যা করে না বরং তা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে সাহায্য করে। সমাজের উলঙ্গ, বেহায়াপনাকে তুলে ধরে মানুষের সম্মুখে অথচ আজ সেই  প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ছোট কাগজের নামে বের হয় ঢাউস, ঢাউস সংকলন। এই সংকলনধারীরাও দাবি করে নিজেদের ছোট কাগজওয়ালা।

গোষ্ঠীবাজী সাহিত্যের জন্য খারাপ কিছু নয় তবে যারা গোষ্ঠীবাজী করে নিজের সাহিত্যের মোড়ল মনে করেন কিংবা নিজেরাই বাংলা সাহিত্যের একচ্ছত্র অধিপতি বলে দাবি করেন এটা সাহিত্যের জন্য ক্ষতি। তখন আর তাদের মধ্যে বোধ হয় ক্রিয়েটিভ সত্ত্বা থাকে না তখন তারা নিজেদের এক একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অথচ তারা এসেছিলেন ছোট কাগজ করতে। ছোট কাগজ করতে এমনও অনেকে এসেছিলেন যারা নিজের বাপ-দাদার জমি খুইয়েছেন কিংবা নিজের বউয়ের গহনা বিক্রি করে সামিল হয়েছেন এ আন্দোলনে আবার এমনও অনেকে আছেন ছোট কাগজ ছাপতে গিয়ে টাকার যোগান দিতে না পেরে আর ছাপাখানায় যাননি। যে জ্বলন্ত চোখে ছিল বিদ্রোহের ভাষা, শরীরে যুগিয়েছিলেন সাত পুরুষের তাগদ সেও অনেকটা আজ ম্রিন্ময় হয়ে গেছেন অথচ তার স্বপ্নদর্শন থেকে সামান্যতম পিছপা হন নি। আমাদের দেশেও শুরু হয়েছিল ছোটকাগজ আন্দোলন। যে আন্দোলনের ভাষা ছিল কঠিন এবং সবার পদক্ষেপ ছিল কঠিন থেকেও কঠিনতম। ইস্তেহার দিয়ে জন্ম হয়েছিল ছোট কাগজের। একটা দাবি তুলেছিল তারা। তাদের কাগজ কিংবা মতাদর্শন ভিন্ন অন্য কোন কাগজে লিখবে না তারা। চর্চাও চলেছিল। সারাদেশে সাড়াও ফেলেছিল তারা। আজ তারাও বিভাজিত তাদের মধ্যেও ভাঙনের সুর। এ বড় কঠিন পথ। এ পথে হাঁটা সবার শরীরে কুলায় না। কেউ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে সস্তা পথ বেছে নেয়। এভাবেই সস্তা সাহিত্যে ভরপুর হয়ে যায় সাহিত্যের বাজার। যে মানুষগুলো এই ছোট কাগজ আন্দোলনের সামনের সারির মানুষ হিসেবে দাবি করেছিল সে মানুষও আজ নিজেকে পরিচিত করে তুলতে আপোষের চশমা নিজের চোখে তুলে নেন। আবার অনেকে নিরবে সয়ে যান সব কিছু। যারা এক সময় নিজেদের এন্টিএস্টাবলিস্ড কিংবা প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে দাবি করেন বা অন্য ছোট কাগজকে গালিগালাজ করেন তাদেরই দেখি তলে তলে আপোষ করতে। 

আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনেরা লিটলম্যাগ বা ছোট কাগজের নামে মেলা করে থাকেন অথচ তারা বোধহয় জানেনই না ছোট কাগজ কী? কেনই বা ছোট কাগজের আবির্ভাব? সারাদেশের পরিচিত মুখ, যাদের নাম সবাই জানে তাদের লেখাও এইসব পত্রিকাগুলোতে ছেপে দাবি তোলেন এটা ছোট কাগজ। তারা কোন আপোষ করেন না। তাদের কোন মোহ নেই। তারা অবাণিজ্যিকভাবে সাহিত্যচর্চা করে থাকেন কিংবা মূলধারার সাহিত্যের সাথে আছেন। আজ আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় তুলে ধরতে রাজি। টেনে-হিঁচড়ে সাহিত্যকে রাজপথে নামাতে চাই, উলঙ্গ করতে চাই, রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারা অথচ আজ রাষ্ট্রের সাথে  আপোষ করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই অনেকে কিংবা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার কবজাগত করতে চাই, সে সাহিত্য হোক বা না হোক। তেলেই পকেট ভর্তি হবে সাহিত্যের দরকার কি? নিরন্তন কেঁদে যাওয়া মানুষগুলো কখনো সাহিত্য নিয়ে রক্তাক্ত কঠিন-কঠোর কথা ভাবেন না। চোখের ঝলকে, স্নিগ্ধতা দিয়ে মানুষকে আবদ্ধ করতে চান না, তারা চান জীবনদৃষ্টি যা হবে সমকালীন মানুষের দুঃখবোধের ভাষা। ছোট কাগজজীবীরা বস্তাপঁচা সাহিত্য করতে চান না। তারা অজানাকে জানাতে চান, অচেনাকে চেনাতে চান। তারা কোন বাণিজ্যিক বা মুনাফা অর্জনের লোলুপ বাসনা অন্তরে লালন করেন না। তুলে আনতে চান নতুন নতুন মুখ। সাহিত্যের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয়কে উপস্থাপন করেন পাঠকের সম্মুখে। স্বতন্ত্র হবে তাদের প্রকাশনার বিষয়। তারা নিজেদের গাটের টাকা খরচ করে অন্যের মঙ্গলার্থে কাজ করবে।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি জুড়ে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয় আর এখানে একটা চত্বরই থাকে এই ছোট কাগজের। যেখানে নামে ছোট কাগজ থাকলেও আসলে কোন ছোট কাগজ নয়। এখানে ছোট কাগজের আদর্শ নিয়ে দু একটা ব্যতীত কোন কাগজই প্রকাশিত হয় না, এখানে সব সংকলন প্রকাশিত হয়। আবার অনেকে প্রকাশনী দেওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে ছোট কাগজ নাম নিয়ে লেখক কবিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এই সাহিত্যের কাগজ প্রকাশ করে থাকেন। কয়েক বছরের মাথায় সে ২/১টা করে গ্রন্থ প্রকাশ করতে থাকেন এবং সেইগুলো লিটলম্যাগ চত্বরে প্রদর্শন করা শুরু করেন। এভাবেই সে বাণিজ্যিক ফায়দা লুটতে থাকেন। আবার যারা সব সময় নিজেদের অনেককিছু দাবি করে থাকেন তারাও নিজেদের গ্রন্থ প্রকাশ করে ভরিয়ে তোলেন লিটলম্যাগ প্রদর্শনের টেবিল। এখানে যেন ছোট কাগজের চেয়ে গ্রন্থ প্রদর্শন বা তা বিক্রি করাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। যারা লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজের দোহাই দিয়ে নিজেরা হ্যানকরেনগা-ত্যানকরেনগা বলে দাবি তোলেন তারাই আজ লিটলম্যাগের আদর্শ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে বাণিজ্যিক একটা মেলায় নিজেদের সামিল করে মেতে ওঠে গ্রন্থ প্রকাশ আর তা বিক্রি করার জন্য মানুষের পিছু নেয়া। তারা যদি লিটলম্যাগ বা ছোট কাগজকে নিজেদের আদর্শিকতার একমাত্র হাতিয়ার বলেই মনে করে থাকে তাহলে গ্রন্থমেলার মতো একটা বাণিজ্যিক মেলায় অংশগ্রহণে কতটুকু যুক্তিকতা আছে আবার যাদের কাছে গ্রন্থ একটা অন্যসব পণ্যের মতোই পণ্য সেটা কেন তাদেরও পণ্য হয়ে উঠল। যারা আদর্শ আদর্শ করে তারা মেলায় অংশগ্রহণ না করে এটাকে বয়কট করায় যুক্তিযুক্ত হতো কিংবা অন্য সময় তাদের ভিন্নভাবে ছোটকাগজ মেলার আয়োজন করা যেটা অবাণিজ্যিকভাবেই গড়ে উঠতো। অথচ এই মানুষগুলোও এখানে অংশগ্রহণ করে আবার তাদের সাথে মূল বাণিজ্যিক ব্যক্তিরাও পত্রিকা প্রকাশ করে দাবি করে ছোটকাগজ এবং তাদের স্টলে তুলে ধরেন বাচ্চাদের গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থ যা বাণিজ্যিকভাবে তাদের উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন করা। 

ছোট কাগজের ভাষা বিদ্রোহীদের ভাষা, যার মধ্যে মীমাংসা থাকে না, থাকে বারুদের শক্তি, যা শত শত উলঙ্গতাকে নিমিশেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আজ আমাদের লেখায় মানুষ উঠে আসে না, সমাজ উঠে আসে না, আসে না মানুষের নিষ্পেষনের জীবন আর অন্যায় যে কথা মুখে আনবেন না “মহারাজা”। আজ আমরা পিঠ বাঁচানো ছোট কাগজকর্মী। ছোট কাগজ স্টলগুলোতে গেলে আরেকটা বিষয় দৃষ্টিগোচর হয় তা হলো বড় বড় নাট্যকার, আমলা, সচিব, কবিদের নিয়ে সংখ্যা যাতে করে এই সম্পাদকেরা কী বোঝায় বা কি ফায়দা লুটতে চায়? নাকি গর্ব করে কিংবা গলা উচু করে বলতে পারে আমি অমোক কিংবা তমোককে নিয়ে সংখ্যা করেছি। নাকি বাহবা পেতে চায়, নিজেকে খুব সহজেই পরিচিত করে তুলতে চায়।

ছোট কাগজের চত্বরেও আজ বাণিজ্যিক মুনাফাভোগীদের জায়গা সেখানে আজ ছোট কাগজকর্মীদের আড্ডা দেওয়ার নূন্যতম জায়গাও নাই। এই চত্বর যেন লেখকশূন্য নির্জীব চত্বর। ছোটকাগজের পরিবর্তে সেখানে গ্রন্থের পসরা সাজিয়ে বসেন প্রকাশকেরা। লেখক কবিদের আনাগোনা, তাদের আড্ডা মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে, সেই মেলার আজ অন্যরূপ। লেখক-কবি নাই, আছে মুনাফা অর্জনের শত চেষ্টা। আজ শত শত ছোট কাগজ নামধারী কাগজ বের হলেও সমাজ বা রাষ্ট্রের উলঙ্গ, বেহায়াপনা যে তুলে ধরবে কিংবা অন্যায়কে যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে, প্রতিবাদী হয়ে উঠবে ছোট কাগজের গোষ্ঠীভুক্ত লেখক-কবিরা সেটাও আজ শূন্যের কোঠায়। তাই আজ নামের ছোট কাগজ আছে, কাজের ছোট কাগজ নেই। ছোট কাগজের আদর্শ আর গ্রন্থ প্রকাশের আদর্শ এক জিনিস নয়। যে কারণে আজ আমরা আমাদের আদর্শের জায়গা থেকে বের হয়ে এসে গ্রন্থ প্রকাশ এবং তা বিপণনের দিকেই বেশি দৃষ্টিপাত করছি আর এ কারণেই আমাদের সাহিত্যের আজ এতো বেহাল অবস্থা। এখন থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আদর্শের পথ মাড়িয়ে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে না আপোষকামী হয়ে সস্তা বাজারী স্রােতে গা ভাসিয়ে নিজেদের মিলিয়ে গ্রন্থ উৎসবে বাণিজ্যিক পণ্যের দালালি করবো।

মন্তব্য: