সুনীলের নীল আকাশ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র। দুই বাংলায় রয়েছে তার সমান খ্যাতি। কাব্য এবং গদ্যচর্চার ক্ষেত্রে সুনীল সমান পারদর্শী। সাহিত্যের সব স্তরে তিনি তার অনবদ্য দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন সফলভাবে। দুই শতাধিক গ্রন্থের জনক সুনীল গাঙ্গুলী কিংবা নীললোহিত সনাতন পাঠকের আড়ালে তার নিপুন কলমের ব্যবহার ঘটিয়েছেন। রাজনৈতিক কলাম, মুন্সীয়ানী প্রবন্ধ রচনা করে তিনি বিপুল পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেছেন। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি বাবার চাকরীর কারণে বাংলাদেশের মাদারীপুর থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। বেড়ে ওঠেন। সাহিত্য জগতে সম্রাটের মত আবির্ভুত হন। তার সাহিত্য খ্যাতি দুই বাংলায় সমান মহিমায় আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে। সুনীল ছিলেন অদম্য অক্লান্ত আড্ডাবাজ মানুষ। দুই বাংলার লেখকদের সাথে ছিল অভিন্ন সখ্যতা। তিনি বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষাকে তার হৃদয়ের দুই ভাগে পরিপূর্ণভাবে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি বাংলা ছেড়ে মাত্র এক বছর প্রবাসী হয়ে স্বদেশের টানে ফিরে এসেছিলেন। সুনীল ছিলেন খুবই অতিথি পরায়ন। তিনি যেমন ছিলেন কবিতায় উজ্জ্বল তেমনি ছিলেন গল্পে উপন্যাসে আলোকিত লেখক। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষ সব্যসাচী লেখকের অভিধায় ভূষিত। তার লেখালেখি শুধু সাহিত্য নির্ভর ছিল না। আনন্দ বাজার পত্রিকা তার সত্যনিষ্ঠ কলমী শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়েছে। নতুন কবি, লেখকদের তার কবিতা প্রনোদনা যুগিয়েছে। শুধু কবি সাহিত্যিক নয় প্রেমিক প্রেমিকারা সুনীলের কবিতার মাধ্যমে তাদের ভাব প্রেমাবেগ প্রকাশ করেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীরা’ নারী জাতির মধ্যে নানাভাবে আবিস্কৃত হয়েছে। প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের মধ্যে নীরাকে খুঁজে পেয়েছেন। সুনীলের কবিতার মুল্যবান লাইন অনেক সময় গল্পকারদের গল্পের শিরোনাম হয়েছে। ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে তিনি যেসব কবিতা লিখেছেন সেসব কবিতা তার নিজস্ব জীবন ছাপিয়ে সমকালকে স্পর্শ করেছে। অসাধু রাজনীতিকদের প্রতারণা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি কথা না রাখার কথা ইত্যাদি বিষয় তার কবিতায় প্রযোজ্য হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায়ই স্বদেশের মায়ায় ছুটে আসতেন বাংলাদেশে। এখানকার মানুষদের ভিড়ে মিশে যেতেন। তার আপন ভুবনে অন্তরঙ্গ আড্ডায় মেতে উঠতেন। তার ভালবাসার বিষণœ আলোর বাংলাদেশকে দু’চোখ ভরে দেখতেন। ভালবাসার টানে ফিরে যেতেন শৈশবের সেই গ্রামে। সুনীল একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মমতা মাখা ভূবনে স্থায়ীভাবে থেকে যাবেন। তিনি প্রয়োজনে মৃত্যুকে বেছে নিতে চেয়েছেন কিন্তু বাংলা থেকে নির্বাসিত হতে চাননি। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতার মাধ্যমে বাঙালী জাতির মনের কথা বলে মনের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন তার মনখারাপ হওয়ার কথা কবিতায় ব্যক্ত করেছেন, পাঠক তখন অবাক বিস্ময়ে নিজের মন ভালো না থাকার অনুভুতিকে উপলব্ধি করেছেন। অর্থাৎ পাঠক নিজের অনুভুতি সুনীলের কবিতায় অনুরণিত হতে দেখেন। কিংবা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ভালো কিছু নির্মাণের ভাবনায় পাঠকদের তিনি উদ্ধুদ্ধ করেন। উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। 

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই 

কেউ তা বোঝে না, সকলি গোপন, মুখে ছায়া নেই

চোখ খোলা তবু, চোখ বুজে আছি, কেউ তা দেখেনি 

প্রতিদিন কাটে, দিন কেটে যায়। আশায় আশায় 

আশায় আশায় আশায় আশায়…

এভাবে সাহিত্য অনুরাগী মানুষের অনুভুতি সুনীল তার কবিতায় তুলে ধরেন। তার ব্যক্তিগত জীবন আশা নিরাশার মিশেল স্রোতে প্রবাহিত হয়। এবং এই প্রবাহমান জীবনবোধ অন্যদের জীবনে একিভুত হয়। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের চোখ খোলা থাকলেও আমরা অনেক কিছু দেখি না। সবাই নির্বিকার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে থাকি। সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে ভুমিকা রাখি না। মানুষের এ ধরণের প্রবৃত্তি দেখে সুনীল বিচলিত হয়েছেন। তার মন ভালো থাকেনি। আশা আর স্বপ্নের কাছে নিজেকে সমর্úন করেছেন। সুনীলের অবিশ্রান্ত লেখনীতে অনেক বৈচিত্রময় বিষয়ের পাশাপাশি এধরণের বিষয় ধরা পড়েছে। সুনীল ছিলেন খুবই পরিশ্রমী লেখক। তার কবিতা এবং গদ্যে কোনো অলস্যময়তা চোখে পড়ে না। তিনি তার অমিত শক্তিধর লেখনীর মাধ্যমে মানুষের মনের মানুষ ও প্রাণের লেখক হয়ে গিয়েছিলেন। তার সত্তর বছরে জন্মদিনে কিছু ভক্তরা একটা পোষ্টার প্রকাশ করেছিল । তাতে লেখা ছিল ‘এও কি সত্যিরে সুনীলদা সত্তরে’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে ছিল চির উন্নত তারুন্য। তিনি মন ও মননে সব সময় তরুন ছিলেন বলেই তরুণদেরকে তিনি তার ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। প্রাসঙ্গিক কারণে ’কীত্তিবাসের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। কীর্তিমান লেখক সুনীল তরুণদের মুল্যায়ন করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রকালীন সময়ে কীত্তিবাস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের অনেক সৃজনশীল কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল তরুণ কবি সাহিত্যিদেরকে পুরস্কৃত করা। বলা যায় সুনীল দাপটের সাথে বাংলা সাহিত্যকে শাসন করেছেন। সাহিত্যের সব শাখাতে তিনি দীপ্ত বিচরণ করেছেন। কবি সুনীল তার প্রথম উপন্যাস যুবক যুবতির মাধ্যমে কথা সাহিত্যে কীর্তিমান সুনীল কৃতিত্বের পরিচয় দেন। “যুবক যুবতি” তার প্রথম উপন্যাস। “আত্মপ্রকাশ” দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরে সেটা গ্রন্থাবদ্ধ হয়। “যুবক যুবতি” এবং “আত্মপ্রকাশ” প্রকাশের মাধ্যমে প্রমান করতে সক্ষম হন যে, তিনি কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাস ও গদ্য সাহিত্যে সমান দক্ষ। সুনীল সাহিত্য পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায়, গদ্যের মধ্যে নিহিত আছে কবিতার মেজাজ। এতে বোঝা যায় সুনীল মনে প্রাণে ছিলেন একজন সম্পুর্ণ কবি। প্রাসঙ্গিকভাবে তার কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত। ব্যক্তিগত হতাশা প্রকট হয়ে উঠলে তিনি বন্ধুর উদ্দেশ্যে লেখেন: “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ এই কি  মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যাবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি, মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুবদিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-(ও গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ী নেই!)।”

সুনীল তার কবিতার ক্যানভাসে জাগতিক জীবনের নানা হতাশা অপ্রাপ্তির বেদনার উচ্চারণে মানুষের পশু প্রবৃত্তি, অশুভ কামনা বৈষম্যমূলক মনোভঙ্গির চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। একটি সুস্থ মন, সুন্দর জীবন বোধ হারানোর বেদনা, সুন্দরকে স্বীকার করতে না পারার, ভালবাসতে না পারার অক্ষমতা, অন্যের কষ্টকে অনুধাবন করতে না পারার ব্যর্থতা তাকে পীড়িত করেছে। মানুষ প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে। রাজনীতিকদের অসততা, দুর্নীতি, ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঝখানে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত। মিথ্যাচারীতা বেড়ে গেছে সর্বত্র। মানুষকে ঠকাচ্ছে মানুষ। মানুষের মাঝে মিথ্যে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষ। মানুষের কল্যাণে রাজনীতি নেই, মানুষের জন্য মানুষ নেই। সবাই মিথ্যে বলে। স্বপ্ন দেখায়। কথা দেয়, কথা রাখে না। ব্যক্তিগত অনুভুতির জায়গা থেকে হলেও সুনীলের “কেউ কথা রাখেনি” শীর্ষক কবিতায় এই সব অনুসঙ্গের ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়-

“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি 

ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল

শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে। 

তারপর কত চন্দ্রভুক অমবশ্যা চলে গেল কিন্তু সেই বোষ্টুমি 

আর এলো না 

পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি।” 

এভাবে নানা স্বপ্নের এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কথা চিত্রিত হয়েছে সুনীলের বিখ্যাত এই কবিতায়। ব্যক্তিগত হতাশা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষম্যমুলক চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তার এই কবিতা লক্ষ কোটি মানুষের মনের কথা বলেছে। সুনীলের ব্যক্তিগত অনুভব অনেক মানুষের অনুভতিতে মিশে গেছে। সুনীল হয়ে উঠেছেন মানুষের মনের কবি। তার কবিতা অনায়াসে মনগ্রাহী হয়ে উঠেছে। সুনীলের কবিতায় প্রেমপ্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।  তিনি প্রেমকে প্রচ্ছন্ন একটি জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন। তার প্রেমের বাণী সত্যাবদ্ধ হয়েছে। সুনীলের বিবেচনায় প্রেম মানুষকে সত্যবাদী করে। মিথ্যাচারীতা ভুলিয়ে দেয়। তার কবিতায় ভালবাসা সত্যবদ্ধ হয়ে ধরা পড়েছে। প্রেমের স্পর্শ সবাইকে পাপমুক্ত করে। এরকম উপলদ্ধি নিয়ে সুনীল উচ্চারণ করেন- 

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ 

আমি কী এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?

শেষ বিকেলে সেই ঝুলবারান্দায় 

তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো

যেন এক টেলিগ্রাম মুহ‚র্তে উন্মুক্ত করে

নীরার সুষমা 

চোখ ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্র বিন্দু 

তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়

আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে 

মনে মনে বলি যোগ্য হও 

যোগ্য হয়ে ওঠো

ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক…” 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের বিশাল জগতে সুনীল আকাশের মতো আলো ছড়িয়েছেন।  দখল করে রেখেছেন এই অনন্য ভুবনকে। বিরল এই শক্তিমান লেখকের চিরপ্রস্থান সাহিত্য অনুরাগী প্রতিটি মানুষকে নীল বেদনায় নিমজ্জিত করেছে। ভাসিয়ে দিয়েছে। সুনীলের সাহিত্যকর্ম আপন আলোয় অনির্বান আলো ছড়াবে এমনটাই মনে করেন তার ভক্তকুলেরা। 

মন্তব্য: