দেবাশীষ মন্ডল: আগে চলে গেছে যে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

রইস মুকুল

যেবার প্রথম গাজনা গেলাম সেবার দেবার সাথে খুব একটা কথা হয় নি, ফলে দেবা অর্থাৎ দেবাশীষ মন্ডল আমাকে অহংকারি লোকদের একজন বলে ভেবে নেয়। সে কথাটি পরে জেনেছিলাম জিয়াবুল ইবনের কাছে। আর তার কড়চা দিতেই তাকে নিয়ে লিখতে হলো কবিতা একটা। দ্বিতীয়বার গাজনা যাবার পর তাই স্বভাবতোই দেবাকে একটু বেশি সময় দিতে হলো। দেবা একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই জন্ম নিয়েছিলো মায়ের কোলে। তিন বৎসর বয়সের কালে একদিন খুব জ্বর আসে- তার দরিদ্র মা-বাবা যথাসাধ্য চিকিৎসা করানোর চেষ্টাও করেন। দেবাশীষ এর মায়ের ভাষ্যমতো- জ্বরের তৃতীয়দিন ডাক্তার দেবাকে কী এক ইন্জেকশান দিলো তার কিছু সময় পর থেকেই দেবার শরীর বাঁকা হয়ে যেতে থাকলো। সেই থেকে দেবা আর স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন চলাতে পারলো না। দেবাশীষ তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মাস্টারস পাশই করেনি শুধু, সংস্কৃতি ভাষাও এতোটা ভালো জানতো যে- তা বোঝ যেতো তার ভগবৎ গীতা পাঠ শুনলে। মোদ্দা কথা একজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিমান মানুষ হয়েই দেবাশীষ মন্ডল বিরাজ করতে থাকে গাজনার সকলের সাথে।

তার পরের অধ্যায়। অর্থাৎ- যে শুধু কবিতা লেখার জন্য শহরে এসেছিলো তেমনই একজন কবি তনজিম আতিককে আমি যখন পরিকল্পিতভাবে নারায়গঞ্জ থেকে গাজনায় ঠেলে পাঠাই আর তনজিম আতিক গাজনায় তার জন্মস্থানে ফিরে যখন নিজ এলাকাতে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুললো সেটার সাথে যুক্ত হয় দেবাশীষ মন্ডলও। একদল তরুণ কবিতাপ্রেমির সাথে  দেবাশীষ মন্ডলও কবিতা লিখতে থাকে। মাঝে মাঝে কবিতার রঙিন অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে যদি কোন কারণে কোথাও থমকে দাঁড়াতে হয়েছে দেবাশীষকে তখনই সে আমাকে আলোঘর ভেবে চেয়েছে দিকের সন্ধান, অন্ধ আমিও যতটুকু পেরেছি চিনিয়ে নিয়েছি পথ। কবিতার সাথেও তার চেনা-জানা হয়ে যায় অনেকটা এমন করেই। সেইসূত্রে তার সাথে আমারও ক্রমশ গড়ে উঠে আত্মিক সম্পর্ক। আত্মিক সম্পর্ক আমার তৈরি হয় কেবল দেবার সাথেই নয়- গাজনা এবং তার আশপাশের গ্রামগুলোর সাথে এবং ঐসব গ্রামের অনেক মানুষের সাথেও, সেক্ষেত্রে দেবা হয়তো নিজে থেকে একটু বেশি এগিয়ে দিয়েছিলো বলেই তাকে ভালোবাসার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিলো। আজ মনে পড়ে- ওর সাথে পরিচয়ের প্রথম প্রথম খুব হতাশ ছিলো সে নিজের শারীরিক অবস্থার কারণে। তখন আমি তাকে স্টেফিন হকিংস এর কথা বলতাম। তবে কবিতা যেহেতু প্রেমময় অঙ্গনেই শুধু বসতি করে সেহেতু কবি দেবাশীষ মন্ডলের মনে প্রেমাকাঙ্খা জাগ্রত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এইসব বিষয়াদি নিয়ে কবি দেবাশীষ মন্ডলের সাথে আমার আলাপচারিতায় বরাবরই তাকে আশার কথা বলেছি, জীবনে বাঁচার জন্য অনেক অনেক অবলম্বনের কথা বলেছি। ধীরে ধীরে আমাদের আলাপ-আলোচনার বিষয়ের পরিধি বাড়তে বাড়তে হেনো কোনো আলোচনা নেই যা আমাদের মধ্যে হয় নি। নতুন নতুন আশায় জীবনকে এগিয়ে নিতে থাকে কবি দেবাশীষ মন্ডল, এরই মধ্যে ঢাকাতে এসে কয়েকবার চাকুরির জন্য ইন্টারভিউ দেয়। প্রতিবারই সে নারায়ণগঞ্জে আসার সংকল্প করেও আসতে পারেনি সসম্ভবতো শারীরিক সমস্যাটার জন্যই। তবে প্রতিবারই সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পরেরবার ঢাকা এলে নারায়ণগঞ্জে আসার।

দেবাশীষ মন্ডল কোনদিন আর কোনো প্রতিশ্রুতি দেবে না- না আমাকে, না কবিতাকে, না অন্য কাউকে। কারণ বিগত ২৮ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ সে চলে গেছে আমাদের সকলের আগে সব প্রতিশ্রুতির উর্ধ্বে। তার এই চলে যাওয়ার বেশকিছু দিন আগে থেকে খুব মনযোগী হয়েছিলো কবিতায়- বিধায় তার সাথে আমার যোগাযোগটাও বেড়ে গিয়েছিলো খুব। প্রতিদিন না হলেও এক-দুই দিন পর পরই তাকে মোবাইলে ডেকে কথা বলতাম কবিতা নিয়ে আর তার এবং আমার পারিবারিক বিষয় নিয়েও। এরই মধ্যে একদিন দেবাশীষ খবর জানালো তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। শুনে তো আমি যারপর নাই খুশি- ভাবতে পারলাম আর যাই হউক এবার দেবাশীষের নিজের শারীরিক সমস্যা নিয়ে যে হীনমন্যতাটুকু সেটা দূর হয়ে গেলো। প্রায় এক মাস পর বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই থেকে ৩০ নভেম্বর ২০১৭ তারিখটার জন্য দিনগুণতে শুরু করে দিলাম। 

এর আগে আমি দেখতেছিলাম দেবাশীষ মন্ডল নিজে বদলে যেতে যেতে তার কবিতাকেও বদলাচ্ছিলো নিয়ত- কী ভাষায়, কী আঙ্গিকে। সেটা টের পাওয়াও গেলো তার চলে যাবার অনেকদিন আগে থেকেই- শেষবার যখন গাজনা গিয়েছিলাম ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ। সেবার দেবাদের বাড়ীতে রাত্রিযাপন করেছি, এর আগে যতবার আমি গাজনা গিয়েছি কবি তনজিম আতিকের বাড়িতেই উঠতে হয়েছিলো। মাসিমা অর্থাৎ দেবার মা যথেষ্ট সমাদর করলেন আর বললেন- দেবার মুখে শুধুই তোমার প্রশংসা আর প্রশংসা, কী যে পাগল ছেলেটা তোমার নামের উপর। শুনে আমারও বুক ফুলে উঠলো এই ভেবে- মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসার অকৃত্রিমতা বুঝাতে পেরেছি তাহলে! আসলে ভালোবাসাটাই মূল- মানুষ, ফুল, পাখি, গাছ, নদী, সমুদ্র, পাহাড়, ঘাস কবিতাসহ পৃথিবীর যাকিছু সুন্দর সেসবকে ভালোবাসতে জানার সাথেই মানুষের মধ্যকার আদর্শ আর রাজনীতি বিচার্য। পারিপার্শ্বের বেশকিছু মানুষের সাথে এমনটিই বলেছি ইতোপূর্বে। দেবাশীষ সেটাকে মনে ধরেই এগুচ্ছিলো বলেই বুঝিবা তার কবিতারও পরিবর্তন ঘটছিলো ক্রমান্বয়ে, এখানে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া কবি দেবাশীষ মন্ডলের কবিতাটি তুলে দিলাম-

এখন সব আধাঁর গিলে নিয়ে/আমি জ্যোৎস্নাকে আহবান করছি,/টুটিটিপে তাড়িয়েছি মেঘ/বৃষ্টিকে দিয়েছি নির্বাসনদণ্ড/তবুও পশলা পশলা ভেজা বাতাস/শিয়রে গান শোনায়/এমনি না, তুমি আছো তাই!

 শিউলি বনে নূপুর পায়ে/সৌন্দর্য বিলায় যে প্রজাপতি এপাশ থেকে ওপাশ/সেও তোমারি জন্য,/কেননা ও নূপুরে ধ্বনিত/সুর তুলেছিলো তোমারি ছন্দতানে।

                        (তুমি আছো তাই/ ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া) 

অক্টোবরে বেশ কয়েকটা কবিতা আমার ফেসবুক ইনবক্সে দিয়ে দেখার অনুরোধ করে দেবাশীষ। কারণ আমি সেগুলো দেখা মানেই ওতে সামান্য যেটুকু অসংগতি থাকে সেটার চরম সমালোচনা। সেখান থেকে নিজেকে সংশোধন করে তার লেখাগুলোর কোন কোনটা ফেসবুকে পোস্ট দিতো। নিচে অক্টোবর ২০১৭ তে ফেসবুকে দেয়া কবিতা তুলে দিলাম, কারণ কবিকে আসলে তার কবিতা দিয়েই চিনতে হবে, যে মেঘ মাটিকে উর্বরতা দিবে বলে কেবল বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করলো আর তখনই দমকা বাতাস তারে উড়িয়ে নিয়ে গেলো- তার সম্ভাবনার কোনো চিহ্ন কি কখনও থাকে মাটিতে…? মানুষের প্রত্ন মন তবু খুড়ে খুড়ে দেখে তার নিকট-দূরের অতিত-

অস্থিরতার ঝুল বারান্দায়/গেঁথে আছে সময়/একচক্কর পেছনে আমি/তোমায় ছুঁবো বলে এগোই/তুমি গিলে নাও/কুয়াশা মাখা ভোর আর পালং/থমকে যেয়ে ভাবি/আমার পরিচয়ের সহজ পাঠ।

            (সহজপাঠ-০১/ দেবাশীষ মণ্ডল, গাজনা ১২ অক্টোবর ২০১৭)

কোন এক দলছুট সন্ধ্যায়/হারিয়ে যাবো/খসে পড়বে মায়াময় আস্তরণ সব

আমাকে জোনাকি বলবে কেউ/কেউবা বুনো বাবুই/তেতো রং দিয়ে কেউবা নিশাচর

যে নামেই ডাকো/ মানুষ ছিলাম না, শুধু একটা প্রাণী। 

            (শুধু ডাকনাম-০২/ দেবাশীষ মণ্ডল, গাজনা ১৬ অক্টোবর ২০১৭)

নভেম্বরের শুরু থেকেই দেবাশীষের বিয়ের দিনগোনার সাথে সাথে ২/১দিন পরপর মোবাইলে কল করে করে বিয়ের প্রস্তুতির খবরাখবর নিচ্ছিলাম। মোবাইলে তার কন্ঠস্বর বদলে যাবার ধরণে বুঝতে থাকি তার চারপাশে সুখের সুবাতাস বইছিলো, ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা ভাবতে ভাবতেই ভাগ নিই সেই সুখের আর ভাবি স্বপ্নময় মানুষই কেবল পারে বুকের গহিনের রূঢ় যন্ত্রণা লুকিয়ে সুন্দর আগামীর জন্য বেঁচে থাকতে। তবু দেবা আর বেঁচে থাকলো না, ছোট্ট তার বুকে নিঃশ্বাস নেবার পর্যাপ্ত বাতাস কখনোই সে নিতে পারেনি! আর ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যার কিছুপরই বন্ধ হলো তার সর্বশেষ অপূর্ণ নিঃশ্বাস নেয়াও (আগেই বলেছি শারীরিক একটা সমস্যা দেবার ছিলো- সেটার জন্য কুজো হয়ে হাঁটতে হতো তাকে এবং বুকটা তার পর্যাপ্ত প্রশস্ত ছিলো না বলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ছিলো)। ২৩, ২৪, ২৬, ২৭ নভেম্বরেও মোবাইলে দেবাশীষের সাথে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছে, ২৮ তারিখ রাত আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চড়ুইভাতি থেকে বাড়ী ফেরার সময় ভাবছিলাম তাকে একবার কল করি কিন্তু কল করি করি করেও তাকে আর কল করা হলো না। বাড়ী পৌঁছোবার একটু পরই তনজিম আতিক মোবাইল কলে জানালো- মুকুল ভাই, দেবা নেই। নিথর হয়ে যাবার মতো অবস্থা আমার, আতিকের এমন করে বলাও আমি অবিশ্বাস করার কোনো কারণ পেলাম না। ধাক্কাটা সামলে নিয়ে একটু পরই সরকার অরুণ কুমার আর শাহ কুতুবুজ্জামানকে কল করি বিস্তারিত জানার জন্যে কিন্তু তারা দুজনের কেউ তখনও পর্যন্ত দেবার চলে যাবার কথা শুনেনি। বুকের কষ্টটাকে শেয়ার করার জন্য দেবাশীষের এমন  চলে যাবার কথাটা কাছের এক মানুষকে বলতে যেয়ে কান্নার ভেতর আশ্রয় পেলাম। আসলেই কি আশ্রয় পেলাম?

আশ্রয় বলে হয়তো কোনো বিষয়ই নেই জীবনে- মূলত মানুষ একা, সম্পূর্ণ একা। তাই সে যাবার সময় একাই যায়। আর তাই দেবার কাছে যাবার আমাদের কারো কোনো সুযোগ থাকলো না। কামনা রাণী কীর্তনিয়া নামের মাগুরার দাতিয়াদহ গ্রামের সেই মেয়েটিরও যাবার কোনো সুযোগ থাকলো না। যদিও দেবার সাথে তার বিয়ে হবার কথা হয়েছিলো আর হয়তো তারা দুজনে মিলে কোন একটা স্বপ্ন দেখতে ছিলো ২৯ নভেম্বরের দিনগত রাত্রির একটা লগ্নকে ঘিরে। এখানে আমিও দিন গুনতে গুনতে কতোকিছুই ভাবছিলাম ওদের নিয়ে, ঠিক তার একদিন আগে সব কিছুই শেষ হয়ে গেলো! শেষ- নাকি নতুন কিছু শুরু হলো? “কোন এক দলছুট সন্ধ্যায় / হারিয়ে যাবো” বলে কবি দেবাশীষ মন্ডল আগে চলে যেয়ে আমাদের জন্য নিশ্চয়ই রেখে গেলো নতুন করে নতুনকিছু করনীয়।

মন্তব্য: