সাদা ক্যানভাস
ক্যানভাসটা সাদা ছিল।
কোথা থেকে, কী আঁকবো প্রথমে? সেটা ভাবতে ভাবতে
তুলিতে রঙ শুকিয়েছি জীবনভর।
ক্যানভাস থেকে চোখ ফিরিয়ে যতবার সোৎকণ্ঠে
তোমার দিকে ফিরে চেয়েছি, ততবার
তোমাকে সোন্দা গন্ধে বর্ণিলই দেখেছি।
যেখানেই চোখ রেখেছি তোমাতে, তোমার সব কিছুই
সমানভাবে সুন্দর ও মায়াময় হয়ে উঠেছে!
কোনো একটা কিছুকে আলাদা করে
অন্য কিছুর সুন্দরকে অতিক্রম করতে পারিনি।
না চোখ, না টোলপড়া মুখের বাঁকানো ঠোঁট
কিংবা গ্রীবা থেকে নেমে যাওয়া সুরেশ্বরীর সোমত্ত যৌবন হয়ে
পা অব্দি; কোনো কিছুই নয়। তাই
কি দিয়ে আঁকতে শুরু করবো,
সে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি তুলির জীবনে।
তবু ক্যানভাসটায় তুলির আঁচড় না পড়লেও দেখি,
সম্পূর্ণা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কী ভীষণ রঙে, এই সাদা ক্যানভাসে!
ছুটছি আমি কোন সে টানে
ফাগুন হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে বইয়ের একটা পাতা
কি ছিল তাতে লেখা? ডানার কথা!
প্রজাপতির রঙের কথা? উড়ছে কেন?
যাচ্ছে কোথায়? বনের ধারে, আগুন ধরা বনের শাখে?
আমিও কি ছুটছি তারই পিছু? ছুটছি কেন?
কি আছে টান? কেনই বা টান?
বনের শাখে লাগলে আগুন, আমার কি তা?
আমি কি আর প্রজাপতি? ফাগুন প্রেমে পাখনা মেলি?
আমি জানি বৈশাখী ঝড়, সব চুরমার, ওলট-পালট
ধ্বংসলীলা। ফাগুন প্রেমে কী আসে যায়?
তবু আমি ছুটছি কেন পাতার পিছু?
ছুটছি আমি, ছুটছি আমি…
তাহলে কি পাতার ওপর লেখা আছে- আমার কিছু?
ভালোবাসা জলপূর্ণ নারীর মতো
রোদের বসনে শরীরটা মুড়িয়ে বেরিয়েছি বর্ষার খোঁজে
হাঁটতে হাঁটতে দেখি জলশূন্য একটা দীঘি, ঠিক হ্রদের মতো।
যার জমিন চিরে অসংখ্য ফাটলের ভেতরে বিষণœ দুপুর
দুপুরের বুকে শুধুই আর্তির কথা… জল চাই… জলের তৃষ্ণা…!
আমার শরীর ন্যুয়ে পড়া ঘামের স্রোত থেকে
ক’ফোঁটা জল দিয়ে আবারও রোদের বসনে ঘিরে
হেঁটে চলি বর্ষার খোঁজে।
চলতে চলতে একটা নদী, নদীর বুক ভরা শুধু বালির বহতা
বয়ে চলে অগ্নিবাতাস, জল নেই!
আমি ক’ফোঁটা চোখের জল রেখে
ফিরে আসি কাক্সক্ষার ছায়ার ঘরে।
ঘর এক নারীর মতো। নারীহীন ঘর মরুভূমির মতো!
নারীও আজ জলশূন্য!
জলশূন্য তাঁর বুক, জলশূন্য তাঁর চোখ ও ঠোঁট
শূন্যতা মানে ভালোবাসাহীন,
ভালোবাসাহীন চৌচির দুপুর।
রোদের বসনের নিচে লুকানো বুভুক্ষু জলের তৃষ্ণা
জল চায়… বর্ষা চায়।
বর্ষার জলের বহতায় ভালোবাসা বহমান
ভালোবাসা জলপূর্ণ নারীর মতো। নারী জীবনের মতো!
কন্যা, তীর্থ সমাধিতে
গল্পের সিঁড়ি টপকে টপকে কন্যা যাচ্ছে তীর্থভূমে
আঠারো বছরের গল্প জমা আছে ওর ভেতরে
গল্পগুলোকে আরো আরো গল্প বানিয়েছে ভেতরে ভেতরে
দীর্ঘপথ তাকে কোনো ক্লান্তি পরাজিত করে না
একটা একটা করে সিঁড়ি টপকাচ্ছে সে
একটু একটু করে স্বপ্নের বরপূত্র তার নিকটবর্তী হচ্ছে!
আমি কন্যার মুখের দিকে তাকাই আড়ালে আবডালে
বুঝে নেই, ওর গল্পগুলো ডানা মেলতে শুরু করেছে
গল্পগুলো সবুজ ধানের অফুরান মাঠের মতো
গল্পগুলো দূর গায়ের শ্যামলিমা তরুর মতো
সিঁড়িগুলো একটা একটা নদীর সেতুর মতো
সিঁড়িগুলো একটা একটা কাল আর মহাকালের মতো
কন্যা মধুমতির বাতাসের আর্দ্রতা অনুভব করলো।
কন্যার বয়স তখন অনেকগুলো আঠারোর সমান হয়ে গেলো
ওর ভেতরের গল্পগুলো ভ্রমণরেখার বাঁক-প্রান্তরে মিলিয়ে নিলো।
সমস্ত সিঁড়ি পেরিয়ে কাল মহাকালের এক সন্নাস বুকে নিয়ে
টুঙ্গিপাড়ার তীর্থ সমাধিতে প্রবেশ করলো কন্যা।
তার বুকে জমানো সমস্ত গল্প মহাগ্রন্থ হয়ে এক হয়ে গেলো
তার মৌনতার শ্রদ্ধার্ঘে আমিও তার সাথে দু’হাত তুলে দাঁড়ালাম
কন্যার মুখের মহাগ্রন্থের মলাটে দেখি,
জ্বলজ্বলে এক নাম, শেখ মুজিবুর রহমান।
দৃশ্যের মাঝে অদৃশ্যের ফারাক
একটা নদীর এপার ওপার দুইটি তীর
মানুষের কি তেমনই?
এই যে আমি হাসছি যেমন
ভাবছি যেমন, দেখছি যেমন
মাঝখানে এক নদীর মতোই ঠিক ব্যবধান
কিংবা কোনো জোড়লাগা এক চিহ্নচিড়!
একটা নদীর এপার ওপার দুইটি তীর
একটা পাখি এক জীবনে এক থাকে না
সঙ্গি থাকে, জীবন যাপন চেনা জগত,
প্রেমপার্বন- কী থাকে না? সুখ শ্রাবণের মেঘ আকাশে
উড়াল ডানার দখল নিয়ে পাখিরাই তো ভাসতে থাকে
তবু কিন্তু হয় না মিলন ডানায় ডানায়, কী ব্যবধান!
স্বপ্নপাখির সুরগুলো তাই এক থাকে না
একটা পাখি এক জীবনে এক থাকে না।
পাখোয়াজ
তালবৃক্ষের সারি সারির নীরব আখ্যানে
কোন পাখোয়োজ দাঁড়িয়ে আছে কালের প্রবাহে?
কালের প্রবাহ ধরে দেখি, পুকুরের চোখে জেগে থাকে
প্রতিবিম্বের সবুজ আলপনা।
আলপনার জল্পনায় সূর্যের আলো এক নটরাজ;
মঞ্চ এক জলের আয়না।
আমিও ঝুঁকে ঝুঁকে আয়নার বুকে দেখি,
প্রেমহীন ক্ষতচিহ্নের চারযুগ অধিক; অথচ
মঞ্চের গভীরে মীনদের সংসারের আবডালে কত না
খুনসুটি, প্রেম-প্রজনন!
এ সবই সূর্যের আড়ালে মঞ্চের গভীরের পেছনের কথা, আর
মঞ্চের দৃশ্যায়নে রঙ ও রঙ্গের আতিপাতি খেলায়
চরিত্রপ্রধান নটরাজ আলোকিত করে রাখে
মোহগ্রস্ত ঝলকানির পোশাকে-
কিংবা চোখের কম্পন পলক মাত্রায়।
সূর্য ডুবে গেলে হিম অন্ধকারে জেগে ওঠে যুগের ক্ষতরা।
ক্ষতদের রঙ নেই, রঙ্গ নেই- আছে করুণ বিষাদ!
তালবৃক্ষের দীর্ঘ সারির প্রতিবিম্বের জলের আয়নার অন্ধকারে,
কী অনাদরে জেগে থাকে আলোহীন খাঁচাবন্দি বুকের ক্ষত!
বুকের ক্ষতের আবডালে অন্ধকারে
কোন পাখোয়াজ দাঁড়িয়ে আছে এক পায়ে!
সংকল্পহীন সম্পাদকীয় অথবা মৃত্যুর পথে
রেল লাইনের জীর্ণ চলার পথে
অবহেলার অগণিত মৃত্যু পথ পেরিয়ে
হুপিং কাশির খকখক রোগীর মতো ট্রেনটি ছুটে চলেছে।
কোনো এক লক্ষ্যে বা অলক্ষ্যের যাত্রার অবহেলার হাতছানিতে
আমি সেই ট্রেনের বারবার বেঁচে যাওয়া যাত্রী এক!
ভাঙা জানালার অবরোধ মিশ্রিত আলোর দৃশ্যে
বৃক্ষসারি কিংবা মাঠের প্রতিশ্রুত শস্য ফলানো বিস্তীর্ণভূমে
সংকল্পহীন মুদিত চোখ মেলে দেখি,
সবই ফিরে যাচ্ছে ফেলে আসা পথে গতির ফাঁকির মন্থরে!
যেন জীবন এক ফাঁকির টোপর পরা ফেলে আসা যাপিত জীবন।
জীর্ণ মৃত্যুপথে সংকল্পহীন এই যাত্রাপথের মানব-মানবীরা
বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে কবিতার প্লট হয়ে ছন্দহীন কলমে কলমে
অকাব্যের স্তূপ আকারে পৃথিবীর বোঝারূপে ভাগাড়ে ভাগাড়ে
দুর্গন্ধের পাহাড় হয়ে আকাশ অবধি উঠে যায় নির্লজ্জের মতো।
ট্রেনটির যাত্রাপথে স্টেশনের নামগুলো চোখের অস্পষ্ট ছানিতে
ভাসতে থাকে নির্মম জীবনের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার ভুলে।
ট্রেনটি এগিয়ে যায় মৃত্যুপথ পেরিয়ে আমৃত্যুর পথে…
নিরর্থক কাচের মুখোমুখি
আমি কাচ হয়ে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি
তুমি যা করো, এক অনুগত বালকের মতো
আমিও তোমাকে অনুসরণ করি।
তুমি হাসলে আমি হাসি, কাঁদলেও তাই
আমার মধ্যে থেকে নিজেকেই দেখো রোজ রোজ
আমাকে দেখো না, আমাকে চূর্ণ চূর্ণ করে দাও
কোটি কোটি রূপে! আমিও কোটি কোটি চোখ দিয়ে
তোমাকে দেখি, তুমি দেখো নিজেকেই।
প্রতিদিন কোটি কোটি অনুগত বালকের জন্ম দাও তুমি
অথচ তারা কেউ-ই যুবক হতে জানে না,
তুমি শুধু নিজেই অপরূপা হও- নিরর্থক,
কেউ যুবক হয়ে ওঠে না।
একা মানে সঙ্গীহীন নয়
আমি প্রতিদিন একবার একবার করে একা হই
একটু একটু করে দূরে চলে যাই
আমি প্রতিক্ষণ যদি একা হয়ে যাই
চিরকাল যদি দূরে চলে যাই; তখন
ভেবো না আমাকে সঙ্গীহীন কোনো দূরবাসী।
আমি তখনই নিবিড় হই ভালোবাসবার;
আমার ছটফট ডানার গতি
তোমাতেই লক্ষ্য করে ছুটে যায় বারবার।
আমি তোমাতে প্রবিষ্ট হই, তুমি হও আমাতে
একা মানে সঙ্গীহীন নয়, একাকার ভালোবাসবার।
অনধিকার
বড় বেশি গভীরে যেতে নেই।
হাঁটতে হাঁটতে বড়জোর বেলাভূম পার হওয়া যায়;
জেনে রাখো, দ্রাঘিমা পার হতে নেই।
বেশি কিছু লিখতে নেই।
লিখতে লিখতে পাতা পেরোতেও নেই।
হাতের দু’একটি রেখায় এঁকেবেঁকে নিতে পারো চোখ;
তার বেশি নয়।
জ্যোতিষবিদ্যায় রেখো ভয়।
পূজার প্রসূন থাক দেবীর বেদীতে;
মাথা খুঁটে মরো না সেই সমাধিতে।
বেশি মাখামাখি ভালো নয় মোটেও
জলটুকু জল থাক শুধু;
মুদ্রার ওপারে বাজে, ভুলের নিক্কন ধু ধু।
বেশি গভীরে যায় না আলো
জেনে রাখো, আলোর গভীরেও আঁধার কালো
ভালো বাসতে বাসতে বড়জোর মরে যাওয়া যায়
বেঁচে থেকে থেকে ভালোবাসা হয় না পূরণ
খুব বেশি হলে, মৃত্যু মৃত্যু ছায়ায়
দ্রাঘিমায় পৌঁছানো যায়।
সন্ধ্যা তবু প্রেমময়
সন্ধ্যা এক নিয়ত আশ্চর্য!
সে যে কোন পক্ষের, কখনো জবাব পাই নি।
না রাতের, না দিনের।
দিনের কার্য বিলাস অথবা ক্লান্তি সন্ধ্যাকে হাতছানি দেয়।
আবার রাত এলে পিছে ফিরে চলে যায় অবলা কথায়।
ধরে নেই সন্ধ্যা এক ভাষাহীন রমণী।
ক্লান্তি জুড়াতে প্রশস্ত বুক আছে তার,
রমণ ক্রিয়ায় ভীষণ শৈল্পিক ও আবেদনময়ী।
এ ক্ষেত্রে সন্ধ্যা হচ্ছে, প্রেম ও মিলনের অমোঘ বন্ধন।
হতে পারে সন্ধ্যা শুয়ে থাকা সাগরের মতো,
বুকে তার অবিরত ঢেউ।
আমি তো এই সন্ধ্যার অপেক্ষায় ক্লান্তি ছিঁড়ে ফেলে
ছুটে যাই দৃষ্টির অনন্তে…
আমি তো দিনের এক ক্লান্ত প্রেমিক।
দেখি, প্রসারিত বুকে বিগলিত সন্ধ্যার রঙের ঝলক!
সন্ধ্যা তাকিয়ে থাকে আকাশের পানে, কত রঙে প্রেম প্রলোভনে।
কিন্তু সন্ধ্যা তো রমণী নয়!
ছুঁতে ছুঁতে রাত থেকে রাতে গভীর রহস্য মায়ায়
কোথা যেন চলে যায় নটিনী তরঙ্গে।
আমি তার পক্ষ চিনি না। জানি না রহস্য কোনো।
তবে সন্ধ্যা রমণী নয়, আশ্চর্য রমণীর মতো!
না দিনের, না প্রেমিকের।
রাতেরও নয়, তবু সন্ধ্যা প্রেমময়।
লুকোচুরি
এই কথা শুনে নদীতে গেলাম
ভরা নদীর জলে একটা নৌকা!
একটা না, অনেকগুলো নৌকা। আমাকে বললো,
আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি
তুমি লুকোচুরি খেলতে ভালোবাসো?
না ভেবেই বললাম, শৈশবে বন্ধুদের সাথে
একবার প্রেম হয়েছিল
নৌকার নিচের জল
তখন চাঁদের সাথে ঢেউ রসিকতায় লিপ্ত।
আমার কথা শুনে হেসে ওঠে জল!
বলে, তবে আর ভয় কেনো?
আমি এবার সত্যিই ছোট হয়ে গেলাম,
একেবারে শৈশবের মতো।
শিশুসুলভ হাতটা কখন যেনো জলকে ছুঁয়ে দিলো
অমনি আমি চাঁদ হয়ে গেলাম!
আমার হৃদয়ে তখন জলের লুকোচুরি
ভেতরে ছলাৎছল!