মাজহারুল হক লিপু

মন্টু মিয়া দুপায়ে ভ্যানের প্যাডেল ঘোরাতে  ঘোরাতে উচ্চস্বরে গান গাইতে থাকে -মালা কার লাগিয়া গাঁথিরে মালা আমি কার লাগিয়া গাঁথি । প্রতিদিন বাড়ি থেকে ভ্যান গাড়িটা বের করে প্যাডেল ঘোরানো শুরু করে একটা না একটা গান ধরবেই সে। তবে মালা কার লাগিয়া গাঁথি গানটি মন্টু মিয়ার খুব প্রিয়। বেশিরভাগদিনই সে এই গানটি গায়।

বউ ময়না বেগম রোজ সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সেরে মন্টু মিয়ার জন্য রাঁধতে বসে। দিনের আলো একটু বাড়লেই মন্টু মিয়াকে ডেকে তোলে প্রতিদিন । মন্টু উঠেই দেখে তার বউ দাঁতের মাজন, গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর পুকুর থেকে গোসল সেরে বারান্দায় বসে ভাত খাওয়া। খাওয়ার সময় পাশে বউ না থাকলে মন্টু মিয়ার একটুও ভাল লাগে না। আজও গরম ভাত আর ভর্তা খেয়ে মন্টু মিয়া যখন বড় রাস্তায় বেরিয়েছে তখন বড়জোর আটটা বাজে। এ সময় অন্য ভ্যান চালকরাও বের হয় বাজারের উদ্দেশ্যে। অফিস আদালতে যাওয়ার জন্য যারা বাজারে উপস্থি হয় সেই সব প্যাসেঞ্জার ধরতে খুব সকালে ভ্যান নিয়ে বাজারে হাজির হয় সবাই। মন্টু মিয়াকে ওভারটেক করে বেশ গতির সাথেই পাশ দিয়ে চলে গলে নায়েব আলী। অন্য সময় হলে মন্টু মিয়াও দেখে নিত। সকাল বেলায় পাল­া দেওয়ার ইচ্ছে হলো না তার। বাজারে পৌছেই দেখলো শ্যামল বাবু চা খাচ্ছে মতি মিয়ার দোকানে। উপজেলা সদরে শ্যামল বাবুর রড-সিমেন্টের ব্যবসা। প্রতিদিন সকালে ফুলপুর বাজারে এসে শ্যামল বাবু মতি ময়িার দোকানে চা খেতে খেতে মন্টু মিয়াকে খোঁজে। মন্টু মিয়া আরও দুই একজন প্যাসেঞ্জার যোগাড় করার আগ পর্যন্ত শ্যামল বাবুকে ডাকে না। আজ বাজারে আসার সাথে সাথে দুইজন প্যাসেঞ্জার পেয়ে গেল সে। এবার চেঁচিয়ে ডাক ছাড়লো -কই বাবু আসেন। তিনজনকে নিয়েই সে যাত্রা শুরু করলো উপজেলা সদরের দিকে। এই রাস্তায় যারা ভ্যান চালায় তাদের প্রত্যেকেই ফূলপুর বাজার থেকে উপজেলা সদর আবার উপজেলা সদর থেকে ফুলপুরেই ক্ষ্যাপ মারে বেশি। এভাবে দিনে পাঁচছয়টা ক্ষ্যাপ মারলেই একশ টাকার মত আয় হয়।

-কিরে মন্টু গান ধরবি না?-স্টার সিগারেটে টান দিতে দিতে শ্যামল বাবু মন্টু মিয়াকে বলে। মন্টু এবার গাইতে লাগলো-আমার সোনার ময়না পাখি। গলা খুব মিষ্টি না হলেও বেশ দরদ দিয়েই সে গায়।

উপজেলা পরিষদের সামনে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে মন্টু এককাপ চা খাওয়ার জন্য চলে আসে রসুলের দোকানে। দোকানের সামনে এসে দেখে ইদ্রিস, মোহন, আক্কাস সহ প্রায় আট দশজন ভ্যান চালক সেখানে বসে। মন্টু মিয়াকে দেখেই ইদ্রিস তাকে ইশারায় ডাক দিল। ইদ্রিসের পাশে বসতেই আক্কাস বলে উঠল-‘শুনিছ নাকি মন্টু মিয়া, কাইলকের থেকে এই রাস্তায় নাকি বাস চলবি। ঝিনেদারতে ফুলপুর বাজার হয়ে উপজেলা সদর পর্যন্ত যায়া আসা করবি। এ রকম হলি তো আমাগের ভ্যান চালানো বন্ধ হয়ে যাবেনে।’ এবার মোহন বলতে থাকে- ‘বাস পালি কি কেউ ভ্যানে ওঠে? যেটুক পথ ছয় টাকা নিই বাস নিবেনে তিন টাকা। তাছাড়া বাসে কত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়।’ ইদ্রিস হঠাৎ বেঞ্চ থেকে উঠে বলতে থাকে- ‘যা হয় হবেনে, এতদিন ভ্যান চালাতাম, এবার জোনের কাজ করবানে। উপরআলা যেরম চালায় সেইরম চলবানে।’ কথাগুলো বলেই সে বাইরে বেরিয়ে তীব্রগতিতে ভ্যান চালিয়ে চলে যায়। ইদ্রিসের দেখাদেখি একে একে সবাই বেরিয়ে গেলেও মন্টু মিয়া চুপ করে বসে থাকে। রসুল মিয়াকে এককাপ চা দিতে বলে বাড়ির কথা ভাবতে থাকে সে। বাড়িতে তার বউ ছাড়াও মা এবং তিন বছর বয়সের একটা ছেলে আছে। ছেলের নাম রেখেছে রাজা। দাদির স্বপ্ন রাজা নাকি সত্যিই একদিন দেশের রাজা হবে। মন্টু মিয়ার বড় ভাই মফিজুর ঢাকায় গার্মেন্টসেক কাজ করে। সাথে আরো কিসের ব্যবসা আছে যেনো। ভালোয় আয় করে। বাড়ির খোঁজ খবর নেয়না কখনো। একমাত্র ছোট বোন মর্জিনার বিয়েতেও সে আসেনি। মন্টু প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে বোনটাকে পার করেছে। নিজের জমানো ছিল পনের হাজার আর বাকি পনের হাজার টাকা মেম্বারের কাছ থেকে ধার করেছে। এখনো আট হাজার টাকা শোধ করা বাকি। রসুল মিয়ার দোকান থেকে চা খেয়ে চারজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে আবার সে ফুলপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এগারটার দিকে একবার বাড়িতে গিয়ে বাজার দিয়ে আসে। দুপুরে আবার খেতে আসে বাড়িতে। খেতে বসে একটা কথাও বলে না ময়না বেগমের সাথে। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হয় ভ্যান নিয়ে। সকালের পর থেকে আর একটা গানও সে গায়নি।

সন্ধ্যার দিকে মন্টু মিয়া বাঁশি হাতে পুকুর পাড়ে বসে। পুকুরটার ঠিক পাশেই বড় রাস্তা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকেই রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া এসময় আর কোন শব্দ পাওয়া যায় না। মন্টু মিয়ার মন খারাপ হলে এখানে এসে বাঁশি বাজায়। এখানে বসলেই ময়না বেগম বুঝতে পারে তার স্বামীর মন আজ ভালো নেই। তাই মন্টু মিয়া যখনই এখানে বসে ময়না বেগমও তখন পাশে এসে বসে। আজও মন্টু মিয়া যখন বাঁশি বাজাচ্ছিল ময়না বেগম নিঃশব্দে পাশে এসে বসল। অনেকক্ষণ বাঁশি বাজিয়ে একসময় যখন থামল ময়না বেগমন তাকে জিজ্ঞাসা করল-‘আপনার কি হইছে? কথা কন না ক্যা?’ স্বামীর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ময়না বেগমও নিশ্চুপ হয়ে যায়।

পরের দিন সকালে ভ্যান নিয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই তীব্র গতিতে একটা বাস মন্টু মিয়ার পাশ দিয়ে চলে গেল। মন্টু মিয়া একবার বাসটার দিকে তাকিয়ে সোজা প্যাডেল মেরে বাজারে চলে আসে। রোজকার মত আজো শ্যামল বাবুকে চা খেতে দেখে। দুজন প্যাসেঞ্জজারও ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু শ্যামল বাবুকে ডাকতে সাহস  হয়না তার। বাবু আবার বাসে যাবেন না তো। চা শেষ করে শ্যামল বাবু নিজেই এসে ভ্যানে ওঠে। স্টার সিগারেট ধরায় ঠিকই তবে আর আর গান গাইতে বলেনা মন্টু মিয়াকে। উল্টো মন্টু মিয়াই প্রশ্ন করে- ‘বাবু বাসে গেলেন না যে?’ শ্যামল বাবু একটা হাসি দিয়ে বলে- ‘তিরিশ বছর ধরে ভ্যানে যাতায়াত করি। এত সহজে কি বাসে ওঠা যায়? আমি আবার একটু সেকেলে মানুষ কিনা।’

প্রথম দুএকদিন মন্টু মিয়ার খুব কম রোজগার হয়নি। প্রায় আগের মতই। চতুর্থ দিনে এসে মনে হলো রোজগার যেন একটু কমের দিকে। সপ্তাহ খানেক পর তা অর্ধেকে নেমে এলো। এবার মন্টু মিয়ার  মাথায় নানা ধরনের ভাবনা কাজ করতে লাগলো। 

দিন দশেক পর, এরকম ভাবনা ভাবতে ভাবতেই মন্টু মিয়া ভ্যান নিয়ে বাজারের দিকে রওনা  হচ্ছিল। সে বুঝতে পারলো পিছন দিক দিয়ে একটা বাস আসছে। অনেক দূর থেকেই ভেঁপু বাজানো শুরু করলো বাসটা। মন্টু মিয়ার হঠাৎ মনে হলো-এই রাস্তায় তার চেয়ে বেশি অধিকার কার আছে। যতই ভেঁপু বাজাক সে সাইড দেবে না বাসটাকে। এতক্ষণে বাসটা প্রায় ভ্যানের পিছনে চলে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যেই মন্টু মিয়া বুঝতে পারলো বাসের আঘাতে সে ভ্যানসহ ছিটকে চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। এরপর আর কিছুই মনে করতে পারেনি মন্টু মিয়া। তিনদিন পর সে নিজেকে আবিস্কার করে সদর হাসপাতালের বেডে। ময়না বেগম জানায় তার বামপায়ে আঘাত লেগেছে। ডাক্তার বলেছে ছয়মাসের আগে সে সুস্থ্য হবে না। আর সুস্থ্য হলেও ভ্যান চালানো সম্ভব হবে কিনা তা আশ্বস্ত করতে পারেনি ডাক্তার।

পনের দিন পর এক সকালে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে মন্টু মিয়া। সারাদিন ঘরে শুয়ে থেকে সন্ধ্যায় ময়না বেগমকে ডেকে নিয়ে পাশে বসায়। ময়না বেগম জানায় শ্যামল বাবু এরই মধ্যে কয়েকবার খবর নিয়ে গেছে আর দুইদিন চালডাল সহ বাজার পাঠিয়েছে। কথাটা শোনার পর মন্টু মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কি অদ্ভুত জোছনা আজ। এবার বউয়ের হাতখানা ধরে বলে-‘আমারে এট্টু পুকুর ধারে নিয়ে যাবা? ঐখানে বসে এট্টু বাঁশি বাজাতাম।’ ময়না বেগম বাঁশিটা নিয়ে দুহাতে মন্টু মিয়াকে ধরে ঘর থেকে বের হয়। বাড়ি থেকে খুব দূরে নয় পুকুরটা । ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে মন্টু মিয়াকে পুকুর পাড়ে সেই প্রিয় জায়গাটায় এনে বসায়। মন্টু মিয়া যখনই বাঁশি বাজাতে শুরু করে ঠিক তখনি রাতের নির্জনতা ভেঙে একটা বাস ভেঁপু বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে ফুলপুরের দিকে চলে যায়। বাঁশি বাজানো থামিয়ে দেয় সে। চারদিকে জোছনার আলোটাকে ভালো করে খেয়াল করে। সে আলোয় তার মনটা কেন যেন ভালো না হয়ে আরও বেশি খারাপ হয়ে যায়। হাতের বাঁশিটা মুখের সামনে নিয়ে আবার ফুঁ দেয়। বাঁশি যেন বাজতেই চায় না। এমন সময় আবার সে শুনতে পায় আর একটি বাস ফুলপুরের দিকে থেকে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে। মন্টু মিয়ার শত চেষ্টাতেও বাঁশিতে সুর ওঠে না। সে দেখতে পায় বাসটা এগিয়ে আসছে আরও কাছে। এবার হাতের বাঁশিটাকে জোরে ছুড়ে মারে রাস্তার উপর। ঠিক তখনি বাসটা চাকা দিয়ে বাঁশিটাকে পিষে দিয়ে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলে যায় উপজেলা সদরের দিকে। ময়না বেগম একবার বাঁশির দিকে, একবার স্বামীর দিকে তাকায়। তারপর মন্টু মিয়ার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে অস্ফুট স্বরে বলে-‘চলেন ঘরে যাই।’

মন্তব্য: