বাঙ্গালী মনষ্কতার জন্য রবীন্দ্র চর্চার একটি ধারনার কথা বলা হয়। সাধারণ বাঙ্গালীর ক্ষেত্রে তখন রবীন্দ্রনাথের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ? আর এ প্রশ্নে বিশেষভাবে বাঙ্গালীমনষ্কতার কথা আসেই বা কি ভাবে ? আসে এ কারণে যে, বাঙ্গালী হওয়া আর বাঙ্গালীমনষ্ক হওয়া এক কথা নয় বলে। বাংলা ভাষাভাষি ব্যক্তি বাঙ্গালী বটে কিন্তু বাঙ্গালীমনষ্ক ব্যক্তিকে শুধু ভাষার অধিকার জ্ঞান সম্পন্ন হলেই চলে ? বিজ্ঞান পড়া- চর্চা- গবেষনায় অবদান রাখা ব্যক্তি বিজ্ঞানী হতে পারেন বিজ্ঞানমনষ্ক নাও হতে পারেন। তাই বাঙ্গালী হলেও বাঙ্গালীমনষ্ক হবেন একথা সত্য নয়। মননশীল বাঙ্গালী, সৃজনশীল বাঙ্গালী তার জীবন পথ চলায়- বলায়, কর্মে- উৎসাহে, সংস্কৃতে বার বার রবীন্দ্রনাথকে উপলদ্ধি করেন- রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নেন। চৈতন্যে রবীন্দ্রনাথ ধারনে বাঙ্গালীমনষ্কতা অথবা বাঙ্গালীমনষ্কতা অর্জনে রবীন্দ্রনাথ এক অপরিহার্য বিষয় উপকরণ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের উপযোগীতা গ্রহনযোগ্যতা এখানেই।
এটা হতে পারে যে, সারাজীবন অজ¯্র লিখেছেন, প্রয়োজনীয় সময় সুযোগ পেয়েছেন এবং পরিবেশটা তার ক্ষেত্রে বড়বেশী বৈরী হয়ে দেখা দেয়নি। তার এই সুযোগ পাওয়া এবং কাজে লাগানোয় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি যে একটি বিশেষ অবস্থান মান অর্জন করে গেল- সেটিই বাঙ্গালীর জন্য হয়ে উঠলো গর্বের মহত্বের দ্যুতিময় হীরকখন্ড। যে আলো যে আগুনের পরশমণির ছোঁয়া পাওয়ায় জন্য বাঙ্গালী মাঝে মাঝেই আকুল হয়- সে তো রবীন্দ্রনাথের দান। রবীন্দ্রনাথ উপমহাদেশীয় সুদূর অতীত ঐতিহ্য সংস্কৃতি ছেঁকে শাশ্বত মহান সব বাণীর সারাৎসার আমাদের জন্য পরিবেশন করেন। আমরা তার মধ্যে তার আয়নায় আমাদের ঋদ্ধ অতীত, যুগ যন্ত্রনার ঘটমান বাস্তবতা আর স্বপ্নের ভবিষ্যৎ রূপকল্প দেখি নিজেদের মনের মুকুরে ঢেলে।
পথ তৈরী হয়েছিল আগেই। চর্যার মৃদু পদসঞ্চালনা নিয়ে যাত্রা। বৈষ্ণবপদাবলীর রাধাকৃষ্ণের শাশ্বত প্রেমগীতি। চন্ডী মঙ্গল মনসা মঙ্গলের উপাখ্যান। পয়ারের রুনুঝুনু নুপুরত্যাগী মধুসূদনের বীররস সঞ্চালন। অমিত্রাক্ষর চতুর্দশপদী নিয়ে সে পথকেই অগ্রগণ্যকরণ। হাজির করেন পশ্চিমী চিন্তার আকর। ধর্ম প্রচার মিশনে আসা ইউরোপিয়ান উইলিয়াম কেরীর হাত ধরে গদ্যযাত্রা। বারো দেশি পন্ডিত তাঁর সহযোগী । রাজা রামমোহন বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিম। তার সাথে বাউলের লোকদর্শন, মণি-মাণিক্য সংযুত লোকসংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুরণন। এ সকলই রবীন্দ্র পূর্ব কীর্তি। তৈরী পথের উপাদান উপকরণ।… বৃটিশ শাসন শোষনের সাথে (তথাকথিত) ইউরোপিয় অগ্রসর চিন্তা শিক্ষা সংস্কৃতির প্রবেশ। জোড়া সাঁকোর (ব্রাহ্ম) ঠাকুর বাড়ীর অন্দরে মুক্তবুদ্ধি শিক্ষা সংস্কৃতির আখড়ায় পরিণত হওয়াকেও এ আলোচনার পথের বাইরে রাখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ পূর্বসুরীদের সৃষ্ট পথ ধরে এগিয়ে যান। পূর্বসুরীদের রচনা পাঠে অবলোকনে সচেতন রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব পথ খুঁজে নেন। পথের প্রকৃষ্ট সপ্রসর বাঁক নির্মান করেন । খুব সংক্ষেপে বললে, পথকে রাজপথে পরিণত করেন তিনি। পৃথিবীকে মুঠি ভরে বাংলায় ভারতবর্ষে আনেন-বাংলাকে ভারতবর্ষকে পৃথিবীর আলো হাওয়ায় ছড়িয়ে দেন। বাংলা সাহিত্যকে উপযুক্ত মানে দাঁড় করাতে সফল হন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি সে ক্ষেত্রে একমাত্র মাপকাঠি স্বীকৃতির বিষয় হতে পারে না। তবে নোবেল প্রাপ্তি যে তখনকার অনেক মানী-গুণিজনের রবীন্দ্রনাথকে বিলম্বে চিনতে বুঝতে আবিষ্কার করতে ফলপ্রসূ হয়েছিল সে কথা নির্দিধায় বলা যায়।
রবীন্দ্রনাথ এলেন দেখলেন জয় করলেন। এসো বললেই সব কিছু মস্তিষ্কে এসে কলমের খোঁচায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে উঠলো সোনায়- সোহাগায় এমনটি তো নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁর সহায়ক হয়েছিল। দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন। রাতদিন চুটিয়ে লিখেছেন, লিখতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর প্রাক-প্রস্তুতি আয়োজন। নিজেকে অনেকটা সংগোপনে তিলে তিলে গড়ে তোলার কি বিরক্তিকর অথচ অদম্য প্রয়াস। জোড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর অন্দরে তাঁর বেড়ে ওঠা- পরিবারিক কঠিন কঠোর যথোপযুক্ত শিক্ষন অনুশাসনে। …..এক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অমনোযোগী ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বিব্রত পিতা দেবেন্দ্রনাথ, পরিবারের স্বনামখ্যাত সব বয়স্যরা। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন তখন কোথায় ? যেখানেই থাক না- বয়স্যদের মনোপীড়া দুশ্চিন্তার আঁচ যে তাঁকেও ভীষন রকম উদ্বেলিত করেছিল রবীন্দ্রানুরাগী মাত্রই তা অনুভব করে থাকবেন।
ঠাকুরবাড়ীর বাইরে পরাধীন ভারতবর্ষের নানা গøানি দুর্দশার সচেতন সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ। তার মনের মধ্যেও নানা সমস্যা সংকটের নিত্য আসা-যাওয়া। সোনার চামচ মুখে জন্ম নিলেও মানুষ যে দুঃখ দৈন্যতা মুক্ত থাকে না রবীন্দ্রনাথ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয় মাসোহারায় রবীন্দ্রনাথের পরিবার চলে না। বিবাহিত মেয়ে জামাইয়ের হাত খরচও তাঁকে গুনতে হয়। পাটের ব্যবসায় নামলেন। ব্যবসা জমেনা। জমিদারি দেখাশুনার জন্য মফস্বলে গেলে খাজাঞ্চীখানা থেকে অতিরিক্ত মাসোহারা মেলে। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, পতিসর, শাহাজাদপুর, উড়িষ্যার কাছারীতে যান অর্থ সংকটের কারণে।
কিশোর বেলায় প্রিয় বৌঠানের অপমৃত্যু, স্ত্রী- কন্যা বিয়োগ তাঁকে যে কতখানি বিচলিত করেছে রবীন্দ্রজীবন পাঠকেরা ভালোই জানেন। প্রায় শেষ বয়সে একমাত্র পুত্রের মৃত্যু তাঁকে আরো নি:সঙ্গ অসহায় করেছে। জীবন মৃত্যুর এই টানাপোড়েনে-তাঁর আত্মগত সমীক্ষণ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিশেষ করে অপ্রাপ্তির নি:সীম মনোবেদনা সারাজীবন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ত্রাই প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ ছায়া আমরা তাঁর মহান সব সৃষ্টিকর্মের মধ্যে বার বার খুঁজে পাই।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির সপ্রসর যে রাজপথ নির্মাণ করে গেলেন – ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমাদের সে পথে হাঁটতেই হয়। মানুষের জীবনের মনোবৃত্তির এমন কোন অবস্থা ক্ষেত্র নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই। আবালবৃদ্ধবনিতার, সাহস-সংগ্রামের, উৎসাহ-উৎকর্ষের, সৃজনশীল-স্বপ্নের, প্রেমের- চৈতন্যের সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ আমাদের কান্ডারী হয়ে মনোচক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন করেন। তাঁকে এড়ানো যায় না। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির কথকতা আলোচনা তাঁকে ছাড়া কখনো কোনকালে সম্ভব হবে-এ কথায় মন সায় দেয় না।
রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ হিসাবেই আামাদের কাছে গণ্য হ’ন না। তাঁকে আমরা সাহিত্য সংস্কৃতির বাইরেও বিশেষভাবে পাই। রাজনীতি- রাষ্ট্রচিন্তা, দেশপ্রেম- প্রতিবাদ, কৃষি- সমবায়- অর্থনীতি, বিশ্বজনীন- মানবতা, ধর্মদর্শন- ভক্তিবাদসহ মানব জীবনের নানা মাত্রিক নিবিড় জ্ঞান ও চেতনার অনির্বচনীয় সত্যানুসঙ্গ আমরা রবীন্দ্রনাথে বিধৃত দেখি। সাহিত্য পথের যাত্রী হয়েও কেবল সেখানে আবদ্ধ না থেকে বাঙ্গালী জীবনবোধকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। বাংলা সাহিত্যের দরবারে হাজির সভাসদদের মধ্যে এ প্রসঙ্গে মাত্র তুল্য হ’তে পারেন আর একজন- তিনি আমাদের বাবরি দোলানো কাজী নজরুল ইসলাম।
যে ছেলেটিকে নিয়ে অমন বিখ্যাত পরিবারটির দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না সেই কিনা একদিন বাঙ্গালীর উপমহাদেশের বিশ্বের হয়ে গেল। আমাদের আত্মপরিচয়ের বলার জানান দেবার গর্ব করবার এক মহান মহীরুহ। আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে- চলমান সেই পথের উৎকর্ষ সাধনে সচেতন মন প্রান এগিয়ে যাবো- এই প্রত্যাশা।