ভোলাদা- এক সাদা কংক্রিট বিছানা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদেরকে নিয়ে আমাদের দেশে খুব প্রচলিত একটি কথা আছে। খোদ বাঙালীরাই এটি প্রচলন ঘটিয়েছে। কথাটি এমন যে বাঙ্গালী হলো স্বভার কবি। কবিতা আর কবিদের নিয়ে একটু বাঁকভারে বলার জন্যেই, বাঙালীর বাঙালীত্বকে একটু খাটো করে দেখানোর উদ্দেশ্যেই অনেকেই বলে থাকেন; ছোটবেলা থেকেই এমনটি শুনে আসছি।

একটি অলসমন খারাপ করা দুপুরে, একটু অন্যরকম- যখন খুব একা একা লাগে, নিজের কোলাহলমুখর বাড়িটাও যখন সাতদোহার শ্মশানঘাট তখন তাদের অনেকেই নিজের নাকটা একটু সরিয়ে রেখে সেই কবিতার কাছে আতœসমর্পন করতে দ্বিধা করেন না। একটি কবিতা বা ছড়ার বই, নাহলে চয়নিকা থেকে নিজের মনেই আওড়াতে ভালবাসেন। যদি তাও না হয় হয়তো নিজেই কবি হয়ে বসবেন। অবাক হওয়ার কিছুই নেই বাঙ্গালীতো স্বভাব কবি।

বাংলাকে ভালবাসি; ভালবাসি এর রূপ-রস-সমৃদ্ধি। ভালবাসতেও ভালবাসি বাঙালীদেরকে, ভাল লাগে নিজেকে বাঙালী ভাবতে। ষষ্ঠ শ্রেনীতে থাকতে আমার শিক্ষক চিত্তরঞ্জন শিকদার কবিতা পড়তে বলেছিলেন। সেদিন থেকে কবিতাও ভালবাসি। আর সেই থেকেই বাঙালীর ভাঙা-জোড়া, লেগে থাকা-জুড়ে থাকা, আমৃত্যু জড়িয়ে যাওয়া সংসারের মতই কবিতার সাথে আমার বসতি। এই বসতিতে আমার শিক্ষক বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেওয়ার মতো কাজটি করলেও আগ্রহ জুগিয়েছেন আর একজন মানুষÑ সত্যিকারের মানুষ; ভোলানাথ সিকদার। আমরা সবাই তাকে ভোলাদা বলেই ডাকতাম। প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতেই স্কুলে যেতাম। ফুড অফিসের সামনে হেলা আমগাছতলায় হেলে থাকা কাঠে ঘেরা ভোলাদার দোকানটি পার হয়েই ব্রিটিশ আমলের সাদা সিমেন্ট কংক্রিটের ঢালাই রাস্তা ধরে স্কুলে যেতে হতো। খব গর্ব করেই বলতে ইচ্ছে হয় আহা! এমন রাস্তাটি দেখেছি। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বানানো হলেও সেগুনবাগিচার ছোট রাস্তাটিতে এখনও তার অস্তিত্ব কিছুটা দেখা যায়। অথচ একবিংশ শতকের এই যুগেও আমরা গনতান্ত্রিক সরকারের আদরের তরুণ ঠিকাদারদের ঠকবাজির রাস্তা একটা বর্ষার ধকল পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রায় সময় দেখতাম ভোলাদার ধোলাইখানায় বেশ ভীড়। এই ভীড় বেশ টানতো। কখনো কখনো সেই ভীড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ভীড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি। তবে অনেক পরে বুঝেছি এই ভীড়ের মানুষগুলোও সব নতুন নয়। ভীড়ের অনেককে পরে চিনেছি। তাদের অনেকের সাথে পরবর্তীতে মেশার সুযোগ পেয়েছি। যাদের অনেকেরই স্থানীয় ও দেশের সাহিত্য-সাংবাদিকতার জগতে পদচারণা রয়েছে। মাঝে মধ্যেই ভোলাদার কাছে গিয়ে বসতাম। ভোলাদা আমাকে নিজের আঁকা অনেক ছবি দেখিয়েছেন। দামী কোন ক্যানভাসে নয়। ধোলাইখানায় কাস্টমারদের কাপড়ের ফেরত রশিদের পেছনের সাদা জায়গাটুকুতে আঁকা; সব ব্যঙ্গচিত্র। আঁকা ছবিগুলোর অর্থ কিছু বুঝেছি, আবার অনেকেই বুঝতে পারিনি। তবে সেসব ছবি কোনদিনও দাদাকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে দেখিনি। অথচ গল্প-কবিতার খবর অনেকেই জানেন। 

৯২ সাল। এরশাদ সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে এক বছর হলো। এসময় আমরা ক’জন বন্ধু একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিই। তার একটি লেখার জন্য দাদার ধোলাইখানায় হাজির হলাম। আমাদের জন্য একটি কবিতা নির্বাচন করলেও সেটি পরে প্রকাশের জন্য আর দেন নি। আমাদের সংখ্যাতে তার অন্য একটি লেখা প্রকাশিত হলো। স্বল্পভাষী ভোলাদার কবিতা অনেক কথা বলতো। তার ঐ অপ্রকাশিত কবিতাটিও তেমনি বক্তব্যপ্রধান; অনেক কথা বলে যায়। কবিতাটির দু’টি লাইন এখনও আমার মনে আছে; ছোট্ট দু’টি লাইন-

‘এমনি হাতে মানায় না,

অমনি হাতে মানায়’

ভোলাদার লেখনীতে এমন স্পষ্ট, তাৎপর্যপূর্ণ ও সাবলীল লেখা খুব কমই এসেছে। অসম্ভব রকমের হতাশাবাদী হয়েও তিনি আমাদেরকে আশা যুগিয়েছেন; তার বক্তব্যে, গল্পে, লেখনীতে। সেই ভোলানাথ সিকদার, আমাদের সকলের প্রিয় মানুষটির অকালমৃত্যু আমাদেরকে ব্যথিত করেছে। সেই ধোলাইখানা আজও আছে। নেই কেবল ভোলাদা আর তাকে ঘিরে সেই ভীড়, সেই আড্ডা। ভোলাদা যেন এক সাদা কংক্রিট বিছানা। দেশের সোনার(!) ছেলেদের ঠকবাজিতে তৈরী, কালো পিচের আস্তরণের নীচে চাপা পড়া, কালো বুটিকের সাদা কংক্রিট রাজপথের মতোই হারিয়ে গেছে আমাদের সকলের ভোলাদা। 

মন্তব্য: