গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী
পাঁচ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সেদিন ছিলো অন্ধকার রাত। সেই অন্ধকারের মধ্যে যথাসময়ে চন্ডীদাস নৌকা নিয়ে রজকিনীর ঘাটে আসলো। রজকিনী আগেই ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে বসলো। নৌকা স্রোতের টানে ভেসে চললো। অনেক সময় কারো মুখে কোন কথা নেই। একসময় চন্ডীদাস রজকিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে নিয়ে সংসার করতে চাই। তুমি কি আমাকে ভালবাসো না?
– একথা তোমাকে বলতে হবে, তুমি কি একটুও বোঝনা। একটি মেয়ে এতরাতে কি করে একা তোমার কাছে আসতে পারে তা-কি বুঝতে পারো না।
– আমার ভুল হয়ে গেছে রজকিনী, বলো এখন আমি কি করতে পারি।
– তুমি জমিদার পুত্র, বিদ্বান একজন কবি। তোমার সুনাম-সুখ্যাতি চারিদিকে আর আমি একজন সাধারণ ধোপার মেয়ে। তোমার সাথেতো আমার কোন সম্পর্ক হতে পারে না। এটা তোমার ধর্মেও মেনে নেবে না। তাহলে তুমি কি চাও?
– তুমিই বলো কি করতে হবে আমাকে?
– এই সমাজে তোমাকে আমাকে কেউ মেনে নেবে না। পরিণতিতে হবে আমাদেও উপর নানা অবিচার, অন্যায় ও নির্যাতন। এটা আমরা মেনে নিতে পারবো না।
– কি করবে তুমি বলো?
– তাহলে শাস্ত্র পড়ে তুমি কি শিখলে? কৃষ্ণ সাধনায় তোমার কি ফল হয়েছে বলো। যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের লীলা যমুনাতীরে সংঘটিত হয়েছিল সেখানে তার স্বার্থকতা লাভ করেনি। তার জন্য তাদেরকে চিরতরে বিদায় নিয়ে বৃন্দাবনে চলে যেতে হয়েছিল। কৃষ্ণকে যদি তুমি ভালবাসো, রাধা-কৃষ্ণের আদর্শে যদি তুমি বিশ্বাসী হয়ে থাক, রাধা-কৃষ্ণের ব্রত যদি তোমার জীবনপথের দিশারী হয়, তাহলে আমাকেও নিয়ে চলো সেই বৃন্দাবনে, যেখানে রাধা-কৃষ্ণের ছোঁয়া আছে। সেই ছোঁয়ায় গড়ে তুলবো তোমার আমার প্রেমের নবকুঞ্জ। হাসতে হাসতে চন্ডীদাস বলেন-
– তুমিতো আমার মতো শাস্ত্র অধ্যয়ন করনি, তবু তুমি অনেক কিছু শিখে ফেলেছো। তুমিই হতে পারবে আমার একমাত্র জীবনসঙ্গিনী। তোমাকে বৃন্দাবনে নিয়ে নয়, তোমাকে নিয়ে গাছতলায় বসবাস করতে পারি।
– তুমি যেটা ভাল বোঝ সেটাই কর চন্ডীদাস। আমি যে তোমার সাথে একাকার হয়ে গেছি। আমি রাধা হয়ে তোমার মাঝে কৃষ্ণকে পেতে চাই।
রাত গভীর হলো। একসময় সিদ্ধান্ত হলো আগামীকালই সবার অজান্তে তারা বৃন্দাবনের পথে রওনা হবে।
ছয়
লোকমুখে শোনা যায়, চন্ডীদাস রজকিনীর ঘটনা। চৌদ্দশ শতকের শেষভাগ বা পনের শতকের প্রথমভাগে এ ঘটনা ঘটেছিল। মতভেদ থাকলেও চন্ডীদাস ও রজকিনীর বাড়ি ছিলো মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শতখালি গ্রামে। তার অনেক প্রমাণ এখনও বিদ্যমান। এক সময় হিন্দু ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়ের লোক এই গ্রামে বাস করতো না। গ্রামটি অনেক প্রাচীন। এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক শতটি কালি মন্দিরের পাশাপাশি দূর্গা গড়ে তুলেছিল। শতখালী গ্রামের গড়পাড়ায় কালিমন্দিরের উত্তর পশ্চিম কোনে একটি প্রাচীন গোপাল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে।
শতখালি গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বড় জলাশয় আছে। এই জলাশয়টি অমৃত্য কুন্ডুর দোহা নামে পরিচিত। জলাশয়ের পূর্বদিকে আগে পানি থাকতো এখন পানি থাকেনা। সেখানে ধানচাষ হয়। অনেকের অভিমত, জলাশয়টি এককালে নদী ছিলো, নদী মজে যেয়ে এই জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তবে নদীর নাম পাওয়া যায় না। অমৃত্য কুন্ডুর দোহা থেকে কয়েকশ গজ দূরে আজকের মরে যাওয়া নদীর দক্ষিণপাড়ে আছে চন্ডীদাসের ভিটে। ভিটের পাশের পশ্চিম দিকে আছে একটি দাস পরিবার। এই পরিবারের লোকজন কয়েকশ বছর ধরে বসবাস করছে। এক পরিবারের কর্তার নাম সুধীর দাস। আর নদীর উত্তর পাড়ে শতখালি গ্রামের একটি পাড়ার নাম ছিলো ধোপাপাড়া। এখন এ ধোপাপাড়ার নাম ধোপাখালী। এ ধোপাখালীর নদীর কিনারে ছিল রজকিনীর বাড়ি। সে বাড়ির ভিটেও আজ আছে। ভিটের উপর ছড়িয়ে আছে মাটির তৈজসপত্রের ভাঙ্গা টুকরো।
যতদূর জানা যায়, চন্ডীদাস ছিলেন বাসলী বা বিশালাক্ষী দেবীর মন্দীরের পূজারী আর রজকিনী প্রেমে পড়ে হয়েছিলেন তার সাধনসঙ্গিনী ও প্রণয়ী তারপর হয়েছিলেন গোপাল মন্দিরের দাসী বা সেবিকা। রজকিনী বামী তারা বা রাম তারা নামে পরিচিত ছিলেন। তবে চন্ডীদাসের প্রকৃত নাম কি ছিল জানা যায় না। চন্ডী শব্দের অর্থ দূর্গার রূপ বিশেষ, দূর্গা দেবীর পূজারী ছিলেন বলে দূর্গা দেবীর দাস হিসেবে চন্ডীদাস নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের ওপরে পুঁথি রচনা করেছিলেন।
চন্ডীদাস ও রজকিনী শতখালি গ্রাম ত্যাগ করে প্রথমে বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে চলে যান। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে যান বীরভূমের নানুর গ্রামে। এক পর্যায়ে তারা বৃন্দাবনে চলে যান। খোঁজ নিয়ে জানা গ্যাছে, বাকুড়ার লোকজনের সাথে শতখালি গ্রামের দাস পরিবারের আত্মীয়তা ছিল দীর্ঘদিন ধরে। চন্ডীদাসের বাড়ির সামনে নদীতে যেমন পাকা ঘাট ছিলো রজকিনীর বাড়ির সামনেও তেমনটি ছিল। দু’ঘাটের চিহ্ন আজ আর নেই। তবু মানুষ তাদের বাড়ির ভিটের সামনে মরে যাওয়া নদীর অবলুপ্ত ঘাটকে প্রেমের ঘাট বলে আখ্যায়িত করে থাকে। কেউ যদি চন্ডীদাস আর রজকিনীর ভিটে দেখতে যেতে চান তাহলে মাওয়া-যশোর মহাসড়কের আড়পাড়া ও সীমাখালির মধ্যবর্তী স্থান নতুন ঘাট থেকে নেমে প্রায় দু’কিলোমিটার পূর্বদিকে পাকা রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে শতখালি গ্রামের চন্ডীদাস-রজকিনীর বাড়ির ভিটে আর তাদের প্রেমের ঘাটের স্থান। মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার সিন্দাইন গ্রামের মরহুম ছেরমাতুল্লা মোল্লার কাছ থেকে ষাটের দশকে আমি একটি গান সংগ্রহ করেছিলাম। গানটি সংগ্রহকালে তার বয়স ছিল ৭০ বছর। তিনি এ গানটি শুনেছিলেন তার পিতামহের যৌবনকালে এক বৃদ্ধের থেকে। গানটি হলোঃ
প্রেমের ভাবের অনেক গতি/বোঝা বড় দায়।/প্রেমে ডোবে প্রেমে ভাসে /এই আজব দুনিয়ায়।/রজকিনীর প্রেমে পড়ে /চন্ডীদাস জ্বলে পুড়ে /বারো বছর বাইলো বড়শি/বসে নদীর কিনারায়।/চন্ডীদাসের সাধন সঙ্গিনী/হয়েছিল রামীরজকিনী/কৃষ্ণ প্রেমের ফুল ফুটায়ে/সৌরভ দেছে বিলায়ে।/হরিহর তাই ভেবে বলে/প্রেমের মালা পাইনি গলে/চন্ডীদাস হইনি, পাইনি রজকিনী/বিথায় জীবন যায়।
{লেখকের কৈফিয়তঃ মাগুরা জেলার শতখালী গ্রামের চন্ডীদাস-রজকিনীর ভিটা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে। কেউ হয়তো বলতে পারেন আজগুবি গল্প। তবে এ ভিটার সাথে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। কিংবদন্তি কোন যুক্তি-তর্ক- এর শ্রোতধারায় প্রবাহিত হয় না। কিংবদন্তিতো কিংবদন্তিই} (সমাপ্ত)