হাড়ের কোরিওগ্রাফি- মূলত জীবন-বাস্তবতার কোরিওগ্রাফি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

গালিব রহমান

মানুষের ভাবনা ও অগ্রগতির ইতিহাস যতো পুরোনো সাহিত্যের ইতিহাসও ততটাই পুরোনো। মানুষ যেদিন ভাবতে শিখলো সেদিন থেকে পরিবর্তন অগ্রগতির সূচনা হলো। নিজেকে অন্য প্রাণিদের থেকে আলাদা করে ফেললো। এই ভাবনার ফলেই মানুষ নিজেদের ও পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। ভাবতে ভাবতে জন্ম দিয়েছে মিথের, দর্শনের, কেচ্ছা ও কবিতার। যদিও মানুষ তখনো বুঝতে শেখে নাই কোনটা সাহিত্য কোনটা বিজ্ঞান। কালে কালে তার বিভাজন হয়েছে। গঠন, রূপ, স্বাদ আলাদা হয়েছে কিন্তু উৎস এক, প্রকৃতি। ভাবনা ও দর্শনের পথ বেয়ে যা আবিষ্কার হয় তা বিজ্ঞান। এই ভাবনা ও দর্শনের ভেতর দিয়েই তৈরি হয় সাহিত্য তথা কবিতা। কবিতায়ও বিজ্ঞান ও ইতিহাস থাকে, যদিও তা পাঠকের কাছে স্পষ্ট নয়। কেননা কবিতার ভাষাশৈলী, ছন্দ ও তার সৌন্দর্য আলাদা। যা বিষয়কে ইন্দ্রিয় থেকে অতীন্দ্রেয় পৌঁছে দেয়। ফলে পাঠক কবিতা পাঠে দোলায়িত হন, ভালোলাগা তৈরি হয়, বোধে কম্পন অনুভূত হয়, অন্য এক ভাবনায় নিজেকে ধাবিত হতে দেখে। এসব অবশ্য প্রকৃত কবিতার জন্য প্রযোজ্য। ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ এই ছন্দবদ্ধ কথাটি বহুল ব্যবহৃত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সূচনা বলেই জানি। এর মধ্যে প্রকৃতি বর্ণনা যেমন আছে তেমনি বিজ্ঞানও আছে। কবিতার সাথে বিজ্ঞানের সাযুজ্য প্রমাণ করবার জন্য আমার এ লেখার অবতারণা নয়। আজকের আলোচ্য বিষয় কবি তুষার প্রসূন-এর কবিতাগ্রন্থ “হাড়ের কোরিওগ্রাফি”। কবির বিজ্ঞানমনষ্ক ভাবনার প্রতিফলন পাই গ্রন্থটিতে। এর ফলে উপরোক্ত কথাগুলো বলা। যদিও আমি কবিতা খুব বুঝি না, বুঝবার চেষ্টা করি। ‘হাড়ের কোরিওগ্রাফি’র বেশ কিছু কবিতা এ লেখায় মনোযোগী করে তুলেছে।

‘কিছু হাড় পাঠিয়ে দিতে, নিজের মতো করে নিজেকে বানিয়ে নিতাম।’ সূচনা কবিতা ‘কষ্টের যাদুবাস্তব সান্তনা’র প্রথম লাইন। যা পাঠে এক ভিন্ন অনুরণন তৈরি হয়। এতকাল পড়া কবিতার মতো নয়, অন্য কিছু। বাক্যটিকে আপাত সরল মনে হলেও বাক্যের গভীরতা ও গন্ধ যেমন সামাজিক দুর্ভিসহতার ইংগিত দেয় তেমনি বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত করে। আধুনিক বিজ্ঞান কোনো হাড় বা তার লক্ষ বছরের পুরোনো অশ্ম ব্যাবচ্ছেদ করে তার রূপ গঠন বয়স প্রকৃতি জানান দিচ্ছে। সেই প্রাণের অবয়বও তৈরি হচ্ছে। 

উপরোক্ত বাক্যটি প্রর্থনার আবার অভিযোগেরও। তবে কার কাছে? হয়ত ঈশ্বর কিংবা তার চেয়েও বড়ো শক্তি প্রকৃতির নিকট। প্রচলিত সমাজের ভেতর আমরা যে মানুষ তৈরি হয়েছি তা মূলত নিজের নয়। নিয়মের ভেতরে নিয়মের জন্য নিজেকে ক্ষয় করে ফেলি। এই ক্ষত শরীরের বুদবুদ আছে, মুক্তি নাই। ‘ভুল বানানে গড়া তোমার এই মানুষের স্বরলিপি’ ‘কিসের প্রয়োজন তোমার রচিত দেহে… নিঃসন্দেহে যেখানে কষ্ট জমা হয়!’ লোভ লালসা যৌনতায় ভরা এ দেহ ‘একে অপরের পিছনে ছুটতে ছুটতে ঘাম ছুটে যায়!’ ঈশ্বরের তৈরি দেহই অতৃপ্তির আধার। ফলে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা- ‘দেহের বদলে পাঠিয়ে দিও আরও কিছু হাড়, নিজেদের মতো করে তারা আত্মজন্ম সেরে নেবে বিপুল উৎসাহে’।

‘বোটানিক্যালের স্বপ্ন’ কবিতায় অন্য সুর পাই। এইখানে অরণ্যজগতের ধ্যান ও সভ্যজগতের বানিজ্যিক রূপ রূপায়িত। শুরুটা এভাবে ‘বোটানিক্যাল গার্ডেনের জন্মবৃত্তান্ত জানার আগে ঘাসফুলের সুচিন্তিত মতামত জেনে ফেলেছি।’ তারপর লজ্জাবতী লতার লজ্জার কথা বলার পর বলেন- ‘এ ছোঁয়া যে অরণ্যদেশে কতটা লজ্জার মৃত্তিকা তা জানত কিন্তু আমি যে মৃত্তিকার নিকটাত্মীয় অরণ্য তা জানত না।’ ফলে ফুল ছিঁড়তে দিধা হয় না। এখানে আমরা অন্যভাবেও ব্যাখ্যা আনতে পারি। অরণ্যের উপমায় কোনো মানবীকে দাঁড় করাই এবং প্রেম ও কামনাকে নিয়ে আসি তাতে বোধহয় সাযুজ্যের ত্রুটি হয় না। অবশ্য পরের প্যারায় নিরেট বাস্তবতা। কবি যে ফুল তুলেছিলেন পকেটে তা বানিজ্যের মোড়কে ফিরে আসে- ‘তারপর সোজা প্যারিসের পারফিউম তৈরির কারখানায়। আবার একদিন নতুন জ্যাকেটে উড়ে আমার জাগতিক পকেটেই ফিরে এসেছে একটু চড়া দামে।’ পুঁজিবাদি সভ্যতা ফুলের নিজস্বতা ধ্বংস করে ভালোবাসতে সেখায় তাদের বানিজ্যিক মোড়ক। কবিতার শেষের দিকে ধরা পড়ে মানবীয় রসায়ন- ‘এমনিভাবে আমাকেও সরলরেখায় আসা-যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে চলেছ প্রতিদিন তারপর থেকে কখনো হেলে পড়ছি তোমার দিকে কখনো দুলে উঠছি দু’দিকে।’ তারপর ‘কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে আবারও উপরে উঠে তুলে নিচ্ছি বোটানিক্যালের স্বপ্নালু ঘাসফুল।’ 

কবির এ গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, দৈহিক। সময়ের রেখা বেয়ে কবির যে যাপন তার অভিজ্ঞতা দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তৈরি করে রংধনু, জমা হয় সামাজিক সভ্যতার বিচিত্র মেঘ। তা ছড়িয়ে পড়ে কবিতার মাঠে। যা পাঠে পাঠক নিজেকেই মেলাতে থাকেন। ফলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কবিতাগুলো কবি ব্যক্তির থাকে না। হয়ে ওঠে সকলের। ‘স্নানের রূপবদল’ কবিতার কয়েকটি লাইন- ‘ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে শিখেছি ধোপাবাড়ির কালো গোলাপ কেমন করে ফরসা হবার সূত্র মাখে। আষাঢ়-শ্রাবণের সঙ্গমে জলজন্ম দেখেছি প্রকাশ্যে, সেখান থেকে ছন্দ যতটুকু শিখেছি তাই নিয়ে সন্ধ্যে অবধি বসে থাকি। জোছনাখেকো ঢেউ আমার পাশের বাড়ির নদীতে অঙ্গাঙ্গী সাঁতার দেয়-’ এ যেন প্রতিটি পুরুষ কৈশোরের দৈহিক বিজ্ঞান। দেহ বৃদ্ধির সাথে সাথে কামনা ও পুলক জাগে। বিপরীত লিঙ্গের শরীরকে নিয়ে কৌতুহল তৈরি হয়। অবশ্য কবিতায় কবি যে শৈল্পিক বিন্যাস দেখিয়েছেন সকলের কামনার রূপ তা নয়। কবির চোখে অন্য স্বপ্ন খেলা করে। অর্থের ভিন্ন দ্যোতনা তৈরি হয়। ফলে এর মধ্যে আমরা দুটি দারুণ শব্দবন্ধনি পেয়ে যাই- ‘ধোপাবাড়ির কালো গোলাপ’ ‘জোছনাখেকো ঢেউ’। ব্যক্তিক ও দৈহিক উষ্ণায়নে গঠিত বাক্যের আরো কিছু উদাহরণ। যা সার্বজনিন হৃদয়ের সুর। ‘দেহকোষের পুণ্য অভিধান’ কবিতায়- ‘পাখিদের সাথে ভাবনার মেলামেশা, আমাকে রেখে ভাবনারা উড়ে যায়, এইভাবে একা একা বসে থাকা!’ দুএক বাক্য পরে- ‘ভেবেছি ভাবনার সাথে শরীরকে নিয়ে যাব, যেখানে তারা উড়ে যায় ধোঁয়াচ্ছন্ন গোপনে।’ আরো কিছুদূর এগিয়ে- ‘ডানা আর উড়ালের মাঝে বৃত্তাবদ্ধ আমি এক নতুন কাব্যকর।’ মানুষের হৃদিক ডানাগুলো পাখির ডানার সাথে মেলাতে থাকে। বয়ে চলে সমান্তরাল। কখনো কখনো তার চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলে, বিচরণ করে স্বপ্নজ ভুবনে। আমাদের সাধারণের কেবল মনই পাখি হতে চায় কিন্তু কবির ভাবনা আরো এগিয়ে। তিনি শরীরকেও নিয়ে যেতে চান পাখির ভুবনে।

এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই টানা গদ্যে লিপিত। তবে প্যারায় বিন্যস্ত। ফলে একঘেয়ে থেকে মুক্তি দেয়। প্রচুর চিত্রকল্প বুননে কোনো কোনো কবিতার ভাবনাবোধ কখনো স্থিরচিত্র কখনো চলচ্চিত্র হয়ে দৃশ্যরেখায় ধরা পড়ে। এখানে কবিতার শিরোনাম উল্লেখ না করে বিভিন্ন কবিতার কয়েকটি বাক্য তুলে আনছি।

‘আকাশ কিংবা পর্বতের গায়ে ফসফরাসের মতো যতটুকু তোমার অস্তিত্ব জানিয়ে যাও তাই কেবল স্বরূপের সাথে যুক্ত করি, শোকরসে তলিয়ে যাওয়া নিজেকে ভাসাই অনন্তলোকের আশ্বাসে।’

‘আমার দাদা যে টেবিলে বসে ভূগোল চর্চা করেন সেই টেবিল পর্যন্ত আমার হাঁটি হাঁটি পা পা;’

‘অনেক উৎসব সামনে রেখে গিয়েছি সন্ধ্যায় গান শুনতে অপেরায়, ফেরার পথে হারিয়ে গেছে শঙ্কাগ্রস্ত দেহের সংখ্যা- প্রত্নকুয়াশায়।’ 

‘আমরা মিছিলের যাত্রি, রক্তের আল্পনা ধরে ধারাবাহিক এগিয়ে যাই।’

‘কুয়াশা উপেক্ষা করে ধরেছ নীলমের হাত। এসেছ কমলাপুরের পালিত ট্্েরনের পিছু পিছু। ববুইয়ের ছাদের পাশে চাঁদ আছে, চাঁদের তলায় জড়োসড়ো ওদের পিঠে আর পকেটে আছে সংসারের স্নায়ুছাপ।’

মূলত প্রতিটি বাক্যেরই চিত্র থাকে, দৃশ্য থাকে, আর দৃশ্যের থাকে অসংখ্য বাক্য। তবু কবিতায় আলাদা করে চিত্রকল্প খোঁজা আমাদের অভ্যাস।

যে পরিবেশে প্রচলিত পদ্ধতি গড়ে ওঠে, যার ভেতরে মানুষের হাহাকার- যাতনার রক্তক্ষরণ বয়ে চলে, তার নিয়ন্ত্রক কে? হয়ত ঈশ্বর, হয়ত-বা ঈশ্বরের আদলে মানুষই প্রভুত্বের অহং নিয়ে ছড়ি ঘোরায়। মূলত সভ্যতার বৃত্ত তাকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে মারে। এই কঠিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ আর নিজ হতে পারে না। প্রকৃতি বা ঈশ্বরের কিছুটা দায় তো থেকেই যায়। তাই কবির অনুযোগ- ‘ভুল বানানে গড়া তোমার এই মানুষের স্বরলিপি।’ ফলে ধারণা প্রসূত মস্তিষ্ক অতৃপ্ত বাসনায় ভুগতে থাকে। ‘যৌনকলায় এ কেমন ধারণা মিশিয়েছ- একে অপরের পিছনে ছুটতে ছুটতে ঘাম ছুটে যায়!’ আমাদের ধ্যান ও জ্ঞানের সল্পতা রয়েছে, কেননা মানুষ আরোপিত পদ্ধতি দ্বারা শোষিত। তাই একটা খেয়াল একাধিক যন্ত্রণানুষঙ্গ তৈরি করে। এই যন্ত্রণা উত্তরণে কবি নিজেই ঈশ্বর হয়ে ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে চানÑ ‘খণ্ডিত মেধায় পারি না বলে চাইছি তোমার সমান করে নাও। সঙ্গম হবে তোমার সাথে। না চাইব পৃথক নারী, না বিস্তীর্ণ অরণ্য, না সমুদ্র- সবই তো তোমার ভুলের ছাপচিত্রÑ’ এই অতৃপ্ত যন্ত্রণার জীবন বারবার ফিরে আসে- ‘পুনর্মুদ্রণ করেই চলেছ আমাদের। আমরা ঔদ্ধত্য দেখাতে গেলে আইনত দণ্ড হয়ে যায়।’ এভাবে কবি সমাজের নিগূঢ় বাস্তবতা, মানুষের মনদৈহিক বিজ্ঞান তুলে ধরেন কবিতায় নিজের অনুষঙ্গে।

বোঝা যায় কবি প্রেমে অতৃপ্ত। তিনি যাকে চান তাকে পান না কিংবা যাকে পান তিনি তার বোধের সমান্তরাল নয়। ভালোবাসার অপূর্ণতায় কবি বিরহ বয়ে চলেন। তা থেকে তৈরি হয় বিষণœ সুর। ‘ব্যক্তিজীবনের দোটানায় পড়ে তার মাংসল বুকে কান পাতার সাহস দেখাইনি, টেনে এনেছি বুকের মাঝখানে, শুনিয়ে দিয়েছি বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আর্তনাদ।’ আবার ‘তুমি তার হাত ধরে কান পেতে শুনে নিও আরও কিছু মেটাফিজিক্যাল গান।’ ‘তোমাকে না পেয়ে ভাসমান সড়কে বসে থাকি নিয়তি নির্ভর।’ ‘অনন্ত সময়ের কোলে শুয়ে দেহঘষা আগুনে পুড়ছি।’ এইসব দহন কবিকে জাগিয়ে রাখে। কবি তৃপ্ত হলে কবতিার জন্ম হয় না। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এঁরাও বিরহ সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছেন মূল্যবান সাহিত্য। তাঁদের এই বিরহ যাপনপথ এক হলেও সৌন্দর্য আলাদা, সুর আলাদা।

মানুষের মনদৈহিক চেতনা-অনুভূতি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যে বহিরভঙ্গিমা তা যেন কবির কাছে নাট্যদৃশ্য। নাট্যদর্শকের দৃষ্টিতে কবি এইসব যাপনকাল দেখেন। এর ভেতরের কোনো এক চরিত্রে কবি নিজেকে খুঁজে পান- ‘মন্দাক্রান্ত দিনে মুখ ফেরাই থিয়েটারে। যেখানে নতুন নটবর মাতিয়ে রাখেন মুগ্ধতা নতুন শাড়ির আঁচলে। আমাকেও প্রতিদিন পর্ব পর্ব মহড়া ঢালতে হয়, যেতে হয় শাড়িঘেরা সাজঘরে…।’ কোনো এক সত্তার অদৃশ্য কর্মপদ্ধতিকে তিনি থিয়েটার রূপে দেখেন- ‘তীর্থপ্রিয় প্রাণের পাশেই মিশে থাকেন সর্বজনগ্রাহ্য নাট্যকার, সেখানে বসেই সাধারণত তিনি চিত্রনাট্য লেখেন, সুর নিয়ে ভাবেন, সব শেষে চেতনানাশক একটা প্রেসক্রিপশন উড়িয়ে দিয়ে বিদায় নেন।’

কবি তুষার প্রসূন ভাবনাগতভাবে ঘরের বাইরের মানুষ। তিনি শারীরীক ও মানুষিক ভ্রমণে আপ্লুত। ‘ভাবতে ভাবতে দেহকোষ ডানা পেয়ে উড়ে যায়, আমি পারি না।’ এখানে যেন আক্ষেপ কাজ করেছে। তবুও দেহের ভেতরের অদৃশ্য প্রসূনকে হারাবার ভয়ে ত্রস্ত। সর্বদা সে যেন তাকে ফেলে যাবার প্রস্তুতিসহ আসা-যাওয়া করে। ‘দেহাতিরিক্ত’ কবিতার শেষ চরণে পাই- ‘অথচ চরম যতেœ বোতাম এঁটে সচেতনে রাখি যে দেহাতিরিক্ত দেহ সেই শুধু শত্রুতা করে…চলে যেতে চায়…না ফেরার কৌতুক দেহে মেখে…’ আমরা যাকে মৃত্যু বলি সেই চেতনার প্রকাশ এখানে। সব মানুষই কখনো না কখনো মৃত্যু চিন্তায় মগ্ন হয়, তিনিও তার বাইরে নন।

দেহহীন কিংবা দেহযুক্ত হয়ে অন্য ভুবনে হারাবার বাসনা যার ভেতরে দেখা গেছে, ঘর যাকে শান্তি দিতে অপারগ বলেই মনে হয়, সেই তিনিও ঘরে ফেরার তাগিদ দেন। ‘পৃথিবীর ব্যক্তিগত বান্ধব’ কবিতায়- ‘শেষ পর্যন্ত ঘরের ভেতর সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে বলে সীমান্ত ও সাগরপারের সূর্যাস্ত মানুষকে বাড়ি ফেরায়…’ আবার ‘ঘরে যেহেতু আদরের উপোস, যেহেতু সফল আহ্বান…।’ ঘর এক মায়াময় আধার। ভেতরে থাকলে অসংখ্য যন্ত্রণা ও বিতৃষ্ণার অনুষঙ্গ তৈরি হয়, দূরে গেলে ভালোবাসার রশি খেলা করে। অদৃশ্য বাঁধনে টানতে থাকে। সে মায়া দৈনন্দিন যাপনের বস্তুসমূহ, আর কিছু সামাজিক সম্পর্ক, মা-স্ত্রী-সন্তান।

“হাড়ের কোরিওগ্রাফি” মূলত জীবন-বাস্তবতার কোরিওগ্রাফি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত। গ্রন্থটির নামকরণে বাংলা ও ইংরেজি মিশেল হলেও তা যৌক্তিক বলেই মনে হয়। কোরিওগ্রাফির বাংলায়ন সঠিকভাবে এক শব্দে করা সম্ভব নয়। হাড়ই মৌলিক। একে কেন্দ্র করে রক্ত-মাংসের শরীর গড়ে ওঠে এবং সে শরীর পচেও যায়। হার থেকে যায় লক্ষ-কোটি বছর। সে হাড়কে কবিতায় নিয়ে আসেন কবি তার কবিতার প্রয়োজনে, বাস্তবতা রূপায়নে। যে বাক্যগুলো হাড়কে বহন করেছে নানান ভঙ্গিমায়- 

‘কিছু হাড় পাঠিয়ে দিতে, নিজের মতো করে নিজেকে বানিয়ে নিতাম।’

‘একদিন শুরু হয়েছিল বলে আজ আমি পাঁজরের হাড় গুনি…সীমানাবিহীন…’

‘মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন হাড়গোড় দেখে শরীরে মাটির প্রলেপ খসে পড়তেই পারে’

‘নিয়মিত গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের ল্যাবে আমার হাড়সর্বস্ব ফসিল হাঁ করে ঝুলে থাকে।’

‘ঘরের ভেতর হাড়গোড় ফেলে রেখে সে আর কতদূরে যেতে পারে, সে আর কত বড় হতে পারে!’

কবিতায় বিজ্ঞান মিথ ইতিহাস গণিত পাই। যা সংযোজনে বিষয়ের ভিন্ন মাত্রা তৈরি হয়েছে। টানা গদ্যে লিপিত কবিতাগুলো বর্ণনাধর্মি। কোথাও কোথাও তা ঝুলে গেছে বলেই মনে হয়। কোনো কোনো জায়গায় হয়ত আরো সংক্ষেপ করা যেত। কোথাও কবিতাকে কবিতায় ব্যাখ্যা করবার প্রচেষ্টা। যা কবির নিজস্ব ঢং বলা যায়। বিষয়, বোধ, দর্শন মিলে কবিতাগুলোর নিজস্বতা লক্ষ্যনীয়। কোনো কোনো কবিতা অসাধরণ। যেমন- ‘কষ্টের যাদুবাস্তব সান্তনা’ ‘দেহাতিরিক্ত’ ‘বোটানিক্যালের স্বপ্ন’ ‘আকাশের নক্ষত্রখচিত বেডশিটে’ ‘স্পর্শ’ ‘নিজেকে অনুবাদ’ ‘মাত্রাভ্রমে অন্ধ পদ্য’।

কবিতায় ও শিরোনামে ইংরেজির বহুল ব্যবহার দেখা গেছে। এটার দোষ-গুণ বিশ্লেষণ অবশ্য ভাষাতাত্তি¡কের কাজ। তবে কোথাও তা পাঠে খটকা তৈরি হয়। বিশেষ করে চল্লিশটি কবিতার দশটি শিরোনামে ইংরেজি শব্দ ঢুকে গেছে। এর মধ্যে একটি অবশ্য অপরিহার্য ছিল- ‘অ্যাথেনাকে’। বাকিগুলো অন্যভাবেও হতে পারত।

কবিতার আধুনিক যে কাঠামো তার ভেতরে থেকে কবি নির্মাণ করেছেন বাস্তব ও পরাবাস্তবের যৌথ সংসার। এঁকেছেন দেখা অদেখা বিস্তীর্ণ ক্যানভাস। ঘুরেছেন মৃত্তিকা থেকে নক্ষত্র, নিহারিকা হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের আনাচে কানাচে। পরিশেষে বলবো, এ লেখায় উদ্ধৃত বাক্যগুলো কবিকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করবে বলেই বিশ্বাস।

মন্তব্য: