স্বাধীনতা পরবর্তী মাগুরা জেলায় স্বল্পসংখ্যক কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে ভোলানাথ সিকদার এক অনন্য নাম। অন্ধকার ভালবেসে অন্ধকার ভেঙে তিনি পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছিলেন আলোর দিশারী। রাতভর জোছনায় তিনি অবগাহন করেছেন শব্দবুননে। নৈরাশ্যের আবহে জীবনযাপন সত্তে¡ও অনুজদের জন্য আজও অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে আছেন কবি ভোলানাথ সিকদার। তার কবিতার প্রতিটি চরণ সারল্যের সাবলিল স্বাক্ষর। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, দেশপ্রেম, মানবিক চেতনাবোধ- এর সমান্তরাল বসতি তার কবিতায়।
রাষ্ট্রনীতির শোষণকলে সাধারণ যাপন অসহনীয় হয়ে উঠলে বিপ্লবীর রক্তে মায়ের আঁচল ভিজে যায়। পেটের আগুনে পুড়ে সুখযাপন ফিকে হলে ভস্ম হয় জীবনের সারগাম। এই অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ভোলানাথ সিকদারের সামাজিক বিপ্লব এবং তারই মন্ত্রযজ্ঞে পাঠকচিত্ত পায় সাহসী প্রেরণা। তার কবিতায় পাঠকের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত। সহজ, স্বাভাবিক, সরল ভাষায় ভোলানাথ সিকদারের কবিতাগুলো রচিত হলেও কবিতার অবয়বে উচ্চ শিল্পসত্ত¡ার পরিচয় সুস্পষ্ট। তার দেশত্ববোধে পাঠকচিত্তে দেশ, মাটি, মানুষকে ভালবাসার উচ্চ মানসিকতাবোধ জন্মায়। এরই অর্থবহ ইংগীত পাওয়া যায় তার ‘তোমায় এতটুকু সুখ দেব বলে’ কবিতায়-
তোমায় এতটুকু সুখ দেব বলে প্রকাশ্য দিবালোকে
জমির চাচার খুলি তোমার গলায় মণিহার হয়ে দোলে
হাজরা বিবি কাফনের মোড়কেই বন্দী; জমিলা সামিল হয় রাতের বিনোদনে
পরান মণ্ডলের জমি জিরেত হয়ে যায়।
তোমায় এতটুকু সুখ দেবো বলে
সলেমান কম্পোজিটর সারাদিন টাইপ খুঁটে বলে-
কখোন পেটের আগুন আর সূর্যের আগুন একসাথে আরও লাল হয়ে উঠবে
জ্বলবে আমার চিতা।
দেশপ্রেম চেতনা ভোলানাথ সিকদারের কবিতাকে করেছে মহিমান্বিত। ফরাসী-গুজরাটি-মারাঠি-মুঘল-পাঠান-বৃটিশ-খাঁনদের তাবেদারিত্ব থেকে বাঙালীর পুতুলপনা, অসহায়ত্ব মুক্তি পেলেও স্বাধীনতা রয়ে গেছে অন্তর্লোকেই। কিন্তু বাঙালীজীবনে তিনি দেখতে চেয়েছেন স্বচ্ছ সরোবরে ফোটা শাপলার মাঝে হংস-মিথুন সুখ। তার সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। এ কারণেই হয়তো তিনি বলেন-
এতটুকু সুখ দেবো বলে কবিতার জটিলতা ছেড়ে
গদ্যের সহজ সমাধানে, কাঁচির যন্ত্রনা-বুকে খুঁজে খুঁজে
……………………………………………………..
…………………………………………………….
স্পেন, ফরাসী, গুজরাটি, মারাঠি, মুঘল, পাঠান, বেনিয়া ইংরেজ, খাঁন হতে
আজতক পুতুল বাঙ্গালীর নীল নক্শার খবর।
তোমায় এতটুকু সুখ দেবো বলে-
নুর হোসেন বুকে মুক্তির পোস্টার লাগায়
শহীদের লাল শার্ট বাতাসে ওড়ে;
বিপ্লবীর রক্তে তোমার শাড়ির আঁচল ভিজে যায়।
– তোমায় এতটুকু সুখ দেব বলে
কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী মাত্রেই প্রত্যেকেরই থাকে শিল্পীসত্তার জগতে অবাধ বিচরণ। তাতে অবগাহন করেই তারা হয়ে ওঠেন কষ্টিপাথরে যাচিত প্রকৃত শিল্পী। অসাধারণ। তেমনি অসাধারণত্ব লাভ করেছেন ভোলানাথ সিকদার। তার কবিতার স্বাদ স্বতন্ত্র। স্বকীয়তার মহিমায় চিরভাস্কর। চিন্তার প্রকটতা মন্ত্রমুগ্ধতা পায় পাঠকে পাঠকে । তার কবিতাগুলো চর্বিত-চর্বন নয়। উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। তার প্রতীকী ব্যবহার অর্থময়তার অসাধারণ ইংগীত বহন করে-
জলের আয়নায় কুয়াশার ডানা ভেঙ্গে
হাঁসগুলো মুখ দেখে নেয়
কুসুমিত রোদের ঝিকিমিকি আলোয়
এমনি এক সকাল চেয়েছিল তারা
বুকের ক্ষরণে অগনন লাশের মিছিল হয়ে পার
সহস্রাব্দির অন্ধকার ভেঙে ভেঙে উড়–ক্কু ডানায়
-উদ্বাস্তু
কবির অবচেতন মনেই শিল্পরূপ ফুটে ওঠে কবিতায়। হৃদয়গ্রাহী ব্যঞ্জনায় পাঠক কখোন যে কবির হৃদআপ্লুতির সাথে একাত্ব হন তা হয়তো কবির অজ্ঞাতেই থেকে যায় আবহমান কাল। প্রত্যেক সুকোমল পাঠকচিত্তেই একটি রক্তগোলাপ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তার গন্ধেই সকালের খবর নিয়ে সুবেহ সাদেক। কুয়াশার বেড়াজাল ভেঙে পাখিদের কলকাকলিতে স্বপ্নের নীড় বাধে ভোরের মৃদমন্দ বাতাস। নৈসর্গিক এমন সৌন্দর্যের আবহে ভোলানাথ সিকদার আশাবাদের স্বাক্ষর রেখেছেন ‘বৃত্তের ভেতর কবিতায়’। রেখেছেন শিল্পমানসের যথার্থ ছাপ-
তোমার শুকুমার বৃত্তের ভেতর
একটি রক্তগোলাপ কী সুন্দর
মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে
……………………………………………….
……………………………………………….
আহা! কী সুন্দর একটি রক্তগোলাপ!
তোমার সুকুমার বৃত্তের ভেতর জীবনের সবুজ অঙ্গীকার।
অন্ধকার বৃত্ত থেকে স্বাধীন সূর্য, মুক্তির সূর্যালোকে কবি শোনাবেন আশার বাণী এইতো পাঠকের প্রত্যাশা। সত্য-শিব ও সুন্দরের পূজারী কবি কল্পচিত্রকে নিয়ে যাবেন কল্পলোকে; কল্যাণের অদৃশ্য মোহনায়। মানবতার প্রতি থাকবে তার অকুণ্ঠ বিশ্বাস, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম। ভোলানাথ সিকদার সেই চিরসেত্যর পথের এক পূণ্যবান পথিক। তাইতো নবাগত শিশু তাকে আশির্বাদভাবনায় আবেগবিহ্বল করে তোলে। প্রতিটি শিশুর জন্মই তার কাছে রাতের আঁধার পেরিয়ে এক টুকরো আলো। কুয়াশার ভোরে আমেজি তাপ। অনাদিকালের বিজয়স্বাক্ষর-
অনেক আঁধার পেরোনো রাতের নিশান
এক টুকরো আলো এ য্যানো কুয়াশা-ভোরের আমেজী তাপ
আপ্লুত ছায়া; অনাদিকালের বিজয়স্বাক্ষর
সঞ্জীবনী মূর্ছাধারা অমৃতের সন্তান।
নবজাতক দীর্ঘজীবী হোক।
– জয়তু শুভ
ভোলানাথ সিকদার দেশ, দেশপ্রেম আর কবিজীবন- এই অস্তিত্ববাদের অনুবাদ করেছেন আজীবন। এই শ্যামলী বাংলাদেশই তার মায়ের আঁচল। এখানেই তিনি বেধেছেন সত্যের মতো অনড় ছোট্ট একখানি ঘর। মৃত্যতে তিনি নির্ভিক। মৃত্যু চিন্তায়ও তিনি বিচলিত নন। তাই তিনি বারবার এই দেশের বুকেই ফিরে আসার আকাক্সক্ষা ব্যাক্ত করেছেন তার লিখিত সর্বশেষ কবিতায়। ‘ঘর’ কবিতায় তিনি অন্তর্দৃষ্টিতে ভাসমান মৃত্যূর কালো হাতছানিকেই শাসিয়েছেন দেশপ্রেমের মহামন্ত্রবলে-
তোমার দীঘল বুকের
আছে আমার ছোট্ট ঘর
যা সত্যের মতো অনড়।
ভয় কি আছে ফিরে যাবার
ফিরতে হলে আসবো আবার
তোমার বুকেই বারংবার।
চলমান জীবন-যাত্রার বিচ্ছিন্ন চেতনাকে অন্তর্দেশীয় বোধে সহজেই আটকে ফেলেন কবিসত্তা। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে উত্থিত কবি ভোলানাথ সিকদার সেই চেতনারই সারথী। শিল্পের রহস্যময়তাকে অভিজ্ঞতার মলাটে আবদ্ধ করেছেন, করতে পেরেছেন। পাপ ও পঙ্কিলতার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন নির্ভিকভাবেই। চিন্তায়, দর্শনে, মননে নিজস্ব উপলব্ধিতে নিমগ্ন কবি জীবনব্যাপি হতাশাক্রান্ত নির্মম বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করেছেন প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ। তদসত্তে¡ও তিনি পেরেছেন পাঠক ও সূধীজনের ভালবাসায় সিক্ত হতে। একটিও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত না হলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লেখনিতেই তিনি আজঅব্দি সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তার সরলচিত্তের নিরহংকারী প্রসন্ন হাসির জন্য।