লোকশিল্পী মহেন্দ্রনাথ গোস্বামীর জীবনকথা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শামীম খান

মাগুরার শালিখা উপজেলার শতখালি ইউনিয়নের গোয়ালখালী গ্রামের লোককবি ও বাউল মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী  জেলার লোক শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম পুরাধা ব্যক্তিত্ব। তার রচিত প্রায় ৫ হাজার গান অনুসারী বাউল শিল্পীদের লোকচর্চায় এখনো প্রাঞ্জল। যার মধ্যে খুবই কমসংখ্যক লিখিত অবস্থায় আছে।

ইংরেজী ১৯১২ সনে গোয়ালখালীতে এই মহান লোক ব্যক্তিত্বের জন্ম। জন্ম তারিখটা কেউই সঠিকভাবে বলতে পারেননি। তবে ১৭ জ্যৈষ্ঠ বাংলা ১৩২৯ জন্ম তারিখটি মোটামুটি ভাবে সঠিক হিসাবে ধরা হয়। তার ডাক নাম মহিন মতান্তরে মহেন । তবে তিনি মহিন গোঁসাই নামেই সমধিক পরিচিত। বাবার নাম নিবারন গোস্বামী। মাতা পর্ণবালা । মা পর্ণবালার কাছেই তার লোক সংগীতের হাতে খড়ি। সংগীতের প্রতি অনিবার্য টান থেকেই শিশু বয়সে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ৩০ বছর পর বাউল বেশে ফিরে এসে নিজ বাড়িতে লোক সংগীত সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি কার্যত বাউল গান, ভাবগান, জারি, সারি, ধূয়ো, মারফতি, মুর্শিদী গান করতেন। এটিই ছিল তার ধ্যান, জ্ঞান ও পেশা।

নিজস্ব যন্ত্রী দিয়ে গঠিত লোকদল নিয়ে সংগীত জীবনের দীর্ঘ একটি কাল তিনি মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলা এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় লোক সংগীত পরিবেশন করেছেন। গান গেয়েছেন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে। তার লেখা অনেক গান এই দু’টি গণমাধ্যমে এখনো প্রচারিত হচ্ছে। মহিন গোসাই এর সংগীত জীবনে রচিত কিছু গান এরকমঃ

আমি দিন অতি/ওহে বিশ্বপতি/অকুলেরও গতি/কর  হে-/তুমি দিনবন্ধু/করুনার সিন্ধু/কৃপা বিন্দু দান/কর হে \/তুমি আদ্যেরও অনাদি/ব্রক্ষ সনাতন/তুমি আকার সকার/তুমি নিরঞ্জন।/তুমার লিলা খেলা/বোঝে কোনজন/সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়/কর হে \

এটি একটি আধ্যাত্ববাদী লোক সংগীত। অধিকাংশ আসরের শুরুতে বন্দনা হিসাবে এই গানটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। এছাড়া মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী তথা মহিন গোঁসাইয়ের লেখা অন্যান্য গানগুলো হচ্ছে নিম্নরূপঃ

সাধের একতারা/তোর জন্যেতে হইরে পাগলপারা/তোর একতারে কি ঝংকারে/জানে ভাবুক যারা।/ও তার যায় জাতিকুল/হয় সে বাউল/তোর সাথী হয় যারা/সাধের একতারা \

মহিন গোসাই এর আর একটি গান এরকমঃ

গেলাম মলাম চুবনী খালাম/তবু লজ্জা হয় না/আমার এ জ্বালাতো সয় না\/ভবেতে এলাম একা/তারপরে জুটলো দোকা/সেই বশে হইলাম ভ্যাকা/পেয়ে সাধের ময়না/এ জ্বালাতো সয় না।/তার স্বার্থে হানি হয় যখনি/আর তো ফিরে চায় না/আমার এ জ্বালাতো সয় না\/গেলাম মলাম চুবনী খালাম/তবু লজ্জা হয় না/আমার এ জ্বালাতো সয় না\

তার লেখা অসংখ্য ধুয়োগান এখনো মানুষের মুখে মুখে আছে। এগুলো সাধারণত জারি সারির আসরে বন্দনা হিসাবে গাওয়া হতো। এইসব ধুয়োগানের মধ্যে একটি গান এরকমঃ

শোন ভাই মোমিন মুসলমান/কোর-আনে আনো ঈমান/সামনে তোর আছে মিজান/আছে নিক্তি ধরি/যেদিন হিসাব নিবে/ওজন দেবে/আপনি পাক বারি/কমবেশী হলে দুষিমন/দোজখে শাস্তি ভারি\

তার রচিত আরেকটি ধর্মীয় বন্দনা সংগীত এরকমঃ

সভাতে আছেন বসে/মন উল্লাসী মোমিন ভাই/আসসালামু আলাইকুম জানাই/ধর্মরাজ সভায়।/সুন্নত ফরজ আদায় কর/চাঁদ বদনে আল্লাহ বল/সে বিনে আর গতি নাই।/সেই যে মালেক সোবহান/নিদানে করবেন আছান/সেদিকে খেয়াল রেখ সর্বদাই।/অখন্ড সেই পিতার শিরে/ছিলাম যখন ঢাকার শহরে/ইচ্ছা শক্তি বিস্তারে/তখন আমার চিন ছিল না এই ভবের পরে।/চড়ে সেই ঢাকার মেইলে/কমলাপুরে এলাম চলে/সাত তলার দুয়ার খুলে/রংপুর তাই দেখতে পেলাম নজরে।/উদাসপুর এলাম যখন/গাড়ি বদল সেই খানেতে/কত উল্টো গলি উদয় কলি/দেখলাম নজরে।/সেই শহরে মানুষ যত/মুখে আহার করে নাতো/চান করিলাম ত্রিবেনে।/যখন ৩ তারেতে খবর হয়/প্যাসেঞ্জার সব নেমে যায়/দীন মহেন্দ্র তাই ভেবে কয়/আমারে যা করেন তাই/সাঁই নিদানে \

তার লেখা আরেকটি ভাবগান এরকমঃ

শোন ভাই মুমিন/প্যাঞ্জেগানা ৩০ মতি/এই কর সঙ্গের সাথী/জ্বলবে তোর নূরের বাতি/নবী হবেন সখা/সেদিন আঁধার ঘর উজ্জ্বল হবে/যাবে সেরূপ দেখা/শোনরে মমিন বোকা।/কোন নবীর মাজার/আছে মদিনায়/সে কথা বলো গো নেহাত,/কোন নবী হয় বান্দার হায়াত/কোন নবী উফাত,/কোন নবী করবেন সাফায়াত।/কোন নবীর নূরেতে পয়দা/একুল মাকলুকাত।/নবীর ভেদ পেলে পরে/এ সংসারে জানতাম তবে/নবীর জাত কি সেফাত\/পেলে নবীর দেখা যেত ধোকা/রাখিতাম দিলে/করিতাম সঙ্গের সাথী দিবারতি/উঠতো জ্বলে হৃদকোমলে।/সাফায়াত করবেন নবী আখেরে/একথা লিখে দলিলে\

তার লেখা এই ভাবার্থের আরেকটি গান এরকমঃ

নূ নবীজীর তজবী ধর/বল সকলে/এজনম গেলে বিফলে/বুঝবি অনায়াসে।/স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ নয়রে ভিন্ন/দুই বর্ণ এক যুগে আসে/তুই হলিরে যোগের এক পড়–য়া/তাই দেখে মহেন্দ্র হাসে।/বীজগণিত ঠিক রাখিও মন আমার/নইলে তোর সকাল অকারণ/আট আটা চৌষট্টি ঘরের/অংক নাও কষে/পাশ করবি দশটি ক্লাসে/তখন প্রথম ভাগের ভাগ তুই পাবিরে।/ইতিহাস ইতি দিয়ে/ভুগোল শেখ মন/সঙ্গেতে রেখ ব্যকরণ/কোনখানে বস্তু আছে জানবি তখন।/বস্তু না চিনলে পরে কেমন করে/খুলবে তোর জ্ঞানের নয়ন এদিন কাটালে/পরীক্ষা আসবে যখন/ও বোকা মন/পাশ করবি তুই/কি বোল বলে।/ফেল করলে সেই দিনতে/মন আমার/পড়তি তুই কালের কবলে \

তার লেখা অসংখ্য গান এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে বলে জানা যায়। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছয় পুত্র ও এক কন্যার জনক ছিলেন। শুধুমাত্র তার দ্বিতীয় পুত্র অধির বাউল সাধক হিসাবে  মহেন গোঁসাইয়ের অনুসারী হয়েছেন। বিভিন্ন আসরে তিনি বাবার গান পরিবেশন করছেন। এছাড়াও মহেন্দ্রনাথের শিষ্য সুরত আলী বয়াতী ও অশ্বিনী বয়াতী বিভিন্ন আসরে তার গান গেয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।

মহেন্দ্রনাথ গোস্বামীর মৃত্যু বিষয়ে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। তার পুত্র অধির বিশ্বাস জানান- তিনি আধ্যাত্ববাদের মন্ত্রে মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে মহাপ্রয়ানের সঠিক দিনক্ষণ সবাইকে জানাতে পেরেছিলেন। ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৮৯ সালের ১৮ সেপ্টেবর রাত ১১.৩০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। মহেন্দ্রনাথের নিকটজন ও শুভানুধ্যায়ী এড. আব্দুল আজিজ এবং বাউল গবেষক মনোরঞ্জন বসুর সাথে আলাপচারিতায় এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। 

মন্তব্য: