জীবনের সরল অংক

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এম. মনির-উজ-জামান

কার জন্য কাঁদে প্রকৃতি। খুব বুদ্ধিমান লোক সকলের চোখ এড়িয়ে গানের সুরে সুরে সুখ-দুঃখ ভাজে আপন সত্তায়। খুব বৃষ্টিতে আমারও ইচ্ছে ছিল তেমনি অনেক দিনের জ্বালা-যন্ত্রণা মুছে ফেলবার। বাঁধসাধে পাথর চোখ। বিষ্ময়ের কুয়াশা আরও ঘণীভূত হয়। সবাই সামনে এগোয়। এই সামনে এগোবার ছলেই কেউ কেউ পেছনে। যতটা সামনে এগোলাম বলে মনে হয় ঠিক যেন ততটাই পেছনে হাঁটা।

হায় বিধাতা! নিজের মুখ সেও দেখতে হয় আয়নায়!! নিজের জন্মক্ষণ বছর আমার কেন, সবারই মনে বা জানা নেই। আমার মৃত্যু বছর পৃথিবীর সবাই না জানলেও কেউ কেউ তো জানবেই। শুধু এই আমি জানবো না-নিশ্চিত! 

কী নাম তোমার?

বেশ গর্বিত সুরেই বলি – পিয়াল,

পিয়াল খন্দকার।   

অথচ কখনও ভেবে দেখতে ইচ্ছে হয়নি – কে রেখেছিল আমার নাম। নিজেকে জানার প্রতিবন্ধকতা এভাবে রয়েই যায় চিরকাল। জীবনের সরল অংকের লব শূন্য থাকায় হর বাড়িয়েও জীবনের যোগফল শূণ্যই থেকে গেছে-আজও পর্যন্ত!!

মৌ- মৌটুসী!

আমার বেঁচে থাকার কিছুটা প্রশ্রয়। এই মানুষকে দেখার আগে আমার মনে হয় সত্যিকারে বাঁচিওনি। হঠাৎ প্রেমিকার অহংবোধ নিয়ে আমাকে বলেছিল তুমি আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দাও না? আমার ওপর মৌ কিছুটা তুলো নরম চাহুনি রাখে। কোনোরূপ ব্যাখ্যার মধ্যে না গিয়ে বলে ফেলি তোমার ছবি অবশ্যই এনে দেবো তবে এক কপি আমার কাছে থেকে যাবে অতি যতেœ। কিছুটা প্রশ্রয় পাওয়ায় আমি যতটা গর্বিত আনন্দিত ছিলাম যে আমার সারা মুখে তার এক জীবন্ত অনুভূতি তখন। অনেক দুঃখ-কষ্টের আঁধার জীবনে এই একটু সুখ অজ¯্র জোনাকী হয়ে মনের মধ্যে উড়তে থাকে। দীর্ঘ দিনের ক্লান্তিকর অপেক্ষা কেটে কিছুক্ষণ আমাকে আনন্দে রাখতে পারলো মৌ। তারপর প্রেমিকের যোগ্যতা বলে আমার ইচ্ছের কাছে ওকে আত্মসমর্পন করতে হয়েছে দীর্ঘদিন।

শুধু আমাকেই এই সৌভাগ্য প্রদান করে। আমিই প্রথম যে এতখানি স্বাধীনতা ভোগ করলাম তখন শুধুই মেজাজ করে ভালবেসে নেওয়া। 

দু’একজন ছেড়ে সকলেই বিয়ে করে কিন্তু ভালবেসে বিয়ে সে আলাদা কিছু মোহ-যার থেকে নিস্তার পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু কেউ যদি একেবারে আট হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে-বলে আসুন ভেতরে কোনো ভদ্র ঘরের সন্তান কি তখন ভেতরে যেতে পারে? পারে না। আমারও যাওয়া হয়নি ঠিক এমনি করেই।

ক্যালেন্ডারের হিসেবেই একদিন পূর্তি হয় সম্পর্কের দু’বছর। বিশ্বাস-অবিশ্বাসে গড়ে ওঠে স্বপ্নের ঘর গেরস্থালি। ক্রমশ এমন একটা অভিজ্ঞতার হাতছানি দেয় যা আগে কখনও আমার ছিল না।

আমি সম্পর্কের দিকে গড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু কিছুতেই নতুন অভিজ্ঞতার ঝুঁকি নিতে সাহস হয়নি অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজি হয়নি, মৌ- আর সবার মত করেই। কিছুটা জেদী হয়ে তার পথ আটকে দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিলাম যদি ভয়ই পাবে তবে আর এতদূর আসা কেন? মৌ বলেছিল শোন একটা কথা, সাহস আর হঠকারিতা এক জিনিস নয়। আমিও জানি ব্যাপারটা ছেলের হাতের মোয়া ছিল না। কিন্তু পথ তো ঐ একটাই। কিন্তু তা বোঝে কে? আসি বলেই কী যেন কী খোঁজার মত করে খানিকটা অভিজাত ভঙ্গিমায় হেঁটে গেল। আমিও একটুও গতি না কমিয়ে অবহেলায় ফিরে এলাম।

আমার আদি অকৃত্রিম কাছের মানুষ মৌ অথচ সেদিন সে যেন চেনাই ছিল না। সম্পর্কের উন্নতির পক্ষে সহায়ক চালচিত্র-এ-নয়। ফলে ভালবাসার এই হত অবস্থার আর কোনো উন্নতি হয়নি। তারপর পৃথিবীর সবকিছু আমার কাছে বৈচিত্রহীন পুরোনো হয়ে যায়। ভালবাসাও না ঘৃণাও না-কী যেন একটা নতুন ধরনের কষ্ট। অর্থহীন কষ্ট জাগে ভেতরে ভেতরে। অথচ সেদিন আমার জন্য কি সাহসী কান্ডটাই না করলো। নদীর ধার দিয়ে দু’জন একান্তে হাঁটছি-একটা স্বপ্ন মাতাল হাওয়ায় ওর এলোচুল উড়ছে। হঠাৎ ওর মামার সাথে দেখা হয়ে যায়। আচরণটা ভয় দেবার মত। দেখলেই বোঝা যায়, ভূত ঝাড়ার বিদ্যে জানে। সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন এবং মন্তব্য করে আমাকে সাময়িক কোণঠাসা করতে আচমকা কিছুটা নাক সিঁটকানো মামা জিজ্ঞেস করল তা কত দিন সম্পর্ক? আমি বিব্রত হয়ে ওর দিকে তাকালাম- মৌ আমার দিকে এক অর্থপূর্ণ চোখ ঠাওরানি মেরে এক সাহসী ভূমিকা নিল। ওঃ আচ্ছা বলে মামা তখন পথ মাপেন দ্রুত।

ভূতে পাওয়ার মত কখনো সখোনো মানুষকে কথায় পায়-আমি চলে যাই প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে। ওর নিরবতায় তখন শুধু সম্মতি আর প্রশ্রয়ের ভাষা আমার দেখে মনে হল আমার বাহুতে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টিধর্মী কিছু রচনায় তার কোনো দ্বিধা-দ্ব›দ্ব নেই। একটু ভয় একটি অপরাধ বোধ নিয়েই তো মানুষের ভালবাসা।

একটা সানাই’র সুর আর বছর কয়েকের ব্যবধানে আজ দেখা হল। কিছুক্ষণের জন্য দু’জন বরফের মত জমাট হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু সে আমার পক্ষে অতি মাত্রায় চালাক। অভ্যস্থ হাত বাড়িয়ে হাসি মুখ নিয়ে বললো, কেমন আছো? মৌ আমার হাত ধরে আমার উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল। কী অদ্ভুত নিয়ম। বুঝলাম বিধাতা তাকে চলনসই গোছের মানসিক ফিটনেস দিয়েছে-যা আমাকে দেয়নি।

আমি তো সত্যি। সত্যি এবং সত্যি। একটু আগেই চিমটি দিয়ে দেখেছি কিন্তু মৌ মিথ্যে হোক। মিথ্যে হয়ে যাক।

শ্মশান, এখানে তো কত মানুষই মিথ্যে দ্যাখে। আজ না হয় মৌ মিথ্যে হোক আমার কাছে।

না- জানা মুহূর্তে ভিজে যায় সার্টের আস্তিন। খুব শখ করে কেনা ছোট সেই বেতার যন্ত্রটি পকেটের ভেতর থেকে গেয়ে ওঠে।

একটা জীবন ধ্বংস করেছো তুমি খেলারও…ও…ছলে…এ…এ…

মন্তব্য: