চিন্তায় বাউল

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

কমল হাসান

ছোটবেলা থেকেই আমার বাউল দর্শনের প্রতি আকর্ষণ। কোন এক বাউল অনুসারীর যৌক্তিক ধর্মীয় তর্কের নিকট অন্যকে নতি স্বীকার করতে দেখে মনে হয়েছিল বাউল দর্শনের ভিত্তি দুর্বল নয়। তা ছাড়া সহজিয়া মানবিকতার জীবনাচার আমাকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করেছে সব সময়। বাউল দর্শন ও সুফীতত্ত্বের উপর আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন মহামনীষীর জীবনীপাঠ ও তাদের জীবনালেখ্য নিয়ে আলোচনা। বিভিন্ন সাধুসঙ্গের অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে, বাউলদের লোকজ সঙ্গীতের দেহতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বের বিচারিক সঙ্গীতের মাধ্যমে এর নিগূঢ় ভাবতত্ত্বের পর্যালোচনার এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাউলদের কাতারে দাঁড় করাতে শুরু করলাম। সামাজিকভাবে বাউল হতে না পারলেও, অন্তরে বাউলের সেই দীপ্ত ভাবকে লালন করতে আরম্ভ করলাম। জানতে চাইলাম বাউলের গূঢ় দর্শনের মৌলিকত্ব। এ অবস্থানে এসে হতবাক হই। বাউলরা শুধু লোকজ সঙ্গীতের ধারক ও পূজারী নয়, বাউলরা মানবিকতায় ধর্মের লালনকারী। বাউল শুধু সঙ্গীত-সুরের মাধুরী দিয়ে মানুষকে মোহিত করে না, বরং সর্ব ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোর সার যে মানবিক/মনুষত্বের বিকাশ সেই কথাই প্রচার করে। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধর্ম দর্শনই একেশ্বরবাদী আর একেশ্বরবাদী দর্শনের মননে স্রষ্টা এক জনই। সেই স্রষ্টা কীভাবে তার সৃষ্টি শুরু করলেন, কীভাবেই বা তার বিকাশ সাধিত হলো? কী উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করলেন? এর শেষ কোথায়? আমি কে? কোথায় ছিলাম? যাবো কোথায়? এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে স্রষ্টাকে খুঁজে পেতে হবে। তবেই এর সমাধান হবে। তাইতো বাউল স্রষ্টাকে খুঁজে ফেরে তার সৃষ্টিতে। 

জাগতিক ধর্ম মতে সনাতন দর্শনের অবতার শ্রী কৃষ্ণ বললেন- ‘জীবের আত্মাতেই বৃহ্মার স্থিতি’। মাহজ্ঞানী সক্রেটিসের মহান উক্তি- ‘নিজেকে জানো’। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হয়রত মুহম্মদ (সাঃ) বললেন- ‘নিজেকে জানলেই তোমার রবকে জানতে পারবে’। মহামতি লালন সাইজি বললেন-‘একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চিনা’। এ সকল উক্তির পর্যালোচনা করলে এটুকু বুঝতে পারি যে, ঈশ্বর/স্রষ্টা মানুষের ভেতরে বিরাজমান। তাইতো বাউল খুঁজে ফেরে আমার আমিকে। লালন ফকির তাই বললেন- ‘আমি কে তা জানলে, সাধন সিদ্ধ হয়। সেই ভেদ জানতে হলে আপনাতেই ফানা হতে হয়। আমার আমিকে জানতে হলে নিজেকে চেনার কৌশল রপ্ত করতো হয়। এ কৌশল কোথায় শিখব তাহলে?

এ কৌশল শিখতে হলে যে জন এ কৌশল জানে তেমনই একজন কৌশুলীর নিকট শিখতে হবে। বাউলেরা তাকেই বলে গুরু, সূফীরা সাধকেরা পির, মুর্শিদ, শায়খ, মুরুব্বি, উকিল বিভিন্ন নামে সম্বোধন করে থাকে। মূলে একই। তাইতো বাউলেরা এটাকে গুরুবাদী ধর্মও বলে থাকে। তবে বাউলেরা সহজিয়া ও মানবিক চেতনার ধারক হয়ে যে ঈশ্বর চিন্তায় মশগুল তা সার্বজনীন। সেখানে কোন ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার বা গণ্ডির বেড়াজালে আবদ্ধ রাখেনি। তাই হয়তো প্রচলিত ধর্মমত বাউলদেরকে স্বীকৃতি দেয় না। এ নিয়ে যুগে যুগে বাউলেরা সামাজিক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে, হয়েছে সমাজচ্যুত। তাই বলে বাউল তার প্রভূর অন্বেষণে কখনোই ক্ষান্ত হয় নি। 

তবে বাউলদের মাঝেও যে ভ্রান্ত মতবাদ নেই সে কথা বলছি না। বাউলদের মাঝেও অনেক অজ্ঞানতা, ভ্রান্তি, বিপথগামীতা, ব্যক্তিগত মতবাদ ও কুসংস্কার প্রবেশ করেছে যা বাউলদেরকে আরো পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে কিছু কিছু লোকের গঞ্জিকা সেবনের প্রকাশ্য প্রবণতা যা বাউলদের চিন্তা ও কর্মপথকে করছে স্থবির ও কলুষিত। 

সত্য বলতে, যে বাজারে খাঁটি দ্রব্য বিক্র হয়, সে বাজারে নকল দ্রব্য বিক্রি সহজ। তদ্রুপ এ বাউলদের মাঝেও অনেক কলুষিত মনের মানুষের প্রবেশ ঘটেছে, যার ফলে তাদের সেই চিন্তা বাউলসমাজকে করছে বিপথগামী আর সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে যা মননে সত্যিকার বাউলদের কাছে মোটেও কাম্য হতে পারে না। 

উল্লেখ্য, বাউলদর্শন নিয়ে বলতে গেলে মহামতি লালন সাইজীকে নিয়ে দু-একটি কথা না বললেই নয়- সাইজীর গানগুলো নিয়ে যখন ভাবি তখন অবাক বিস্ময়ে নির্বিকার হয়ে যাই। বর্তমান হতে ২০০ বছর পূর্বে চেতনার যে দ্বার খুলেছিলেন একজন অক্ষরজ্ঞানহীন সরল মানুষ তা সকলকে বিস্মিত করে। তবে লালন সাইজীর যে আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ তা মনে হয় অনেক বাউলই অনুধাবন করতে ব্যর্থ। বাউল দর্শনের মূল ভাবকে আত্মস্থ করে ঈশ্বর আরাধনায় রত হলে জাগতিক মোহ, হানাহানি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সামাজিক অবক্ষয় দূর হবে বলে আমি মনে করি। লালন সাইজীর এক ছত্রে শেষ করছি-

            অধর চাঁদের কতহ খেলা

            সর্বোত্তম মানুষ লীলা

            না বুঝে মন হলি ভোলা

            মানুষ বিবাদী 

মন্তব্য: