ব্ল্যাকহোলের বাদুড়

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

হোসনে আরা মণি

সকালবেলা খবরের কাগজ দিয়ে দিন শুরু করাটা আদিল সাহেবের পুরনো অভ্যাস। দেশের হালফিল খবরাখবর না জেনে ঘরের বাইরে পা বাড়াতে তিনি কোন কালেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননা। ইদানীং অবশ্য টিভি, ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদির কল্যানে যে কোন সময় খবরের আপডেট জানা যায়। তবু সংবাদপত্রটা হাতে করে না দেখে আদিলসাহেব স্বস্তি পাননা- পুরনো অভ্যাস আরকি। তো এই আদিল সাহেব আজ সকালটাও তার পুরনো অভ্যাস মতই শুরু করলেন। ঘুম থেকে জেগে ধীরে-সুস্থে তলপেটের চাপ দূর করে ব্রাশটা- স্নানটা সেরে একবারে অফিসে যাওয়ার উপযোগী পোশাক পরে নিয়ে বারান্দার ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে শুরু করলেন। ‘চোখবুলানো’ কথাটা অবশ্য এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। তিনি যেভাবে পত্রিকা দেখেন তাকে সাধারণ চোখবুলানো বলা যায়না মোটেই। রীতিমত আয়োজন করে তিনি পত্রিকা দেখেন ও বিশেষ গুরুত্বের সাথে অধিকাংশ খবর পড়েন। পত্রিকা পড়ার সময় তার হাতে থাকে একটা লাল মার্কার পেন। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে গোটা ছয়েক পত্রিকার হেডলাইন মুখস্থ করে তিনি খুলে বসেন সম্মাদকীয় পাতা। এখানে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়র শিরোনাম দেখেই তিনি ঠিক করেন কোনটা সঙ্গে নেবেন আর কোনটা বাসায় ফেলে যাবেন। যে লেখাটা তিনি পরে পড়বেন বলে ঠিক করেন সেটা লাল কালিতে মার্ক করে পাতাটা আলাদা সরিয়ে রাখেন। এভাবে যে যে পাতাগুলো নির্বাচিত হয় সেগুলো হাতে করে তিনি উঠে আসেন ডাইনিং টেবিলে। এখান থেকে তার স্ত্রী ওগুলো ড্রাইভারের জিম্মায় সোপর্দ করে।

গত কদিন হল পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতেই আদিল সাহেব কেমন একটা অস্বস্তিবোধ করছেন। অস্বস্তির কারণ কি তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেননা। শুধু মনে হচ্ছে যা কিছু চলছে তা ঠিক চলছেনা, যা কিছু ঘটছে তা ঘটা উচিৎ নয়। কী যেন এক ভয়ঙ্করব্যাপার ঘটমান হয়ে ওঠার অপেক্ষায় গোটা দেশ-জাতির কপালে অদৃশ্য হয়ে ঝুলে আছে। সেই অবশ্যাম্ভাবীকে এড়িয়ে চলার ক্ষমতা কিংবা ভাগ্য আর যারই থাক, তার নেই।

এমনিতে এদেশের পত্রিকার প্রথম পাতায় কোন সুখবর কদাচিৎ থাকে। পাহাড়ধ্বস, ভবনধ্বস, লঞ্চডুবি, শিল্পকারখানায় আগুন ইত্যকার হাজারো দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনার বলিরা শিরোনামের তলায় ঠাঁই পেতে জ্বলজ্বলে রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে থাকে। যেন তারা বলতে চায়- ‘এই দেখ, আমরা এখন খবর হয়ে গেছি। আমাদেরকে তুমি এখন পড়। তোমার না খুব পত্রিকা পড়ার খায়েশ?’ তো ইদানীং অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পত্রিকার খবরেরা তাকে কেবল ব্যঙ্গ করেই নিষ্কৃতি দিচ্ছেনা, রীতিমত শাসাচ্ছে। যেন পারলে তারা এখনই তাকে তাদের মত খবরে পরিণত করে। এ কি অদ্ভূত অনুভূতি! বিষয়টা নিয়ে তিনি কোন সাইকোলজিস্টের সাথে কথা বলবেন কিনা এমনটি ভাবতে ভাবতে অন্যমনে পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটি খবরে আটকে গেলেন- যেখানে মিনিরবাসের হেলপার আবুল চোখ মটকে বলছে, ‘দ্যাখছেন ছার, মুইও খবর হয়া গেনু!’ আদিল সাহেব প্রায় চিৎকার করে উঠতে চান, ‘ব্যাটা উজবুক! কে তোকে বলেছিল অবরোধের সময়ে রাতে গাড়িতে ঘুমাতে? বাড়ি-ঘর নাইতো ব্যাটা ফুটপাত কি ওভারব্রিজতো ছিল। ওখানেতো কেউ আজো গানপাউডার ছিটায়নি।’ আদিল সাহেবের অস্ফুট চিৎকার শুনতে পেয়েই কিনা জানিনা, তার স্ত্রী কিচেন থেকে এসে তার পাশে দাঁড়ান। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি আরো বিরক্তবোধ করেন। মহিলাটা ইদানীং চেহারায় একরাশ উদ্বেগ মেখে হতাশার জীবন্ত মূর্তি হয়ে ঘোরাফেরা করেন। স্ত্রীর এমন চেহারা কোন পুরুষেরই কাম্য নয়, আদিল সাহেবেরতো নয়ই। তিনি নিঃশব্দে পত্রিকাগুলো ভাঁজ করে স্ত্রীর হাতে দিলেন। স্ত্রী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে তিনি বললেন, ‘এখন আর বাছাবাছির সময় নেই, সবগুলোই গাড়িতে পাঠাও।’

গত কয়েকদিন হল তার পত্রিকা পড়ার নিয়মে ব্যাপক অনিয়ম ঘটছে। আগে তিনি যে যে পাতাগুলো পড়তেননা, এখন সেগুলোই একটু পড়তে ইচ্ছে করছে। গতকালতো প্রথমআলোর হালকা-চটুল বিষয়সমৃদ্ধ একটি ট্যাবলয়েডই তিনি গাড়িতে তুলতে দিয়েছিলেন। নারীদের সাজগোজ বিষয়ে একগাদা টিপস্সহ দারুণ কিছু রঙিন ছবি ছিল তাতে। মনে হচ্ছিল সেগুলো পড়া দরকারÑ বিশ্বজুড়ে নারীরা এই যে তাদের সাজের পেছনে লক্ষ-কোটি ডলার ব্যয়সহ দুর্মূল্য সময়ের কী নিদারুণ অপচয় ঘটায় এবং এর পেছনে কত গবেষণা, কত শিল্পবিনিয়োগ- অথচ এ বিষয়ের তিনি প্রায় কিছুই জানেননা; এ কি ঠিক? কিন্তু গাড়িতে পাতাটা পাওয়া যায়নি। স্ত্রীকে কিছু বিউটি টিপস্ দিয়ে ‘সারপ্রাইজ’ ঘটিয়ে তাকে চাঙা করে তুলবার যে মহৎ উদ্দেশ্যটা ছিল তাও তাই কার্যকর করা যায়নি। পাতাটা না পাওয়ার ব্যাপারে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েও করা হয়নি।

ড্রাইভার আলীরাজ একজন ‘ডিজিটাল’ যুবক। বছর বিশ-বাইশের ছিপছিপে তরুণের পরনে    ফেইড জিন্স কিংবা গোটা দশেক পকেটঅলা গ্যাভার্ডিন ট্রাউজার। তার দু’কানে অষ্টপ্রহর এয়ারফোন সাঁটা। যে সাহেবের গাড়ি চালানোর চাকরি সে করে তারচেয়ে কোন অংশে সে কম কেতাদুরস্ত নয় বরং আধুনিকতার বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সে সাহেবের উপর দিয়েই যায়। তবু যেহেতু সে একজন শুধু ড্রাইভার, সে তার ওজনটা পুরোপুরি ভুলে যায় কী করে! তাই মালিকের ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দেয়া থেকে শুরু করে সাহেবের ব্রিফকেসসহ পত্রিকার বান্ডিল মালকিনের হাত থেকে বুঝে নেয়ার কাজটা সে বড়ই তমিজের সাথে করে থাকে। তবে এটুকু সময়ের ভেতর সে চোরাচোখে ডাইনিং স্পেসসহ এর আশপাশের ঘরগুলোর ভেতর যতটা পারে তার উৎসুক-উদগ্রীব চোখজোড়া বুলিয়ে নেয়।

এই চোখজোড়ার ভেতর থেকে যে আকাঙ্খার বিচ্ছুরণ ঘটে সেটা যে কোন কাঙ্খিত বস্তুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত তা মিসেস আদিলের দেখার মত একজোড়া চোখ থাকলে বা বোঝার মত বোধ থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতেন কিন্তু ইদানীং তিনি তার একমাত্র পুত্ররতেœর ব্যাপারে এমনকিছু গুপ্ত টেনশন লালন করছেন যার পাশে পৃথিবীর বাকিসব ব্যাপারই ফ্যালনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটা  কি রাজনীতি করে, কি প্রেম, কি অন্যকিছু- তা তিনি জানেননা; কিন্তু তার মাতৃহৃদয় ছেলের ব্যাপারে তাকে কী যেন একটা পূর্বাভাস দিতে চায়। ছেলেটা কাছেপিঠেও থাকেনা যে চোখ-কান খোলা রেখে তাকে বুঝতে চেষ্টা করবেন। শুধু মনে হয় যে ছেলেটা বুঝি আর আগের মত নেই- কী যেন একটা বড় বদল ঘটেছে এবং আরো বদলের প্রক্রিয়াতে রয়েছে।

তো আজ সকালে আলীরাজ যথারীতি তার সময়ের হাওয়ার ড্রেস পরে, কানের এয়ারফোন একটু ঢিলা করে, প্যান্টের পকেটে দু’হাত রেখে ওয়েষ্টার্ন টাওয়ার এর লিফটে চাপল। লিফট নয়তলায় থামলে আলীরাজ নামল। এরপর প্যান্টের পকেট থেকে একহাত বের করে ফ্ল্যাটের কলিংবেলের সুইচে চাপ দিল। ফ্ল্যাটের দরজা খুলল যমুনা। এই পিচ্চিটাকে আলীরাজ দু’চক্ষে দেখতে পারেনা। কী কারণে যে মালিক এটাকে কুড়িগ্রামের চর থেকে তুলে এনেছে তা সে কিছুতেই ভেবে পায়না। গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়া ছাড়া এইটুকুন পিচ্চি করেটাইবা কী। করে, করে- আলীরাজ তা জানে। ছোট ম্যাডামের পেছনে গোয়েন্দাগিরির কাজটা এই ন’দশ বছরী পিচ্চিটা বেশ সাফল্যের সাথেই করে থাকে। ম্যাডাম সুস্মিতা আদিল স্কুল-কোচিংয়ে যাওয়া-আসার পথে কোন্ দিকে তাকিয়ে মুখটিপে হাসে, কার দিকে চেয়ে হাত নাড়ে, রাস্তার কোন্ কোন্ মোড়ে বিশেষ রকম উৎসুক চোখে তাকায় সেসব এ পিচ্চি চুপচাপ মার্ক করে মনের খাতায় টুকে রাখে এবং দিন শেষে বড় ম্যাডামের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। এই গোয়েন্দাগিরির কাজ এবং টুকটাক কিছু ফায়ফরমাশ খাটার বিনিময়ে পিচ্চিটার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরী হতে চলেছে; অর্থাৎ টিকে  থাকতে পারলে ভবিষ্যতে এই পিচ্চিটা সুস্মিতা ম্যাডামের মত ‘ফুলের ভারে নত’ হওয়ার বয়সে পৌঁছালে কোন একজন আলীরাজের গলায় তাকে ঝুলিয়ে দেয়ার পাকাবন্দোবস্ত করার দায়িত্বটা অগ্রিম কবুল করে নিয়েই নাকি মালিক তাকে  কুড়িগ্রাম থেকে এনেছেন। এই ইঁচড়ে পাকাটা যতনা সুস্মিতা ম্যাডামের চক্ষুশূল তারচে বেশি আলীরাজের। ম্যাডামকে গাড়িতে আনা-নেয়ার পথে এই উচ্চিংড়েটা ম্যাডামের সাথে সেঁটে থাকায় আলীরাজ কোন দিন তার প্রাণের ইচ্ছেটার প্রকাশ ঘটাতে পারেনা। গাড়ীর রিয়ার ভিউ মিররে ম্যাডামকে দেখা যায়- উৎসুক চোখে বাইরের কত কী দেখছে। কখনো গাড়ি থামাবার আদেশ করে কোন একটা দোকানে ঢোকে, ফেরে পনের-বিশ মিনিট পার করে। এসময় যমুনাও গাড়ি থেকে নেমে তার সাথে যায়। সুম্মিতা ম্যাডাম কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে সঙ্গে যেতে নিষেধ করতে চেয়েও কী ভেবে পারেনা। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, আয়। আলীরাজের তখন কী যে ইচ্ছে করে ! -কী ইচ্ছে করে? কেন ইচ্চে করে? – কেন ইচ্ছে করবেনা? আলীরাজ কি একটা মানুষ না ? তার জীবনে কি কিছু সম্ভাবনা ছিলনা? ঐ যেসব তরুন-যুবক তার ম্যাডামের মুখোমুখি-পাশাপাশি দাড়িয়ে বসে আইসক্রিম খায়, হেসে গড়ায়, গালে টোনা দেয়, ম্যাডাম যাদের মধুরসে গলে গিয়ে বুকে পিঠে নরম মুঠির কিলটা চড়টা ছোঁয়াটা —-আহ! আলীরাজ আর ভাবতে পারেনা। ঐসব গোলগাল নন্দদুলালের চেয়ে আলীরাজ কম কীসে? দেহটা শুটকো? ছুঁচোমুখো? মুখে ব্রণের দাগ? রঙটা কালো? বাহারে বাহা! ওদের মত আলীরাজ যদি যখন তখন কপ কপ করে ভ্যানিলা-স্ক্রবেরী খেত, পিৎজা-পাস্তা সাঁটাত, নান-চিকেন-কাবাব-কারী দিয়ে সকাল বিকালের নাশ্তা সারত তাহলে বুঝি আলীরাজ এমন শুঁটকো ছুঁচোমুখো থাকত? আর ব্রণের দাগ? ম্যাডামের বন্ধুদের গালে বুঝি তা নেই? আর কালো রঙ নিয়েতো পুরুষের ভাবনার কিছু নেই; খোদ স্যারের গায়ের রংই যে —কই, স্যারের রং নিয়েতো অতফর্সা ম্যাডামের মনে কোন খেদ নেই। বরং তিনি নাকি স্বামীর চোখে আরো সুন্দরী হওয়ার আশাতেই মাসে দু’বার করে ‘উইমেন্স পার্ল’এ যাতায়াত করেন। 

বড়ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। কাগজসহ হালকা ছোট ব্রিফকেসটা মাথায় নিয়ে একটা টিপয় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে ঈঙ্গিত করে বললেন, ওগুলো নিয়ে যাও। আর শোন, গতকাল নাকি তোমার সাহেব প্রথম আলোর নকশাটা পায়নি, অথচ ওটাসহই নাকি পেপার তুলতে দিয়েছিল। তুমি কি নকশাটা সরিয়েছ ?

আলীরাজ এবার আর দুনিয়াতে নেই। তার দুকানে ভোঁ ভোঁ, নিঃশ্বাস বন্ধ। কী জবাব দেবে সে? কোন কথায় কী ঘটবে তার কিছুই সে বুঝে উঠতে না পেরে কেবল দু’দিকে মাথা নাড়তে যাবে এমন সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে রহিমার মা বুয়া। ‘ও আল্লাগো, হামার সব শ্যাষ অইলগো….. ও ভাবীগো, হামারে বাঁচান গো……’ বলতে বলতে বিশাল শরীরের রহিমার মা বড় ম্যাডামের নিটোল ফর্সা পা দুটো অজগরের মত জড়িয়ে ধরলতো ধরলই। তা রহিমার মা পা জড়িয়ে ধরাতেই কিনা আলীরাজ ম্যাডামের শাড়ির পাড়ে লুকিয়ে থাকা পা দুটো একঝলক দেখতে পেল। হ্যা, অবিকল গতকাল দেখা ছবিটার মতই। ম্যাডামের হাঁটু বরাবর মাথা কুটতে কুটতে রহিমার মা যে কী বলে চলে তা ঠিকমত বোঝা না গেলেও হতবুদ্ধি বড়ম্যাডাম পা ছড়াতে তৎপর হয়ে বলেন, ‘রহিমার মা, কান্না থামাও। আমি তোমার সব কথা শুনব। চল, কিচেনের ব্যালকনিতে চল। এখানে সাহেব এখন ব্রেকফাস্ট করবেন।’

রহিমার পা ম্যাডামের পা ছেড়ে দেয় কিন্তু তার মাথাকুটে কান্নাটা থামেনা। বাধ্য হয়ে সাহেব তার জলদমন্ত্র কন্ঠে বলেন, ‘কী হয়েছে?’ ‘ছার গো….’ দমকা কান্নার বাষ্প ছাড়া রহিমার মার কণ্ঠ থেকে আর কিছু বের হয়না। শেষে অনেক জিজ্ঞাসা, সান্ত¦না এমনকি মৃদু ধমক প্রদানের পর ছেঁড়াফাঁড়াভাবে সে যা বলল তা থেকে জানা গেল যে কে বা কার প্ররোচনার তার ‘সরল, নিষ্পাপ, ভোলাভালা ছাওয়াল’টা জিপিওর সামনে ককটেল ফুটাতে গিয়ে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে।

দুই

আলীরাজ এখন স্টিয়ারিঙে। স্যার এখন ব্যাকসিটে বসে গভীর মনে পত্রিকা দেখবেন- এই নিয়ম। পত্রিকার বাছাই করা অংশগুলো অর্থাৎ যেগুলো পড়বেন ভেবে তিনি বাসা থেকে বাছাই করে গাড়িতে তুলতে দেন সেসব এসময় পড়ে ফেলার কথা। স্যার অফিসে পত্রিকা পড়েননা। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে স্বাভাবিক সময়ে আধঘন্টার বেশি লাগার কথা না হলেও যানযটের কারণে তা লাগে প্রায় দেড়-দু’ঘন্টা। এ সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য কিংবা দুঃসহ যানজটের বিরক্তি থেকে রেহাই পেতে স্যার এই খুঁটিয়ে পত্রিকা পরার অভ্যাসটা গড়েছেন। সাধারণতঃ তিনি প্রথম ও শেষ পাতা, সম্পাদকীয় এবং আন্তর্জাতিক এই কটা পাতা নিয়ে আসেন। কদাচিৎ খেলার পাতাটাও আসে কিন্তু কালই প্রথম একটা নতুনরকম পাতা স্যারের বাছাই করা বান্ডিলের ভেতর থেকে উঁকি দেয়। নেহাৎ কৌতুহলের বশেই আলীরাজ সেটা খুলেছিল আর তখনই একটা দুর্দমনীয় লোভ তাকে সেটা লুকিয়ে ফেলতে প্ররোচিত করেছিল। কী এমন সোনাদানা তাতে লুকিয়ে ছিল যেজন্য আলীরাজ…..নাহ্, সোনাদানা কি আর পত্রিকার পাতায় আঁটা থাকে! খুবজোর সোনার ছবি ছাপা থাকে- জুয়েলারি দোকানে থরে-বিথরে সাজানো-ঝোলানো সোনার গয়না কিংবা বিমানবন্দরে ব্রিফকেসশুদ্ধ ধরাপড়া সোনার বিস্কুট। কিন্তু সেদিন ওসব সোনার ছবি নয়, সোনার নূপুরপরা একটিমাত্র পায়ের ছবি তাকে অতটা লোভী হয়ে উঠতে প্ররোচিত করেছিল। গোলাপের পাপড়ি ভাসা পানিতে সুগন্ধি মিশিয়ে পদচর্চার তরিকা বাৎলে মডেল হিসেবে ঐ পাটার ছবি ছাপা হয়েছিল। পায়ের পেছনে এত যতœ, এত অর্থব্যয়? বড় ম্যাডাম কি এসব করতেই পার্লারে ছোটেন? ছোট ম্যাডামও কি এসব করেন? তার পা দুটোও কি এত সুন্দর? তা সুন্দর হলেই বা তাতে আলীরাজের কি? কিন্তু ঐ পাতাটায় কী এমন বিষয় ছিল যা স্যারকেও আগ্রহী করেছিল? কে জানে!

স্যার আজ পত্রিকায় মন দিতে পারছেননা। বোঝাই যাচ্ছে অন্যমনষ্ক। কপালের বলিরেখায় গভীরতা – হয়ত কিছু ভাবছেন। অন্যমনে মোবাইলের বাটন চাপাচাপি করছেন। রিয়ারভিউ মিররে স্যারের কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখা যায়। তা দুশ্চিন্তা হবে নাইবা কেন? – দেশের যা অবস্থা! কখন কি ঘটে তা কে বলতে পারে। দিনকাল ভাল নয়; স্টিয়ারিঙে থাকাকালে আলীরাজই দুশ্চিন্তায় থাকে তো স্যার! সাধে কি আর আলীরাজ সারাক্ষণ এয়ারফোন কানে পুরে থাকে? শুধুই কি প্রেমের গান কি পপ-র‌্যাপ শোনে? এফএম ব্যান্ড, কমিউনিটি রেডিও এদের চটকদার কথাবার্তার সাথে খবরের আপডেট আলীরাজকে সর্বক্ষণ তথ্যসমৃদ্ধ রাখে। বরং স্যার মাঝেমাঝে আলীরাজের কাছ থেকে সর্বশেষ ঘটনা-দুর্ঘটনাটা জেনে নেন।

‘শোন, আমি অফিসে যেয়েই রহিমার মার ছেলেটার ব্যাপারে তদ্বিরের চেষ্টা করছি। আমাদের ডিএমডি এইচআর এর এক ভাগ্নে র‌্যাবের বড় পোস্টে আছে। দেখি কী করা যায়। আর সুস্মির আজ কোচিংয়ে যাওয়ার দরকার নেই, আমি আলীকে আজ ছাড়ছিনা।…… না, না, রিক্সায় করে যাওয়ার কী দরকার…….. একদিন কোচিংয়ে না গেলে কী এমন……না, না, ওকে বোঝাও। জীবনের চেয়ে কি কোচিং…….দেশের অবস্থা বুঝছনা?’

হ্যা, তাহলে ম্যাডাম সুস্মিতার আজ আর বাইরে যাওয়া হচ্ছেনা। ভালই হল। রাপা প্লাজার সামনে দাঁড়ানো সেই মোরগঝুঁটিঅলা চারচোখাটা আজ হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে এলোমেলো পায়ে সিটি কলেজের দিকে হাঁটতে শুরু করবে। বাছাধনের যা বয়স তাতে বাপের কাছ থেকে গাড়ি চেয়ে নিয়ে প্রেম করে বেড়াবার সাহস নেই কিংবা কে জানে- হয়ত বাপের গাড়িই নেই, কেবল চেহারার আলগা চটকটাকে পুঁজি করে ম্যাডামের চোখে পড়ে গেছে। তাই হবে হয়ত। নইলে অত ঠাঁটবাটঅলা চেহারা-সুরত নিয়ে পায়ে হেঁটে রাপা-সিটি করে কেন- পথতো নেহাত কম নয়। গাড়ি না থাক, রিক্সায়ওতো চড়তে পারে। কিন্তু আলী যতদিন তাকে দেখেছে হেঁটেই যাতায়াত করতে দেখেছে। কে জানে মেদ কমানোর খায়েশ কিনা- যেমন তার স্যার করেন। ছোটখাটো কোন দুরত্বে স্যার কখনোই রিক্সা নেননা, গাড়ি বের করাতো দূরের কথা। কিন্তু ঐ চ্যাংড়ার শরীরে অত মেদইবা কোথায় যে তাকে …..কে জানে সে আলীরাজ গ্রুপের কেউ কিনা! 

কথাটা মনে হতেই আলীরাজের বুক কেঁপে ওঠে। রাজপুত্র রাজকন্যাকে পঙ্খীরাজে চড়িয়ে উড়াল দেবে এই চিরকেলে শিশুতোষ গল্পে অভ্যস্ত মনে রাজকন্যার প্রতি খায়েশ যতই জাগুক অর্থনৈতিক মানদন্ডে শ্রেণীবিভাজিত সমাজে বেড়ে ওঠা তরুণের মনে রাজকুমার বনবার দুরাশা তত জাগেনা। তাছাড়া রূপকথার স্বয়ম্বরসভার রাজকন্যারা চিরকাল যেসব বীরের গলাতে মালা দেয় তারা অক্ষত্রীয় হলেও সহিস, ড্রাইভার টাইপের কেউ নয়। কিন্তু হাল আমলের বাংলা ছায়াছবি সে ফ্যান্টাসিও পূরণ করেছে। কাজেই আলীরাজ শ্রেণীর কারো পক্ষে ম্যাডামের দাক্ষিণ্যলাভের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায়না। ঈর্ষায়-হিংসায় আলীরাজের হৃদয়টা এখন পুড়তে শুরু করে। ইস্! এ চিন্তাটা এতদিন কেন তার মাথায় উঁকি দেয়নি?

ধনীলোকে নিয়মিত পোলও-কোর্মা খায়, গরীবের কানে এ গল্প স্বাভাবিক শোনায়। কিন্তু পাশের বাড়ির গেদু কিংবা ফুলি ফকিন্নি রুইমাছের কালিয়া দিয়ে পেটপুরে ভাত খায়- এ যে সাংঘাতিক খবর! এ খবর হজম করে নীরোগ-সুস্থ জীবনযাপন করা অজীর্ণ রোগগ্রস্ত বাঙালীর পক্ষে কতটা সম্ভব?Ñ আলীরাজের আর দোষ কি? সে যদি এসময় (ম্যাডাম সুস্মিতার পদস্খলনের ক্ষোভে) ভেতর থেকে পুড়তে পুড়তে তীব্র দাহ যন্ত্রণায় বেসামাল হয়ে গাড়িটাকে ফুটপাত কি আইল্যান্ডে তুলে দেয় কি একটা সাত টনী ট্রাক বা লরীর পেটে ঢুকিয়ে দেয়তো সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আদিল সাহেবের নসীবে আরো অনেক নাটক, জীবনযাতনা অপেক্ষা করছিল বলেই হয়ত এ দুর্ঘটনায় তার তেমন বেশি শারিরীক ক্ষতি হলনা। একটু কপাল কেটে যাওয়া বাদ দিলে তিনি প্রায় অক্ষত দেহে আধভাঙ্গা গাড়ি থেকে নিজে নিজেকে উদ্ধার করলেন। গাড়ির সামনের বনেটটা পুরো ধ্বসে গেলেও অদ্ভুতরকম কপাল জোরে আলীরাজের কিছুই হলনা। স্তরীভূত কাচের অগণন সংখ্যক টুকরো ও চূর্ণের ভেতর থেকে সে যেভাবে উঠে এল তা সুপারম্যানকেও হার মানায়। দুর্ঘটনাটা ভিআইপি রোডে হওয়ায় গাড়ি ও চাকরি ছেড়ে চম্পট দেয়ার সুযোগ সে পায়নি। তবে স্যারের বসের সেই ভাগ্নের জোরেই হয়ত থানা হয়ে বাসায় ফিরতে তার ঘন্টা কয়েকের বেশি লাগেনি।

সকালবেলা রহিমার মায়ের আহাজারি দিয়ে যে দিনের শুরু হয়েছিল তা শেষ হল মিসেস আদিলের বুকফাটা আর্তনাদে। থানা থেকে ভাঙ্গা গাড়ি ও আস্ত ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে নিয়ে আহত, ক্লান্ত, অবসন্ন আদিল সাহেব আধমরাভাবে ঘরে ঢুকে স্ত্রীর শতেক প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর থেকে যখন সারাদিনের অভুক্ত পেটে একগ্লাস পানি চালান করছিলেন তখনই ফোনটা এল। ফোন হাতেই আদিল সাহেব মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন।

তিন

বার্ন ইউনিটে আদিল সাহেব পুত্রের শিয়রে প্রায় বিধ্বস্ত বস্তার মতই পড়ে আছেন। গত তিনদিন ধরে ছেলেটাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলায় তিনিও এখন প্রায় যমের অনুগামী হতে চলেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সামিউল আদিল শোভন হলে থেকেই পড়াশুনা করত। কেবল ছুটিছাটাতে সে তাদের উত্তরার বাসায় যেত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দরুণ গত কয়েক সপ্তাহ সে বাসামুখো হয়নি। কিন্তু কেন যে ঐ দিনটিতে সে অবরোধের মধ্যে নানা বিকল্প উপায় অবলম্বন করে ঢাকা শহরের উদ্দেশ্য পাড়ি জমিয়েছিল তা আদিল সাহেবদের জানা নেই। টাকা পয়সার সমস্যা হলে মোবাইলেই জানতে পারত, বিকাশ করে পাঠানোও যেত, অন্যকোন প্রয়োজনÑ যেমন, একটু ভাল খানাপিনা কিংবা বাবা-মা-বোনের সাহচর্য কিংবা এমনিই কিছু —–না, কিছুই জানা যায়নি। ছেলেটা তাদের কাউকে কিছু না জানিয়েই মহানগরের পথে রওনা করেছিল, কিন্তু ঘাতক পেট্রোল বোমা তাকে গাবতলীতেই থামিয়ে দিয়েছে। এখন এইযে সে বার্ন ইউনিটে ৮০ ভাগ পোড়াদেহটার প্রায় পুরোটাই ব্যান্ডেজে ঢেকে বীভৎস্য কাপড়ের স্তুপের মত পড়ে আছেÑ জীবিত কি মৃত তাও ঠাহর করা যাচ্ছেনা; এর কাছ থেকে কি কোনদিন জানা যাবে যে কেন সে দেশজোড়া অবরোধের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ঢুকতে চেয়েছিল ? 

আদিল সাহেবের স্ত্রী গত তিনদিন ধরে চেতন- অচেতনের মাঝামাঝি জগতে কোন মতে ঝুলে আছেন। সুস্মিতা কখনো বাসা, কখনো হাসপাতাল করে দুঃসহ দমবন্ধ সময়টা পার করছে। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের গাড়ি মাঝে মাঝে তাকে লিফ্ট্ দিচ্ছে। যে আলীরাজের হাত ধরে তাদের সিরিজ দুর্ভাগ্যের সাথে প্রথম মোলাকাত সে এখন সাহেবের নানা আদেশে দিগি¦দিক ছুটোছুটি করছে। অত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটাবার পরও এই যে তার চাকরি এখনো বহাল আছে সে তো শোভনস্যারের এই বিপদের বদৌলতেই, নয় কি? কাজেই শোভনের জন্য যেকোন রকম কষ্ট স্বীকারে তার এখন দ্বিধা নেই। অন্যসময় শোভনের প্রতি তার মনোভাব যাই থাক এখন সে কায়মনোবাক্যে তার আয়ু কামনা করে। শোভন যে কোন একসময় সুস্মিতার প্রতি আলীরাজের বিশেষ দৃষ্টিপাত পর্যবেক্ষণ করে ক্ষেপে গিয়ে চাকরিচ্যুতির চেষ্টা করেছিল এ ব্যথা সে ভোলেনি। নেহাত বড়স্যারের সরল অথচ ঋজু স্বভাবের দরুণ সে যাত্রা সে বেঁচে গিয়েছিল। যেসব কানপাতলা লোকেরা কোন একটা কথা উঠতেই বিনাপ্রমানে বিশ্বাস করে বসে তাদের দলে তিনি পড়েননা। প্রমাণবিহীন বিচার কিংবা দুর্বল চরিত্রের সাক্ষীর সাক্ষে ভরসা করে রায় প্রদান করার মত মানুষ তিনি নন। বিচারের ন্যায্যতা রক্ষার ব্যাপারে তার অতি সজাগ মনোভাবের কারণেইনা আলীরাজের চাকরি এখনো বহাল।

এখন শোভনস্যার যতদিন টিকে থাকবে ততদিন আলীরাজ এ বাসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার পরে ভরসা না করে স্যারের অন্যগতি নেই। বিপদের খবর পেয়ে স্যারের যেসব আত্মীয়-বন্ধু এসে জুটেছে তারা সবাই কিছুক্ষণের সঙ্গী। কেউ এসেছে সান্ত¦না দিতে, কেউ বা শুধু চোখের দেখা দেখতে। দেশব্যাপী অবরোধের কারণে গ্রামের আত্মীয়দের আসার সুযোগ নেই। আর তারা এলেই বা কী করতে পারত? আলীরাজ যেমন এই পরিবারের প্রয়োজন এবং ঢাকা শহরের গলি খুঁজি সব হাতের তালুর মত পড়তে পারে, গ্রাম থেকে হঠাৎ উঠে আসা আত্মীয় কি তা পারে? কাজেই শোভন স্যারের আয়ু হাসপাতালের আইসিইউতে ঝুলতে থাক, আলীরাজ এই সুযোগে তার মোক্ষম দাওটা মারুক। শোভন যদি পুরোপুরি মরে যায় তাহলে আলীরাজের প্রয়োজনটাও এ পরিবারে কমে যায়। আলীরাজের স্বপ্ন সাধ পূরণের সুযোগের পূর্বে শোভনের মৃত্যু তাই আলীরাজ চায়না। কেনা জানে যে অর্ধমৃতের জন্য মানুষের যে সীমাহীন উৎকণ্ঠা থাকে পূর্ণমৃত্যুর ফলে তার অবসান ঘটলে যে সীমাহীন শোক ও হতাশাজনিত শুন্যতাবোধ তৈরি হয় প্রাকৃতিক লঘুচাপের নিয়মে চারপাশ থেকে সান্ত¦না এসে সে শুন্যস্থান ভরিয়ে তোলে। তখন শোক কাটিয়ে মানুষের চোখ কান খুলতে কতক্ষণ? কাজেই যা করার আলীরাজকে দ্রæত করতে হবে। ৮০% পোড়া রোগী কয়দিনইবা টেকে! 

প্রায় হতচেতন আদিল সাহেবের সেলফোনে আরেকটা বিশেষ কল এল এদিন বেলা এগারোটায়। ফোন পেয়ে আজ আদিল সাহেব কাউকে কিছু বললেন না। মাছের মত নিষ্পলক শুন্য চোখে চেয়ে তিনি যে কী ভাবতে থাকলেন সে বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করার মত কেউ তার কাছে ছিলনা। এভাবে কতক্ষণ থাকার পর আবার ফোনটা বেজে উঠতেই তিনি সচেতন হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আলীরাজকে ডেকে জানালেন যে বিশেষ কারণে তাকে এখনই অফিসে যেতে হচ্ছে। সে যেন ম্যাডামের দিকে খেয়াল রাখে। মিসেস আদিল গত তিনদিন ধরে প্রায় অভুক্ত, অস্নাত ও নির্ঘুমভাবে আইসিইউ এর সামনে পড়ে রয়েছেন। এ মুহূর্তে রোগীর চেয়ে তার দিকে লক্ষ্য রাখাটাই অধিক জরুরী বলে আদিল সাহেবের বোধ হল কারণ রোগী আছে হাসপাতালের দায়িত্বে কিন্ত রোগীর অভিভাবকের ব্যাপারেতো আর তাদের কোন দায় নেই। 

অফিসে এসে আদিল সাহেব ঘটনার গুরুত্ব আঁচ করে শিউরে উঠলেন। হঠাৎ কল করা মিটিংয়ে এমডি ও চেয়ারম্যানের থমথমে মুখ বলে দিচ্ছিল যে তারা কতবড় সর্বনাশের মুখে পড়ে গেছেন। তাদের প্রধান ওয়্যারহাউজে কে বা কারা গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে কয়েক কোটি ডলারের সম্পদ। অবরোধের কারণে সময়মত শিপমেন্ট না হওয়ায় ওয়ালমার্টের চালানের পুরোটাই ওয়্যারহাউজে রক্ষিত ছিল। তারমানে কোম্পানী এবার পুরা পথে না বসলেও মুখ থুবড়ে পড়ার হুমকির মুখে। 

আগুন ধরেছে ভোররাতে। সকাল না হতেই সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রথমে ঘটনাস্থলে, অতঃপর অফিসে এসে জমা হয়েছে। একমাত্র আদিল সাহেবকেই বেলা এগারোটায় খুঁজে পেতে হায়ার করে আনতে হয়েছে। তার প্রতি এমডির উষ্মা তাই অপ্রকাশ থাকেনা। যদিও প্রায় সবাই তার ছেলের বার্ন ইউনিটে দাখিলের খবর সম্পর্কে অবগত তবু সবাই ড্যাবডেবিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে। -আশ্চর্য! সেই ভোর থেকেই সব টিভি চ্যানেলে যে ঘটনা লাইভ দেখাচ্ছে এই লোকটা তা এগারোটা নাগাদও জানতে পারেনি? একথাটা প্রায় কারো মনেই উদয় হয়না যে আইসিইউ এর সামনে টিভি থাকেনা; আর যার পুত্র আইসিইউতে, তার জাগতিক খবরে উৎসাহ থাকেনা। 

অনিবার্য কারণবশতঃ সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সকলপ্রকার ছুটি বাতিল ও অফিসিয়াল জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে এমডি, চেয়ারম্যানসহ বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সব প্রতিনিধি গিয়ে দাঁড়ালেন রাজপথে। দেশব্যাপী অরাজকতার দায় যারই হোক সরকারের কাছে তাদের প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও চলমান ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানাবিধ সুযোগসুবিধার সহজপ্রাপ্যতার দাবীতে তারা সোচ্চার। 

অফিসে বসে ওয়্যারহাউজে রক্ষিত মালামালের বাস্তব পরিমানের সাথে ইন্স্যুরেন্সের কাভারেজ মিলিয়ে একটা লাভযোগ্য এস্টিমেট তৈরি করতে করতেই তিনি তার জীবনের সর্বশেষ ফোনটি পেলেন যা তার ইহলৌকিক জীবনের সকল আস্থা-ভরসা, আশা-ভালবাসা, স্বপ্ন-সাধ- এককথায় যা কিছু মানুষের মনুষ্যজীবনবোধকে এগিয়ে নেয় তা একলহমায় বিলুপ্ত করে আপন জীবনের কাছে আপনাকে দেউলিয়া প্রতিপন্ন করে দিল। ফোনের খবরটি সংক্ষেপে এইঃ 

সুস্মিতাকে তার ঘরে নগ্ন ও মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ড্রাইভার আলীরাজকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

মন্তব্য: