ভাষাসৈনিক খান জিয়াউল হক মাগুরার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক ও সংস্কৃতিকর্মী। তিনি ১৯২৮ সালে মাগুরা শহরের ভায়না গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকরিসূত্রে শৈশব কেটেছে দুই বাংলার বিভিন্ন স্থানে। ১৯৫০ সালে তিনি যশোর এম,এম কলেজের জিএস এবং ১৯৫১ সালে ভিপি নির্বাচিত হন। সেই সূত্রে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এমএম কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করেন। ৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মাগুরায় মিছিল চলাকালে তাকে সহ তিনজনকে আটক করা হয়। ১৯৫৪ সালে খান জিয়াউল হক সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়ে মাগুরায় শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি মাগুরায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও মাগুরার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি অসামান্য ভুমিকা পালন করেছেন। তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলাদেশ স্কাউটস-এর সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘রৌপ্য ব্যাঘ্র, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় সমাজসেবা পুরস্কার, আব্দুল হক স্বর্ণপদক, হরিশ দত্ত নাট্যপদক, থিয়েটার ইউনিট নাট্য পদক, জেলা প্রশাসনের গুনিজন সম্মাননা, শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক পুরস্কারসহ আরাে অনেক পদক ও পুরস্কার। ভাষা সৈনিক এই বিশেষ ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হলে বেরিয়ে আসে তৎকালীন যশাের জেলাধীন মাগুরায় ভাষা আন্দোলনসহ সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষাসহ নানান উপপাদ্য বিষয়।।
জলসিড়ির পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি গ্রহন করেছেন কবি তুষার প্রসূন-
জলসিঁড়িঃ ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে কোন প্রেক্ষাপট আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ৫২’র ভাষা আন্দোলনে অংশ নিতে?
খান জিয়াউল হকঃ ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর ভাষণই বুঝিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানীদের সাথে বাঙালিদের সুখের দিন যাবেনা। তবে ৪৮ সালে ঢাকায় যেরকম প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল তার প্রভাব যশোরে পড়লেও মাগুরায় তেমন কিছু হয়নি। আমি ১৯৫০ সালে যশোর এমএম কলেজের জিএস নির্বাচিত হই। তখন আমি মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন করতাম। পরের বছর ভিপি নির্বাচিত হলাম। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দীন আবার যখন ঘোষণা দিলেন-উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা তখন থেকেই ভাষা আন্দোলন দানা বেধে উঠতে শুরু করে। কলেজের ছাত্ররা কিছু করার জন্য তাগিদ দেয়। কিন্তু আমার দল হয়ে উঠে প্রধান বাধা। মুসলিম লীগের নেতাদের অনেকেই চায়নি ভাষা নিয়ে আন্দোলন হোক। পরে আমি বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলনে নামি।
জলসিঁড়িঃ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আক্রমনের লক্ষ্যব্তু হিসাবে প্রথমেই কেন বাংলা ভাষাকে বেছে নিয়েছিল?
ধান জিয়াউল হকঃ আমরা যে বাঙালি তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য- আমারা বাংলায় কথা বলি। পাকিস্তানীরাও তাই ভেবেছিল আমাদের দিয়ে উর্দূতে কথা বলাতে পারলে আমরা বাঙালিত্বকে ভুলে যাব। ওরা জানত বাঙালির ইতিহাস বড় ভয়ংকর। ভাষাকে বিনষ্ট করতে পারলে বাঙালি চেতনাও ভেঙে পড়বে।
জলসিঁড়িঃ কোন সুত্র ধরে আপনারা দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলন এর অংশ হিসাবে মাগুরায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
খান জিয়াউল হকঃ আমরা যশোরে অনেকদিন ধরেই মিছিল মিটিং করেছি। তবে মাগুরায় বেশিদিন আগে থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যশোর এমএম কলেজে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকে। যেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যায়। কলেজে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমি মাগুরায় চলে আসি। মাগুরায় এসে আবু ভাই (নাসিরুল ইসলাম) এর সাথে দেখা হলে জানতে পারি তিনি আরো কয়েকজনকে নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেখান থেকে আমিও যোগ দিই তাদের সাথে।
জলসিঁড়িঃ কার নেতৃত্বে মাগুরায় ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়?
খান জিয়াউল হকঃ আগেই বললাম আবু ভাইয়ের কথা। মূলত নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়ার নেতৃত্বেই আমরা সব কর্মসূচি গ্রহণ করি।
জলসিঁড়িঃ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মাগুরায় কোন কমিটি হয়েছিল কি-না?
খান জিয়াউল হকঃ না। কোন কমিটি হয়নি। তবে আবু ভাইয়ের সাথে আমি, জলিল খাঁ এবং আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতাম।
জলসিঁড়িঃ ৫২র ভাষা আন্দোলনে আপনার উলেখযোগ্য সহযোদ্ধাদের নাম বলুন-
খান জিয়াউল হকঃ মূলত ঢাকার কর্মসূচির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি শহরের সেগুন বাগিচায় (নোমানী ময়দান সংলগ্ন) একত্রিত হয়েছিলাম আবু ভাইয়ের নেতৃত্বে। সেদিন আমরা সমাবেশ করেছিলাম। সেদিন রাত্রেই আমরা খবর পাই ঢাকায় অনেক ছাত্র নিহত হয়েছে। পরদিন আর কাউকে ডাকা লাগেনি। অনেক সাধারণ ছাত্রই এসে জড় হয়েছিল সেগুন বাগিচায়। ঢাকার ঘটনার প্রতিবাদে আমরা শহরে মিছিল নিয়ে ঢুকতেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ সময় আমি, চান্দু মিয়া এবং জলিল খাঁ পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। বিকাল পর্যন্ত আমাদেরকে জিআরও কক্ষে আটকে রাখা হয়। ওখান থেকেই জানতে পারি আজিম দেওয়ানের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র সংগঠিত হয়ে শহরে আরেকটি মিছিল বের করেছে। আমি যে কয়েকজনের নাম বললাম তাদের নামই মনে আছে কারণ তারাই ছিলেন আমার সার্বক্ষনিক সহযোদ্ধা। আর যেসব সাধারণ ছাত্র ২২ তারিখের মিছিলে এসেছিলে তাদের নামগুলো আমি বলতে পারছিনা বলে দুঃখিত। তবে মির্জা শওকত নামে একজন ছাত্রনেতার সাথে ঢাকা থেকে কয়েকজন ছাত্র মাগুরার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন বলে শুনেছি।
জলসিঁড়িঃ মাগুরার কোথায় প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয়েছিল এবং কারা এটি তৈরি করেছিলেন?
খান জিয়াউল হকঃ সত্যি কথা বলতে কি ২২ ফেব্রুয়ারির পরপরই আমি আবার যশোরে চলে যাই বিএ পরীক্ষার কারণে। শুনেছি সোহরাওয়ার্দী কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ ক্যাম্পাসে বাশ দিয়ে একটি শহীদ মিনার তৈরি করেছিল। তবে কারা করেছিলেন আমি জানি না।
জলসিঁড়িঃ বর্তমান প্রজন্ম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে কতুটুকু সচেতন বলে আপান মনে করেন?
ধান জিয়াউল হকঃ আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন প্রজন্মের ভাবনা আশঙ্কাজনকভাবেকমে যাচেছ। আবার আশার কথা এই যে যারা এই চেতনা ধরে রাখার চেষ্টা করছে সংখার কম হলেও তারা নতুন প্রজন্মেরই ছেলেমেয়ে।
জলসিঁড়িঃ যাদি নতুন প্রজন্বের মাঝে সেই চেতনার অভাব পরিলক্ষিত হয় তার কারণ কি বলে মনে করেন?
খান জিয়াউল হকঃ এটি বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে হচ্ছে। এ প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে বলে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে সহজেই। সে ক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতিও প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক। আগেই বলেছি ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের চেতনাকে ধরে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।
জলসিঁড়িঃ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষিত হওয়াকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
খান জিয়াউল হকঃ এটি অবশ্যই আমাদের একটা বড় অর্জন। তবে নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রকৃত শিক্ষা। বিদেশী ভাষা নয় নিজের মাতৃভাষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়ায় এই দিবসের তাৎপর্য।
জলসিঁড়িঃ একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে দীর্ঘদিন যাবৎ আপনি মাগুরায় সক্রীয়ভাবে কাজ করে গেছেন। ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় মাগুরার অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষিত কিভাবে মূল্যায়নকরেন?
খান জিয়াউল হকঃ মাগুরার সাহিত্যাঙ্গনের ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। ফররুখ আহমেদ, কাদের নেওয়াজ, সৈয়দ আলী আহসান, সিরাজুদ্দীন হােসেন (শহীদ বুদ্ধিজীবী), লুৎফর রহমানের মত সাহিত্যিকরা সমৃদ্ধ করেছেন মাগুরাকে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একই রকম ইতিহাস। মাগুরার থিয়েটার সারা জাগিয়েছিল সারা দেশেই। সঙ্গীত, নৃত্যসহ সংস্কৃতির সব শাখায়ই মাগুরার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে মাগুরা এখন অন্যান্য জেলার তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দুএকটি সংগঠন সঙ্গীত ও নৃত্য চর্চা করলেও থিয়েটার চর্চার অবস্থা ভালো নয়। শত হতাশার মাঝেও মাগুরায় সপ্তকের মত লিটল ম্যাগাজিন অথবা কণ্ঠবীথির আবৃত্তি চর্চা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় আশা জাগিয়েছে।
জলসিঁড়িঃ বর্তমান প্রজন্বের মাঝে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় অনেকটা বিমুখতা লক্ষ্য করা যায়। এর পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ঠ ইতিবাচক ভূমিকার অভাব আছে কি-না? থাকলে তার কারণ কি? আপনার দীর্ঘ শিক্ষাগত জীবনের আলোকে মূল্যায়ন করুন-
খান জিয়াউল হকঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের আন্তরিকতা না থাকলে কোন প্রতিষ্ঠানই ইতিবাচক কিছু করতে পারেনা। আগে শিক্ষকতা পেশায় যারা আসতেন তারা একটি আদর্শ নিয়ে আসতেন। এখন শিক্ষকতা পেশা বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে। আগে শিক্ষকেরা ক্লাসে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম নিয়ে কথা বলতেন। এখন সেরকম শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণের কারণেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। তাই নতুন প্রজন্মের মধ্যে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় যে ভূমিকা শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাখার কথা তা যথাযতভাবে রাখতে পারছেনা।
জলসিঁড়িঃ আপনার অনেক মূল্যবান সময় থেকে আমাদেরকে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য সপ্তক পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
খান জিয়াউল হকঃ আপনাকে এবং সপ্তক পরিবারকেও ধন্যবাদ।