মাগুরার কিংবদন্তিঃ শতখালীর চন্ডিদাস-রজকিনীর ভিটে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

পূর্ব প্রকাশের পর)   

                (চার)

– বাবা, অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করতে এসেছি এজন্য তুমি আমাকে মার্জনা করিও। আমি বলতে চাই কি অপরাধে তুমি ধোপাপাড়া আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছো। কি অপরাধ তাদের? 

– কি অপরাধ বুঝতে পারছো না, আমি তোমাকে নিয়ে অনেক আশা করেছি। তুমি বিখ্যাত পন্ডিত হবে। দেশ বিদেশের পন্ডিতদেরকে নিয়ে আমি তোমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। তোমার কাব্য সাধনায় দিকে দিকে আলোর বিস্ফোরণ ঘটবে- এটাই আমি আশা করেছিলাম। তুমি কি শাস্ত্র পড়ে জানতে পারনি, “বিদ্যার্জনকালে প্রণয়ীর আবির্ভাব অশুভ লক্ষণ”।

– তবে তোমার কথা মেনে নিয়েই বলছি বাবা, নারী না থাকলে সাধনে স্বার্থকতা মেলেনা। আমি তো জীবনে নারীকে জড়াইনি, আমি তো দূর থেকে একটি নারীকে শুধু দেখেছি। তার সাথেতো আমার কোন কথাই হয়নি। গাছ পাথর যেমন কথা বলতে পারে না- এজন্য গাছ ও পাথরে কোনকালে ভালবাসা হয় না, তাই রজকিনীর সাথেও আমার প্রেমের জন্ম হয়নি। রজকিনী সুন্দর তাই তাকে চেয়ে দেখি। এটা কি আমার অপরাধ?

– দেখ চন্ডীদাস তুমি কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করছো। পিতার আদেশকে অমান্য করে কেউ কোনদিন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, তুমিও পারবে না। তোমার সিদ্ধি লাগবে। এখনও বার বছর সময় রয়েছে। 

– তবে হ্যাঁ, পিতার আদেশ অমান্য করে কোন সন্তান পূণ্য লাভ করতে পারে না জানি। আমি তোমার কথা অমান্য করলেও হয়তো আমিও  পারবো না। তবে একটা কথা জেনে রাখ, কোন পিতা যদি কোন পুত্রের উপর অন্যায় আদেশ আরোপ করে তাহলে সেই পিতার আদেশে পূণ্য আসে না বরং অধঃপতন ডেকে আনে। এ কথাটিও তুমি ভুলে যেওনা বাবা। 

প্রচন্ড রেগে গিয়ে জমিদার চন্ডীদাসকে উদ্দেশ্য করে বলেন; তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি অতকিছু বুঝি না। তুমি বার বছর কোন নারীর সংস্পর্শে যেতে পারবে না।

– হ্যাঁ আমি কথা দিলাম। তবে আমার একটি কথা তোমাকে রক্ষা করতে হবে। সেটি হলো নিরাপরাধ ধোপাপাড়ার মানুষের বাড়িঘর তুমি পুড়িয়ে দিতে পারবে না। রজকিনী আর তার পিতাকে বিতাড়িত করতে পারবে না। এই শর্ত যদি মানো তাহলে আমি তোমার আদেশ মানবো। আর এ শর্ত যদি তুমি না মানো তাহলে আগামীকাল প্রত্যুষেই আমার সাধনসিদ্ধির লক্ষে আমি বৃন্দাবন চলে যাবো। আর কোনদিন ঘরে ফিরে আসবো না। 

– একথা শুনে জমিদার একটু ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বল্লেন, ঠিক আছে তোমার কথাই রইল। আমি আশীর্বাদ করি তোমার মঙ্গল হোক।

প্রেম কোন শর্ত মানেনা, শর্ত ধরেও পথ চলেনা। প্রেমের পরিণতি পাওয়ার মাঝেই স্বার্থকতা থাকে। আবার অনেকের কাছে না পাওয়াও একরকম স্বার্থকতা। তবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। চন্ডীদাস শেষ পর্যন্ত যদিও তার কথা রেখেছিলেন কিন্তু শেষ পরিণতি রক্ষা করতে পারেননি। চন্ডীদাস দূর থেকে রজকিনীকে এমনভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে তাকে না দেখলে তিনি থাকতে পারতেন না। অপরদিকে রজকিনীও চন্ডীদাসকে না দেখলে থাকতে পারতেন না। রজকিনী প্রতিদিন সকাল বেলায় কাপড় কাঁচার জন্য ঘাটে আসত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো। কাঁপড় কাঁচতেই থাকতো। কোন কোনদিন কাপড় কাঁচতে কাঁচতে ছিড়ে যেতো। তার জন্য রজকিনীর বাবাকে অনেককে ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছে। কোনকোনদিন হয়তো কাপড় কাঁচতে কাঁচতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসতো। দুপুরের নাওয়া খাওয়া হতো না। এদিকে চন্ডীদাস ঘাটের অপর পাড়ে সূর্যদ¦য়ের সাথে সাথে কয়েকটি বড়শি নিয়ে হাজির হতেন। বড়শিতে কোন মাছের খাবার থাকতো না। ফলে কোন মাছই বড়শিতে ধরতো না। এভাবেই বসে থাকতেন সারাদিন আর বারবার তাকিয়ে দেখতেন ধোপাকন্যা রজকিনীকে। তার অঙ্গের নড়াচড়া চলাফেরা কাপড় কাঁচা সবই প্রতিদিন নতুন করে অনুভব করতেন। নতুন একটি অবয়ব খুঁজে পেতেন। আর বারবার ভাবতেন নারী এত সুন্দর হতে পারে। এসবের সংমিশ্রণে রাতে তার লেখার টেবিলে বসে নানা বর্ণে নানা গন্ধে তা ফুটিয়ে তুলতেন। তিনি খুঁজে পেতেন রাধার অপূর্ব রূপের বিশাল সাগর। সেই সাগরে অবগাহন করে তিনি রচনা করতেন বিচিত্রধর্মী পদাবলী কীর্তন আর এই পদাবলী কীর্তনগলো সোনার ফসলে পরিণত হতো। এদিকে ঘরে ফিরে রজকিনী বাড়ির কাজ শেষ করে রজকিনীও যেয়ে বসতো বাড়ির কাছে গোপালের মন্দিরে। ধ্যানে মগ্ন হতো। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতো- স্বার্থক হয়ে উঠুক চন্ডীদাসের কাব্য সাধনা। গভীর রাতে দেবতার পায়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে গেলে মাটির মূর্তি গোপাল যেন বলে উঠতোঃ ‘তুই পারবি, কষ্ট কর, সাধনা করলে কেউ বিফল হয় না। তোর সাধনাও বিফল হবে না। তুই চন্ডীদাসকে পাবি।’ নিরবে মন্দির থেকে ঘরে ফিরতো রজকিনী।

প্রাচীনকালের গ্রাম সমাজের আচার-আচরণ লক্ষ্য করলে দেখতে পাই সবসময়ই নারীর দোষকেই বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হয়। একদিন ধোপাপাড়ার কিছু লোক জেনে গেল রজকিনী গভীর রাত পর্যন্ত গোপালের মন্দিরে ধ্যানে মগ্ন হয়। মন্দিরে সাধারণত পুরোহিতরা সেবা করবে। কিন্তু রজকিনীর প্রতিদিন পূজো দেয়া অনেকেই মেনে নিতে পারলো না। তারা তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করলো। বলতে লাগলো মন্দিরে যাবার নাম করে সে অন্য কোথাও যায়, প্রেমের লীলায় মেতে ওঠে। এ নিয়ে এক কান থেকে আরেক কানে চলে গেল। একসময় গ্রামের সবাই জেনে গেল এ কথা। আবার বিচার বসলো। রজকিনীর বাবাকে ডাকা হলো। খুলে বলা হলো সব কথা। রজকিনীর বাবা সেদিন কোন উত্তর দিতে পারলেন না। তখন রজকিনীকে আসতে হলো বৈঠকে। সে বৈঠকে দাঁড়িয়ে বললো, 

– কেউ যদি আমার চরিত্রের বিন্দুমাত্র কলঙ্কের ছাপের প্রমাণ এনে দিতে পারে, তাহলে এই মুহূর্তে এই ধোপাপাড়া ছেড়ে আমি এমন জায়গায় চলে যাব সেখান থেকে কেউ আমাকে কোনদিন দেখতে পাবে না। সেই সাথে আমার বাবাকেও দেখতে পাবে না। কে আছেন? বলুন। প্রমাণ দাখিল করুন।

সালিশের মানুষ নিরব হয়ে গেল। কারো মুখে কোন কথা নেই। সালিশে কিন্তু একই পক্ষের লোক সবাই যায় না। তার জন্যে কিছু কিছু লোক সঠিক কথা বলতে চায়। তাই একজন উঠে বললো,

– যে মেয়েটির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই, যার বিন্দুমাত্র প্রমাণ দিতে পারবে না, তাকে নিয়ে বিচার বসানোর কোন যুক্তি নেই। তাই এ বিচার চলতে পারে না। তার এই কথায় বেশীরভাগ লোকই সমর্থন করে বসলো। ফলে বৈঠক থেমে গেলো। একপর্যায়ে সবাই যার যার বাড়ি চলে গেলো। ক’দিন পর চন্ডীদাস জানতে পারলেন যে, রজকিনীকে ও তার বাবাকে ধোপাপাড়ার লোকজন নানাভাবে হয়রানি করছে। তখন তিনি একথা তার জমিদার পিতার কাছে জানালেন। তিনি তার পিতাকে বললেন,

– একটি নিরপরাধী মেয়েকে নিয়ে যদি আমাকে জড়িয়ে নানা কুৎসা রটনা করা হয় তাহলে আমার বিদ্যার্জনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে। তাই আপনি তাদেরকে ডেকে বলে দিন আমার সাধনসিদ্ধি হতে বার বছর সময় লাগবে। এই বার বছর তারা যেন এ ব্যাপারে আমাকে আর রজকিনীকে নিয়ে কোন বিরুপ মন্তব্য না করে। 

জমিদার ধোপাপাড়ার লোকদেরকে ডেকে এসব কথা বলে দিলেন। বিষয়টি রজকিনীও জেনে গেলো। তাই সে-ও নিজেকে অনেকটা সংযত করে নিলো। আর মনে মনে ভাবলো চন্ডীদাসকে যদি আমাকে পেতেই হয় আর তার সাধন সঙ্গিনী আমাকে হতেই হয়, তাহলে আমাকেও কঠোর ব্রত পালন করতে হবে।

একমাস, দু’মাস, তারপর বছর, তারপর কয়েক বছর- এভাবেই কেটে গেল বার বছর। রজকিনী একদিন জানতে পারলো চন্ডীদাসদের বাড়িতে বিদ্যার্জন সমাপন উপলক্ষে দেশ-বিদেশের পন্ডিতদের আগমন ঘটেছে। চন্ডীদাস তার কাব্য সাধনায় সফলতা অর্জন করেছেন। কৃষ্ণপ্রেমের পূজারী হিসেবে সার্থকতা লাভ করেছেন। সে উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে বিশাল অনুষ্ঠানের। একথা রজকিনী জানতে পেরে খুশিতে নেচে উঠলো। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে রাত আসলো কিন্তু রজকিনী সারারাত ঘুমোতে পারলো না। ভাবতে লাগলো কখন ভোর হবে। ভোরের অপেক্ষায় বসে থাকলো। একসময় ভোর হলো। রজকিনী বসে থাকতে পারলো না। আজ আর তার হাতে কাপড় ছিলো না। কাঁচার মতো কাপড় থাকলেও তা সাথে নিতে ভুলে গেলো। সে যেয়ে বসলো ঘাটের পানির কাছের সিঁড়িতে। চেয়ে থাকলো চন্ডীদাসের ঘাটের সিঁড়িতে এক পলকে। কখন চন্ডীদাস আসবেন। কিন্তু চন্ডীদাসতো আসছেন না। রজকিনী অসহ্য হয়ে যাচ্ছিল। একবার মনে হচ্ছিল, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওই ঘাটে যদি উঠতে পারতো। আবার ভাবছিল তা কি করে হয়। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে ওঠে। মাথা নিচু করে বসে থাকলো রজকিনী। একসময় চন্ডীদাস বড়শি হাতে ঘাটের কিনারায় এসে বসলেন। বড়শিতে আজও কোন খাবার ছিল না। বড়শি ফেলা হলো। রজকিনী চেয়ে চেয়ে দেখলো। রজকিনী আজ তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু আবার সে ভাবলো, কি কথা বলবে। একসময় রজকিনী বলে বসলো, 

– চন্ডীদাস কি মাছ ধরো বড়শি দিয়ে? বড়শিতেতো মাছ ধরে না।

– বড়শিতে আজ ঠোকর দিলো। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো রজকিনীর মুখ। দৌড়ে পালালো বাড়ির দিকে। এদিকে চন্ডীদাস বড়শি হাতে তুলে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, যাক বার বছর পরে বড়শিতেতো ঠোকর মেরেছে। বড়শি হাত থেকে ফেলে দিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কয়েকদিন কেটে গেল চন্ডীদাস রজকিনী উভয়েই ছটফট করতে লাগলো। উভয়ে উভয়ের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু কথা বলতে চাইলেই তো আর কথা বলা যায় না। সময় ও সুযোগের প্রয়োজন হয়। চন্ডীদাসের এক বিশ্বস্ত চাকর ছিলো। নাম হিরালাল। তাকে দিয়ে খবর পাঠালো রজকিনীর কাছে। আগামীকাল গভীর রাতে তোমার ঘাটে আমি একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করবো, তুমি আসবে। তোমার সঙ্গে কথা আছে, ভুল করো না।

{লেখকের কৈফিয়তঃ মাগুরা জেলার শতখালী গ্রামের চন্ডীদাস-রজকিনীর ভিটা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে। কেউ হয়তো বলতে পারেন আজগুবি গল্প। তবে এ ভিটার সাথে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। কিংবদন্তি কোন যুক্তি-তর্ক- এর শ্রোতধারায় প্রবাহিত হয় না। কিংবদন্তিতো কিংবদন্তিই}  

(চলবে)

মন্তব্য: