একটি লাশ ও চেতনার মৃত্যু

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সনোজ কুণ্ডু

সুখীপুরের মানুষ তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ কারো পিলে চমকানো চিৎকারে রাত্রির নীরবতা ভেঙে যায়। এ লাশ কার! এ খবর সবার মুখে মুখে, পথে-পাথারে দাবানলের রূপ নেয়। কার আগে কে পৌঁছে দেবে খবর। কেউ ঘরে বসে নেই। চারদিকে মানুষ হন্যে হয়ে ছুটছে। সবার কণ্ঠেই পরানকাঁপা প্রশ্ন- কার লাশ! মসজিদের ইমাম লাশের খবর মাইকে ঘোষণা দিয়ে আতঙ্কের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। শুধু সুখীপুর কেন, ঐ ঘোষণা শুনে মহেশপুর, শ্রীপুরের মানুষও ছুটে আসে। হারিকেন. টর্চলাইট, কুপি হাতে জমির আল দিয়ে, কেউ বাগানের পথে, বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে উত্তর পাড়ার গহর কবিরাজের বাড়ির পথে ছুটে চলে। মানুষের এই অসহায় চেচামেচিতে বিশ্বস্ত কুকুরগুলোও বসে সেই- ঘেউ ঘেউ আওয়াজ তুলে নিজস্ব পাড়ার সীমানা পেরিয়ে নির্ভয়ে ছুটাছুটি করে। তাদের অঙ্গভঙ্গিতে বুজিয়ে দেয়- আমরাও আছি তোমাদের পাশে। 

এদিকে লাশের খবর শুনে পূর্বপাড়ার সীতানাথের মা আর্তনাদ করে ওঠে- ওরে আমার সীতানাথ! ঘরের ঈশান কোণের খুঁটির সাথে কপাল ঠুকে ঠুকে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সীতানাথ আজ সপ্তাহ ধরে গঞ্জে আছে। গতকাল আসার কথা থাকলেও তার খোঁজ মেলেনি। গভীর উৎকণ্ঠায় সীতানাথের নয় মাসের গর্ভবতী বউ ছায়া রাণী ঘরে বসে থাকতে পারে না। হরি হরি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।

এদিকে আয়নাল মেম্বর তার দুই জোয়ান ছেলেকে নিয়ে যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় তখন কবিরাজের বৈঠকখানা, উঠোন, পুকুর পাড়ে কৌতুহলী জনতার উপচেপড়া ভিড়। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে একটা ঝুপড়িতে কারা যেন কফিনে করে একজন বয়সী মানুষের লাশ রেখে গেছে। কবিরাজের ছোট বউ লায়লা খাতুন প্রকৃতির ডাকে বাইরে এলে বোরকা পড়া দু’জন মানুষকে বাগানের পথে দৌড়াতে দেখলে সন্দেহ জাগে। কবিরাজ লাইট হাতে বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখে। তখনি তার পালিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ঘটনাস্থলে চোখ পড়ে। বড় বউ করিমননেছা ঐ লাশ একঝলক দেখে বিকট চিৎকারে গ্রামের মানুষকে প্রথম জানান দেয়। সমস্ত বাগান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কাউকেই দেখা গেল না। মৃত লোকটির পরণে লু্ঙ্গি-পাঞ্জাবী। মুখে বসন্তের দাগ। গায়ের রঙ মিচমিচে কালো। লোকটি খুন হয়েছে কিনা এ সন্দেহ অনেকের। লাশটি এপিঠ-ওপিঠ করে তেমন কোন ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেল না। 

কবিরাজ এ গ্রামের সবচেয়ে বুদ্ধিমান। গাঁয়ের শালিশ দরবারে সেই মধ্যমণি। স্মরণশক্তিও বেশ প্রখর। সাতগ্রামের মানুষ তার চেনা। গলা শুনলেই চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে কোন গাঁয়ের কোন পাড়ার মানুষ সে। অচিন লাশের আবির্ভাব তাকেও বেশ বিচলিত করে। সুখীপুরবাসী এমন আজব ঘটনার মুখোমুখি কোনদিন হয়েছে কিনা কেউ মনে করতে পারে না। অমাবশ্যার পাথর কালো রাতে এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে তারা বেশ ভীত। গ্রামের শিশু-কিশোরদের মাঝেও সে আতংক ছড়াতে সময় লাগে না। ভয়ে তারা জড়োসড়ো। ঘর থেকেও বের হয়নি। শক্ত করে চোখ বন্ধ রেখে কোনমতে রাত্রিটা পাড় হবার অপেক্ষায় আছে। তবে তাদের নিজস্ব জ্ঞান থেকে বুঝে নিয়েছে লাশটা যখন চেনাই যাচ্ছে না- সেটা ভূত ছাড়া আর কি হতে পারে? অনেকে লাশটা দাফন করে পরিস্থিতি সামাল দেবার পরামর্শ দেন। কিন্তু গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা একটা বেওয়ারিশ লাশ এভাবে দাফন করার পক্ষে মত দিলেন না। কবিরাজের বাড়ির অন্দর মহল থেকে মহিলাদের ভেতর উচ্চকন্ঠের বাক্যবিনিময় শোনা যায়- তারা কেউ এখানে লাশটা রাখার পক্ষপাতী নন। এ নিয়ে কবিরাজের সাথেই তার স্ত্রীদের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। কিন্তু এতো রাতে অজানা লাশ কাঁধে করে নেবার সাহসী মানুষ খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে  লাশ পাহারা দেবার জন্য দু’জন যুবককে রাখা হলো।  

পরদিন দুপুর গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত লাশের কোন হদিস না পাওয়ায় দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কেউ কেউ পুলিশের কাছে হস্তান্তরের কথা বললেও অতিরিক্ত হয়রানীর ভয়ে তা হয়ে ওঠেনি। 

নতুন ঘটনার সূত্রপাত তখনই- লাশটাকে গোছল করানোর সময় তার পাঞ্জাবীর পকেটে পাওয়া যায় মোড়ানো একটি কাগজ। কাগজটি দেখে হারুর সন্দেহ হয়। সিদ্দিকের হাত থেকে একপ্রকার জোর করে ছিনিয়ে পড়তে শুরু করে। তাতে লেখা- আমি একজন রাজাকার, সাড়ে তিনহাত মাটি চাই। 

বিষয়টি কবিরাজের নজরেও পড়ে। এমন বিস্ময়কর ঘটনা জন্মেও কেউ দেখেনি- শোনেওনি। এ খবর বাতাসের আগে মানুষের কানে পৌঁছে যায়। শেষ বিকেলে উৎসুক জনতা আরেক দফা হুমড়ে পড়ে। সবার মুখে মুখে হৈ চৈ পড়ে যায় লাশটির পরিচয় মিলেছে। সে একজন রাজাকার।

বেওয়ারিশ লাশ দেখার চেয়ে রাজাকার দেখতে আসা মানুষের সংখ্যা ঢের বেশি। যারা কখনো রাজাকার দেখেনি বা এই শব্দটির সাথে অপরিচিত- তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশু-কিশোর। ওদের ধারণাÑ রাজাকার হিংস্র কোন প্রাণী। নিশ্চয়ই চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে এসেছে। ওদের শিং আছে। ধারালো হাত-পা আছে। একনিঃশ্বাসে মানুষ গিলে খেতে পারে।    

কিন্তু বিষয়টি সহজ ভাবে নিচ্ছেন না আয়নাল মেম্বর, হরিপদ মাস্টার, রেজেক মাতুব্বরেরা। মাইকে ঘোষণা দিয়েও জানাজায় লোক না আসায় তাদের চিন্তার মাত্রা বেড়েই চলে। উপায় অন্ত না দেখে ঠিক সন্ধ্যায় লাশটাকে দক্ষিণপাড়ার গোরস্থানে নিয়ে আসা হয়। গোরস্থান দেখাশুনার দায়িত্বে আছেন কালু বয়াতী। এই গ্রামের সবচেয়ে পুরানো মানুষ। জীবনের একটি মুহূর্তের জন্যও এ পবিত্র স্থান ছেড়ে সে চলে যায়নি। যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ থাকবে- যাবে না কোনদিন। প্রতিটি কবর সে অতি যত্ন করে বুকে আগলে রাখেন। আজ পর্যন্ত কেউ কোনো কবরে একটি পরগাছা জন্মাতে দেখেনি। সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে ধূপ-আগরবাতি জ্বালিয়ে একতারা হাতে গলা ছেড়ে গান ধরে-

রঙ্গ রসের এই দুনিয়ায়

কেউ চিরকাল থাকবে না।

সোনার অঙ্গ মাটি হবে

মাটি হবে বিছানা। 

তখনো গান শেষ হয়নি। গহর কবিরাজ দলবল নিয়ে কালু বয়াতীর সামনে দাঁড়ায়। কফিনে রাখা লাশটি দেখিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করতে বলে। বয়াতী তখন ভাবের অতল জগতে ডুবে আছে। গাইতে গাইতে গোরস্থানের ভেতর প্রবেশ করে। যেখানে নিজেকে হারাতে পারে। কিছুক্ষণ পর অশ্রসজল চোখে কবিরাজের মুখোমুখি হয়। কফিনে রাখা লাশটি দেখে তিনি চমকে ওঠেন। হয়তো লাশটি তার চেনা কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বললেন না। তবে দু’চোখে তার আগুনের ফুলকি ঝরে। এমন অগ্নিমূর্তি তাকে কেউ কোনদিন দেখেনি। বাজখাই কণ্ঠে লাশটি সরিয়ে নেবার নির্দেশ দিলেন। কিছুতেই এ লাশ তিনি গোরস্থানে রাখবেন না। পবিত্র মাটির সাথে এতোবড় প্রতারণা করতে সে রাজী নয়। কারণ এখানেই যে ঘুমিয়ে আছে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় কালু বয়াতী গোরখোদকের কাজ করেছেন। নিজ হাতেই দাফন করেছেন কত লাশ। জীবনভাঙা কষ্টের স্মৃতিটা হল- শেষ লাশটি ছিল তার নিজের সন্তান মজিবরের। বুলেটের আঘাতে ঝাঝড়া হওয়া রক্তাত্ব দেহটা চিনতে পেরে উন্মাদের মতো আর্তনাদ করে ওঠেন। মিনিটখানেক বুকে জড়িয়ে রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র। 

আজও সেই দ্বগ্ধ স্মৃতি তাকে দুমড়ে-মুচড়ে খায়। বয়াতী অতোটা অমানুষ নয়- সেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিছানায় একজন রাজাকারকে ঘুমাতে দেবে! এ কথা ভেবেও নিজেকে মহাপাপী ভাবতে শুরু করেন।

লাশ নিয়ে নতুন করে চিন্তায় পড়তে হয় গহর কবিরাজদের। রাত্রি বেড়েই চলে। কি হবে? একজন মৃত মানুষের দাফন হবে না।  লোকটি যাই হোক একজন মানুষতো! এই মানবিক শ্লোগান শুনিয়েও কোন কাজ হয় না। জনতার ভিড়ও ধীরে ধীরে কমে আসে। এদিকে রাতের ভেতর লাশটি দাফন না করা হলে নিশ্চিত পচন ধরবে। তার কিছু আলামতও পাওয়া যায়। এমনই সংকটাপূর্ণ মুহূর্তে এগিয়ে আসে মুহিন, মন্টু, কামাল। তারা সবাইকে নিশ্চিন্ত করে কফিনবন্দী লাশ নিয়ে যায় তিনরাস্তা মোড়ে। সুখীপুর, শ্রীপুর, মহেশপুর ঢোকার মূল পথ এটি। রাস্তার কোল ঘেঁষে অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে বুড়ো পায়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বটগাছ। তার পাশেই লাশটির দাফন শেষ হয়। মানুষটির আপন বলতে কেউ কাছে ছিল না। দুফোঁটা চোখের জলও কেউ ফেলল না। মুহিন এখানে একটি স্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব রাখে। যার নাম হবে- ‘রাজাকার স্তম্ভ’। হাসি চাপিয়ে বিস্ময় চোখে অন্য বন্ধুরা তাকে দেখে। মুহিনের যুক্তি হল- শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যখন স্তম্ভ নির্মিত হতে পারে- একজন রাজাকারের নামে কেন হবে না। সে স্তম্ভে মানুষ শ্রদ্ধা জানাবে না ঘৃণা করবে সেটা তারাই ঠিক করবে। এমন অভিনব প্রস্তাবের কথা শুনে মুহিনকে ওরা জড়িয়ে ধরে। নগ্ন জ্যোৎস্না সবটুকু মেলে ধরে ওদের চলার পথে…   

মন্তব্য: