ঈদ আনন্দ: সেকাল একাল

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতি মানে আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগের কথা। শৈশবের অন্যান্য স্মৃতি যতটুকুই মনে পড়ুক বা না পড়ুক ঈদের স্মৃতি বেশ ভালোই মনে আছে আমার। চৌত্রিশ বা পয়ত্রিশ সালে আমার বয়স যখন ছয় বা সাত তখনই মূলত ঈদের আনন্দকে উপলব্ধি করতে শুরু করি। রমজান মাস শুরুর পর থেকেই আমাদের পরিকল্পনা শুরু হয়ে যেত ঈদে কে কোন পোশাক কিনব। আমরা তখন যৌথ পরিবারে বাস করি। চাচাতো ভাইবোন নিয়ে প্রায় দশ বারোজন ছেলেমেয়ে একসাথে বসে পরিকল্পনা করতাম পোশাক নিয়ে। আমার বাবাই ছিলেন সবার বড় তাই বাবার কাঁধেই ছিল সব দায়িত্ব। মাগুরা মহকুমা কর্মকর্তার অফিসে নাজির পদে চাকরি করতেন তিনি। আমরা আমাদের দাবি জানাতাম বাবার কাছে। রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোন একদিন তিনি আমাদেরকে দল ধরে নিয়ে যেতেন মাগুরা শহরের মাড়োয়ারি পট্টিতে (বর্তমান জুতা পট্টি)। সেখানে আমার একজন চাচার কাপড়ের দোকান থাকা সত্তেও আমরা সব দোকান ঘুরে ঘুরে কাপড় পছন্দ করতাম। তখন তৈরি পোশাকের কোন দোকান ছিলনা। দর্জির দোকানে অর্ডার দিয়ে বাড়িতে গিয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষা। যেদিন ডেলিভারি দেয়ার কথা সেদিন কখনোই হাতে পেতামনা পোশাক। দর্জিদের স্বভাব অনুযায়ি দু’একদিন ঘোরানোর পর অবশেষে পেতাম পোশাক। পরম যত্নে উঠিয়ে রাখতাম আর মাঝেমধ্যে বের করে দেখতাম তা। সত্যি কথা বলতে কি বছরে ঐ একবারই ভালো পোশাক বানানো পড়ত আমাদের। বছরের বাকি সময়ে প্রয়োজন অনুসারে দুই একবার জামাকাপড় দেয়া হলেও ঈদের সময়ই আমাদের পছন্দে পোশাক দেয়া হতো তাই ঈদের জন্য অপপেক্ষায় থাকতাম সারা বছর।

সাতাশে রোজায় চলত মেয়েদের মেহেদি বাটা আর হাত নানা নকশা করা। ঈদের আগের দিন বিকাল থেকেই আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে মাঠে জড়ো হতাম সবাই। কখন চাঁদ উঠবে সেই অপেক্ষা। চাঁদ দেখতে পেলেই খুশির জোয়ারে ভাসতাম আমরা। বিভিন্ন বাড়ি থেকে মসলার গন্ধ ভেসে আসত বাতাসে।

ঈদের দিন মা-চাচিরা সেই ভোর বেলা থেকে শুরু করতেন রান্না। আমরাও উঠে পড়তাম শব্দ পেয়ে। তারপর দল বেঁধে চলে যেতাম পুকুরে। ঐ দিনে জন্য আমাদের জন্য বরাদ্দ থাকত অজন্তা নামে বিখ্যাত সুগন্ধি সাবান। আমার বড় ভাইয়ের হাতে থাকত সেই সাবান। তিনি বেশ নেতা নেতা ভাব নিয়ে আমাদেরকে এক একবার করে মাখতে দিতেন। তারপর বাড়িতে এসেই আর দেরি না করে নতুন পোশাক পরা। নতুন পোশাক পরেই সালাম করতাম মুরুব্বিদের। এসময় সবাই দুই আনা এক আনা করে সেলামি দিত। তারপর বড়দের হাত ধরে নামাজে যাওয়া। বর্তমানে যেখানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সেখানে ছিল টাউন ক্লাবের মাঠ। সেই মাঠেই হতো ঈদের প্রধান জামাত। মাঝেমধ্যে চোপদার পাড়ার মাঠেও ঈদের নামাজ পড়েছি আমরা। নামাজ শেষেই আমরা স্বাধীন হয়ে যেতাম। যার যার বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম এপাড়া ওপাড়া। এবাড়ি ও বাড়িতে সেমাই খেয়ে দুপুরের আগেই সবাই রাস্তায় এসে দাঁড়াতাম ঘোড়দৌড় দেখার জন্য। প্রতি বছরই ঈদের দিনে ভায়নার কিছু মানুষ আয়োজন করত কাঁটাখালি থেকে ভায়নার মোড় পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতার। আমাদের কাছে আরো একটি বিশেষ কারণে তা ছিল ভীষণ আনন্দের। আমাদের পরিবারের একটি ঘোড়া অংশ নিত ঐ প্রতিযোগিতায়। আমার ছোট চাচা আবুল হোসেন খান নিজে সেই ঘোড়া চালিয়ে অংশ নিতেন প্রতিযোগিতায়। আমাদের ঘোড়া পুরস্কার পেলে কিযে আনন্দ করতাম সবাই তা বলে বোঝাবার নয়। দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসতাম বাড়িতে। মা-চাচীর রান্না করা পোলাও কোরমা খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়তাম বন্ধুদের সাথে। রাস্তায় পাওয়া যেত হরেক রকম খাবার আর খেলনা। ইচ্ছা মত কিনতাম আমরা। এভাবেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা। রাতে খাওয়া দওয়া শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। পরদিন সকালে উঠে আবার ঈদের নতুন জামা কাপড় পরে ঘুরতাম। ঈদের পরদিন নবগঙ্গা নদিতে আয়োজন করা হত নৌকা বাইচের। আমরা ভাইবোন সবাই চলে আসতাম সেখানে। নদির দুধারে সারি সারি মানুষ। নানা রকম দোকান আর ফেরিওয়ালা। বহু দূর থেকে অনেক নৌকা আসতো নৌকা বাইচে অংশ নিতে।

আমার বাবা যেহেতু সরকারি চাকরি করতেন তাই ভায়নায় খুব বেশি ঈদ করা হয়নি আমার। ৩৮ সালে বাবা বদলি হলেন বনগাঁয়। সেখানে ঈদের আনন্দটা ছিল অন্য রকম। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হলেও মুসলিম পরিবারের সংখ্যা একেবারে কম ছিলনা। বন্ধুদের সাথে সেখানেও ঘুরে বেড়াতাম মুসলিম বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে। সেই সময় গুলোও খারাপ কাটেনি অমার।

এরপর বাবা বদলি হয়ে আসেন যশোরে। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্বেও যশোর থেকে আমরা মাগুরায় ঈদ করতে আসতাম খুবই কম। কেননা তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। যশোর থেকে মাগুরা আসতে হলে নড়াইলে গিয়ে লঞ্চে করে আসতে হত । তবে যশোরের ঈদ ছিল আমার কাছে একটু ভিন্ন ধরণের। ততদিনে সিনেমা দেখার পোকা মাথায় ঢুক গেছে আমার। ঈদের দিন ছিলাম একেবারে স্বাধীন। তাই বন্ধুদের নিয়ে ঈদের দিনে চিত্রা হলে এক টিকিটে দুই ছবি দেখার সুযোগ কখনোই ছাড়িনি।

কালের বিবর্তনে পাল্টে গেছে ঈদের আনন্দ। এখন ঈদের আনন্দ আর বাণিজ্য মিলে মিশে একাকার। রোজার প্রথম থেকেই শুরু হয় পণ্যের বিজ্ঞাপন। সেই সাথে কোন পণ্যে কত পার্সেন্ট ছাড় অথবা কি কি উপহার সেসবই আলোচ্য বিষয়। যখন দেখি একটা শাড়ির মূল্য দুই লক্ষ টাকা এবং তা বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে তখন মনে হয় ঈদও বোধ হয় এক ধরণের প্রতিযোগিতা। নতুন নতুন পোশাকের নাম দেওয়া হয় হিন্দি ফিল্ম আর নায়িকার নামে। আমরা আগে সারা বছর অপেক্ষা করতাম ঈদের সময় একটি পোশাক তৈরির জন্য । এখনকার ছেলেমেয়ে প্রতিযোগিতা করে ঈদে কে কত সেট পোশাক উপহার পেল তাই নিয়ে। একারণেই আগে আমরা সামান্য মূল্যের একটি পোশাক পেয়েও যে আনন্দ পেয়েছি এখন তিন চার সেট দামি পোশাকেও বোধ হয় সে আনন্দ হয়না। নবগঙ্গায় হয়না নৌকা বাইচ। নবগঙ্গা নদি এখন মৃতপ্রায়। এখন রাস্তায় ঘোড়দৌড় নেই। আছে শুধু যানজট আর বেপরোয়া মোটর সাইকেলের শব্দ।

সবকিছুর পরেও ঈদ এখনো আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। এত অপছন্দের মধ্যেও আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি ঈদের জন্য শুধু একটি কারণে। ঈদ মানে স্বজনের সাথে আবার দেখা হওয়া। এ বিষয়টি আলোড়িত করে আমাকে। আমার মনে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে আমরা বনগাঁ বা যশোর থেকে ঈদ করতে আসতে পারিনি মাগুরায়। বিষয়টি খুব কষ্ট দিত আমাকে। শুধু আমরা নয় দূরে যারা থাকত তারা কেউই আসতে পারতনা বাড়িতে। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় সবাই নিজের বাড়িতে ঈদ করতে আসতে পারে বিষয়টি বড় ভালোলাগে আমার। বাস বা লঞ্চের ছাদে উঠে জীবনের ঝুকি নিয়ে বাড়িতে আসার আনন্দ আমি অনুভব করতে পারি পুরনো দিনের কষ্টের কথা ভেবে। সবচেয়ে ভালো লাগে ঈদের দুএকদিন আগে থেকে আমার স্বজন অথবা পুরনো ছাত্রদের সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটি। বহুদিন পর ঈদের মাঠে দেখা হওয়া পুরনো কোন ছাত্রের সাথে কোলাকুলি করার আনন্দই আলাদা। তাই যতই ধরণ পাল্টাক না কেন ঈদ মানেই আনন্দ আর তা আমি এখনো উপভোগ করি নতুন আনন্দে প্রতি বছর।

মন্তব্য: