দেবযানী বসু

সার্বিক নির্জনতার কবি জীবনানন্দের ভাবচ্ছায়ায় উদ্দীপিত কবি শিকদার ওয়ালিউজ্জামান (মাগুরা,বাংলাদেশ) লিখিত ‘মধ্যবর্তী আলোও কুয়াশা’ কাব্যগ্রন্থের সংস্পর্শে এলাম। কবির ব্যক্তিজীবন ও কাব্য জীবন বড় ঘনিষ্ঠ।কবির অন্তরে রয়েছে বাংলার নিসর্গপ্রকৃতির জামদানি- বিস্তৃত-বহর। আর কাব্য নির্মাণকৌশল তাকে ঘোরলাগা বনোবৈতানিক জার্নির দিকে তাঁকে টেনে নিয়ে  গেছে।

প্রচ্ছদের মানুষ, জানলা, আলোকিত কুয়াশা চিত্রটি কাব্যের হরিহরি আত্মা একেবারে। কাব্যিক গতিপথে অনিবার্য ভাবে’ চারিদিকে বিষাদের মাতম’ছড়ানো।কবির অন্তস্থলের দ্বান্দ্বিক অবস্থানটি সুস্পষ্ট। বর্তমান ও অতীতের স্মৃতি মিশিয়ে কবি এককথায় বিষাদসিন্ধু তৈরি করেছেন। ‘মধ্যবর্তী আলো ও কুয়াশায়’ ‘যে যে পথে পায়ের ঋণ রেখে এলাম সে সে পথে পাঠক হেঁটে দেখবেন,অনুভব করবেন ‘করতল জুড়ে কতোখানি দীর্ঘশ্বাস। বিষাদকবিতার এ পিঠে ও পিঠে খচিত প্রেমের টুকরো টুকরো তেহাই।

‘পাতার সঙ্গে কানামাছি খেলা/ আবর্তন পথে প্রিয় ওড়নার কলঙ্কভার’, ‘ এমন সন্ধ্যায় তুমি ডাকনি বলে অ্যাপ্রনের শুভ্রতায়/ লুকানো স্তনে তোমারই স্পর্শ খুঁজি;/ পেতে চাই শামীম স্মরণীর একটি স্বপ্ন-বিকেল।’ , কতোটা দূরের হলে আরো দূরত্ব তৈরি করা যায়?/কতোটা কাছের হলে আরো কাছে?/দূর-নিকটের সূত্র মেনে আমি তার চোখের চাতক।’ পেয়েছি নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা ভেজামাটির রুমাল- ‘তোমার কথা ভেবে আজ রোপিত গাছের পরিচর্যা করেছি খু-উ-ব/অসহায়-একাকী কেঁদেছি ভী-ষ-ণ!’

কবি শিকদার ওয়ালিউজ্জামান সমাজ, প্রকৃতি, পাড়া, জল, জমিন, সংসার, পারিবারিক কলমীশাকের সালুন রান্নার গন্ধে, ঘরোয়া পান্তা ভাতে নিজের আত্মার স্বর মিশিয়েছেন। উচ্চারণে উচ্চারণে পাঠকের আত্মশুদ্ধি ঘটে যাবে। থমকে দাঁড়াই তার রহস্যমন্ডিত ভাষার উচ্চারণের কাছে। হ্রস্বাকৃতি কবিতার আবেদনের কাছে। ‘বেঁচে খাই মহাকাল’ এমনই এক কবিতা যেখানে কবির দীক্ষিত জীবন নিজস্ব ইন্দ্রিয় ঘ্রাণের কাছে প্রশ্ন রাখে কিভাবে সে ভারসাম্য রাখার খেলায় জিতে যাবে, কিভাবে ফিউডালিজম থেকে মুক্তি পাবে। কারণ কবি তো তার বিবেক কারো কাছে বাঁধা রাখেন নি।

ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে বাক্যাংশটি ‘চাঁদের কাব্যে মুদ্রার অভিলাষ’। যুদ্ধোত্তীর্ণ বাংলাদেশের পটভূমিকায় কিছু কবিতা রয়েছে তার মধ্যে ‘নিশ্চুপ ক্যামেরার স্ন্যাপ’ একটি তীক্ষ্ণ কোলাহল ও নীরবতা নিয়ে বিরাজ করছে, যেখানে কবির ‘বিছানাকে মনে হয় রাতের কফিন’। কবি যদিও বলেন অন্ধকার রচনাই তার মুখ্য লক্ষ্য কিন্তু দেখা যায় পেন্ডুলামের শক্তিতে কম্পিত আলোর বিশ্বাস অজেয় হয়ে উঠেছে জীবনের প্রতি। মেকী সভ্যতার সংকট কবিকে উত্তেজিত করে। মমি নগরউদ্যান, মহাশ্ম্শান, গোরস্থান, কবির হলুদকাতর যন্ত্রণা নারীপাখি হত হবার জন্য যেন তারা নির্ধারিত, সেইসব পাখিশব ও তাদের যন্ত্রণা সুনিপুণ মুন্সিয়ানায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।

জীবনানন্দকে সামান্য অনুসরণ করেও কবি নিজের অবস্থান কম্পাসনির্ণীত করে নিতে চান। ‘মৃত্যুসফেন’ জীবনকে তিনি স্মৃতির ফলকে এঁকে তুললেও আগামি দিনের রিহার্সালের জন্য প্রস্তুত থাকেন। তিক্ত বিরক্ত কবি পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে উচ্চারণ করেন ‘দো’পেয়ে মানুষের চেয়ে ঢের ভালো নির্জনতা’, কারণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নারীমুক্তি আন্দোলনের ব্যর্থতা- ‘মৃতদের সমাপ্ত কবর খুঁড়ে শায়ীত বঁধূর স্তন কামড়াচ্ছে / কতিপয় মাদি শেয়াল’ (আসলে নারীমুক্তি আন্দোলন একটি বিতর্কিত বিষয়)।

উজ্জলতম একটা কবিতা ‘অরোরা তুমিও ঘাসফড়িঙ হও’। যে অরোরা বা জ্যোতির্ময়ী নারীটি কবির বাস্তবজীবনে এখন মিলন- অসম্ভব- সেতুর ওপরে তাকে সঙ্গে নিয়েই ‘অমরত্বের শাপ’ থেকে কবি মুক্তি কামনা করেন। ‘অমরত্বের শাপ’ বাক্যবন্ধটি এক অসীম অর্থবহ বহুত্বেও দ্যোতক। গ্রিক মিথলজির টিথোনাস ও উষাদেবী ইয়োসের প্রণয়কাহিনি আমরা জানি মর্মন্তুদ যার পরিণতি। মানুষের অমৃত অভিলাষ কি করে ‘সকলি গরল ভেল’ হয়ে যায় আর ঘাসফড়িঙ বা ঘুর্ঘুরে পোকা হয়ে অভিশপ্ত জীবন কাটায়।

কবি ও এরকম অভিশপ্ত জীবন চান না। লর্ড টেনিসনের টিথোনাস নিয়ে একটি কবিতা আছে। স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়ে। ‘মানুষ-বিড়ালের ঐকতান’ কবিতাটিতে আছে অ্যাবসার্ডিটির স্পর্শ। বর্তমান বাস্তব সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিড়ালের ইমেজারি কাজ করে এখানে ইউরোপিয়ান কবি ডেরেক ওয়াল্কট, লরেন্স ফের্লিংঘেটি এরা অ্যাবসার্ড, নন্সেন্স, ইল্লজিক্যাল কবিতা লিখেছেন। কবিতাটির একটা দার্শনিক মাত্রা আছে। ‘স্বপ্নভুক নগরীর গল্প’ কবিতা থেকে এক্টু উদাহরণ দি –

‘অস্পষ্ট সময়ে পিছনে পরিপাটি ঋণের পাহাড়/কৃশকায় দেহের ঝুলন্ত বিকেল’ কিংবা ‘একটি কালসাপের জন্মরহস্য’ কবিতায়’ এমন রাত্রিশেষে, মানুষের ময়দানে চোখে ভাসে/কোন কালসাপের খোলস বদল!’ কবির স্বকীয়তা তিনি স্বদেশকে প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করেছেন। আক্ষেপ করেছেন- ‘একদিন এই যৌবন ক্ষেতে বাৎসায়নে মেতে উঠতো/ অগণিত মৌমাছি; বহুজাতিক পাদুকাবাজার’। রাজনীতির পালাবদলের স্বাক্ষর রয়েছে ‘পাখিদের শবযাত্রা’, ‘শাহবাগ এক ফাগুন’ ইত্যাদি কবিতায়। সন্ত্রাসবাদ, সত্তরের যুদ্ধবন্দীদের শাস্তিদান,শাহবাগ আন্দোলন এ সব নিকট অতীতের কথা মনে পড়ায়।

কবির লেখা কিছু আশ্চর্য পংক্তি যা পড়লে ওয়ালিউজ্জামানকে মরমী কবি বলে চিনতে পারব তার উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না- 

১। আমরা কেউ কেউ বিপ্লবী 

২। মায়ের বিপন্ন চোখে কন্যার চৌচির আকাশ 

৩। ইদানীং চশমার গ্লাসেও জমানো মেঘ 

৪। শ্মশানের পদাবলী বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অশত্থগাছ 

৫। দূর-নিকটের সূত্র মেনে আমি তার চোখের চাতক 

৬। নিলাম হয়ে গ্যাছে নাবিকের মুখস্থ কম্পাস । 

৭। পোয়াতি ধানে বেনিয়া বাতাস

মন্তব্য: