দেলোয়ার হোসেন খান
মম একহাতে বাকা বাশের বাঁশরী
আর হাতে রণতুর্য
এই মহাবিদ্রোহের রণতূর্যবাদক কবি কাজী নজরুলের আবির্ভাব মূলত বিংশ শতকের সংকট কালে । তিনি ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী ফকির আহমেদ ও জাহেলা খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। নজরুল ধরে রাখতে চেয়েছেন কালচেতনা। রবীন্দ্র কাব্যবলয়ের মধ্যে কবিতা রচনা করেও তিনি তার কাব্যে স্বাতন্ত্র্য ও শক্তিমত্তাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অগ্নিবীণা‘ কাব্যে নজরুল প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। মানবমূল্য বিঘ্নিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত মানবাত্মা, শৃঙ্খলিত জাতীয় জীবনের ধর্মাদ্ধতা ও শোষকের সীমাহীন স্পর্ধা নজরুলকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। ব্রিটিশ তন্ত্রন্ত্রের মায়ার বিরুদ্ধে নজরুল খড়গহস্ত হয়েছিলেন। তাই তার কাব্যেও বক্তব্যের সঙ্গে পেলবতা, কোমলতা, মাধুর্য্য কাম্য হতে পারে না। শোষণ, পরাধীনতা, বিধি-বিধান এসব কিছুর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। কবির বর্ণনা-
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত-
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রাণিবে না
–বিদ্রোহী
ব্যক্তি ও কবি স্বভাবে নজরুল ছিলেন প্রবল অহংবোধের অধিকারী। এ কারণেই ‘অগ্নিবীণা কাব্যে বিশেষত ঐ কাব্যেও বিদ্রোহী কবিতায় সমস্ত শক্তির উপরে নিজের ব্যক্তি সত্ত্বাকে প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন কবি। বিদ্রোহী কবিতা নজরুলের আত্মউন্মােচনের শৈল্পিক দলিল। কবি অন্যায়ের কাছে মাথা নত হতে দেননি । জগতের অনিয়মের হােতা হিসেবে তিনি সব বিধিবদ্ধ নিয়মকে শনাক্ত করেছেন-
আমি মানি নাকো কোন আইন,
আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি
আমি টর্পেডো, আমি জীম ভাসমান মাইন ।
–বিদ্রোহী
১৯৪৭ সালে ৪৯নম্বর বাঙালি পল্টনে যােগ দিয়েছিলেন ঠিক সে সময়ে যে সময়ে ইংরেজ শাসকের নির্মম
নিষ্পেষণে পরাধীন এ জাতির প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। নজরুলের বিশ্বাস ছিল একমাত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই এ শোষণের নির্মম বেড়াজাল ছিন্ন করা সম্ভব। তিনি বিদ্রোহী কবিতায় লিখেছেন–“আমি উপারি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে ।“ নজরুলের সমকালে বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রভাব নজরুল সাহিত্যে যতটা দেখা যায় অন্য কবিদের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে গবেষক হুমায়ুন কবিরের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য- “অসহযোগ আন্দোলনের আলোড়ন বাংলা কাব্যে বোধ হয় নজরুল ইসলামের মধ্যেই সবচেয়ে বেশী জেগেছিল এবং সে জন্যই বর্তমান শতাব্দীর (বিংশ) তৃতীয় দশকে তার
এত প্রতিষ্ঠা ” নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজরুল নারী বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন ১৯২৫সালে। যে বিদ্রোহের আহবান আজও বিশ্বনারী আন্দোলনে প্রেরণা জাগাতে সক্ষম-
মাথায় ঘোমটা ছিড়ে ফেল নারী, ভেঙগে ফেল ও শিকল।
যে ঘোমটা তামারে করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ।
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ ষত আভরণ।
–নারী
নজরুল নারী স্বাধীনতা ও বিশিষ্তাকে উচ্চকিত করে তুলেছেন। সমালােচকেরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন- নজরুল নারী স্বাধীনতার প্রধান প্রবক্তাই শুধু নন তিনি গারহস্থ কর্তব্য ও নান্দনিক সৌন্দর্যের গপর। একজন কাব্যিক ভাষ্যকার ।“
নজরুলের মনে মার্কসীয় বা রুশীয় সাম্যবাদী গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল একথা অশ্বীকার করা যায় না। বিশ্ব ইতিহাসের সাম্যবাদী আন্দোলনের ধারা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন বলেই নিজেকে তার সমসাময়িককালে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত করেছিলেন।
নজরুল কেবল সাম্যবাদী শোষণমুক্তির কথাই প্রকাশ করেননি; শ্রেণীহীন সর্ব শোষণমুক্ত সমাজের বাস্তব ছবিও তার চিত্তকে উদ্বেলিত করেছিল। তিনি নিজেকে সর্বহারাদের কবিরূপে চিত্রিত করেছেন। তার কবিতাগুলো যেন অনেক ক্ষেত্রেই ‘সাম্যবাদী ইশতেহারের প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়। নজরুল সাহিত্যে সর্বত্রই শ্রেণী সচেতনতা এবং সাম্যের চেতনা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দৃষ্টান্ত-
তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে, আমরা রহিব নীচে
অথচ তোমারে দেবতা বলিবে, সে ভরসা আজ মিছে। (কুলি-মজুর।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, সাম্যবাদী কবি নজরুলের কল্পিত এই পৃথিবী কার্ল মার্কসের বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ থেকে দূরে নয়।
এ পৃথিবীর শাসনভার নজরুলের মতে তাদের হাতেই থাকবে যাদের শ্রমে গড়ে উঠেছে সভ্যতার সুরম্য প্রাসাদ। তাই কবি শ্রমিক শ্রেণীর বা মেহনতি মানুষের বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন। সর্বহারাদের বঞনা ও জাগরণের গান গাইতে গিয়ে কবি বস্তুতঃপক্ষে শ্রেণী সংগ্রামের দিন গুনেছেন,
আগিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ(কুলি-মজুর)
বিশ্বময় বিপ্লব ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুরাতন জীর্ণ পৃথিবীর ধ্বংসম্ভুপের উপর এক আদর্শ সমাজ ও নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন, নজরুল বিশ্বাস করতেন, বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের মধ্য দিয়েই রক্তিম সূর্যোদয় ঘটবে-
আজ হৃদয়ের জাম-ধরা যত কবাট ভাঙয়া দাও
রং করা ঐ চামড়ার মতো আবরণ খুলে নাও(কুলি-মজুর)
বাংলা ও বাঙালীর সমাজ এবং সাহিত্যকে নজরুল দান করেছেন চিরায়ত সাম্যদর্শন ও শ্বাশত কল্যাণ। প্রেম মানব জীবনের বিশেষ এক মৌলিক অনুভূতি। মানুষের অপরাপর বৈশিষ্ট্যের মত প্রেম জাটিল ও পরস্পর বিরোধী। প্রেমের মহিমান্বিত স্পর্শে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় আবার প্রেমের বেদনা মানুষ রিক্ততার অতলে নিয়ে যায়। মিলনের নিবিড আনন্দ থেমন প্রেমে আছে তেমনি আছে বিরহের মর্মছেদি যন্ত্রণা। প্রেমের আকর্ষণ দূর্দমনীয়, অন্তরজমিনে তার বাস। তাইতো প্রথম মানব Adam প্রেমের নিবিড়তা অনুভব করে প্রথম মানবী Eveকে বলেছিলেন- O fairest creation of Iast and best of all Gods’ works, How Lcar live for thee, Let us go to the earth.
নজরুলের দোলন চাপা প্রেমের কাব্য হিসেবেই সমধিক পরিচিত, এ কাব্যে দেখা যায় কবির হৃদয়াবেগের তীব্রতা অতিমাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রেম মানবাত্মার এক গভীরতম ক্ষুধা নিবৃত হয় একমাত্র প্রিয় মিলনে। সমালোচকের মতে, কাজী নজরুল ইসলাম মিলনের কবি নন, বিরহের কবি, ব্যথার কবি, চোখের জলের কবি। আশান্বিতা কবিতায় দেখা যায় নজরুল তার বিরহী মনের পরিচয় এক নারীর অন্তরাত্মার ক্রন্দনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন, রাত্রি গভীর, সবাই ঘুমে অচেতন। কিন্তু এই গভী়র নিশীথেও বিরহিনীর চোখে ঘুম আসে না। মনে তার ভেসে ওঠে অতীতের হাসি-কান্নার চিত্র, ভেসে ওঠে মিলনের সুখ নিবিড় মুহূর্তগুলো চলমান ছবির মতো-
পোড়া চোখের জল ফুরায় না, কেমন করে আসবে ঘুম?
এনে পড়ে গুধু তােমার পাতাল গভীর মাতাল চুম,
কেমন করে আসবে ঘুম?”
দোলন চাঁপা কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা পুজারিণী। এই প্রেমের কবিতায় কবির যেমন বেদনা কাতরতা প্রকাশিত হযেছে তেমনি প্রকাশিত হয়েছে ঈর্ঘার জ্বালা। এখানে যে নারীর পরিচয় পাওয়া যায় সে নারী চিরন্তন নয়, চোখের জলে সে বুক ভাসায় না, সে নারী মায়াবিনী ছলনাময়ী, কবি তাই নির্মমভাবে এ ধরনের নারীর ছলনার মুখোশ খুলে দিয়েছেন এই কবিতায়- “আজ হেরি তুমিও ছলনাময়ী/তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী।
কবি নজরুলের কাছে নারী কুহেলিকা, প্রেম আলেয়া। প্রেম বেঁচে থাকে প্রেমের পাত্র পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যায়। আসলে নারীর ঔদাসীন্য অবহেলা নির্মমতা কবিকে অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তাই তো আলতা স্মৃতি কবিতায় দেখা যায় কবি তার মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন। এখানে দেখা যায নায়ক তার প্রেমাস্মদকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেননা, সংশয় প্রকাশ করেছেন নারীর সততার। সে দেখেছে প্রেমিকার সমাধির উপরে উঠে নারীর নতুন বাসর সুখের সংসার, তার হৃদয়ের রুধির ধারায় নারীর পা
হয় অলক বঞ্চিত-
জানি রাণী, এমন করে আমার বুকের ধারায়
আমারই প্রেম জন্মে জন্মে তোমার পায় আলতা পরায়।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য সামাজিক কুসংস্কার, অত্যাচার, নিপিড়ন দূর করে একটি সুখি সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনের জন্য নজরুল লেখনি ধারণ করেছেন। কিন্তু তার ‘দোন চাঁপা কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় ব্যর্থতার মর্মভেদী হাহাকার ও গাঢ় বেদনার মু্ঘনা প্রকট হয়ে উঠেছে যে কবির হৃদয় অগ্নিগর্ভ, বাণী অগ্নিক্ষরা সেই কবিই পরীর ভালবাসা পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন।। এ থেকেই বোঝা যায় কবির হৃদয় কত দুর্বল। নজরুলের কবিচিত্তে প্রেমের সে অপরূপ ব্যথা উচ্ছলিত তারই অপরিসীম বেদনা, উপেক্ষিত প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস নিঃসীম বেদনায় দোলন চাঁপায় দোলায়িত। প্রেমের গান গাইতে গিয়ে হৃদয়বীণা বিরহের সঙ্গীত তুলেছে, প্রেমিক কবির বুকের মালা বিচ্ছেদের চির বিরহ অনলে দগ্ধ। কবির প্রেম সমৃদ্ধ চিত্তদেশ বেদনার বিরুদ্ধ আবেগ স্কুরিত। কবি যখন বাস্তবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না তখন তিনি চলে যান পরাবাস্তবে অর্থাৎ Realism থেকে Surealism, Natural থেকে Supernatural-এ। কবি কাজী নজরুল এর ব্যতিক্রম নন। তিনি বাস্তব পৃথিবীর অথৱা প্রেমিকার সঙ্গে মিলনের বাসনায় কামনা করেছেন মৃত্যু, মৃত্যুকে কামনা করেছেন আরেক জগতে শাক্তির সোপান হিসেবে,
যে জগতে প্রেমিকা বধু এবং কবি সরব-
নব জীবনের বাসর দুয়ারে কৰে প্রিয়া বধু হবে-
সেই সুখে, প্রিয়, সাজিয়াছি বর মৃত্যুরউৎনবে। (সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে)
দ্রোহ, প্রেম আর সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে পয়ত্রিশ বছর বাকশক্তিহীন জীবন্মৃত অবস্থায় কাটাতে হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ৭৭বছর বয়সে দুরারােগ্য ব্যাধির মরণ ছোবলে করির জীবন-বাঁশীর সুর থেমে যায়। মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই । আর এ গানের তাৎপর্য অনুসরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।