ইব্রাহিম আলী মোনাল
তিনি ছিলেন একজন নিরেট সাহিত্যভাবনার মানুষ। তার লেখনিতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। দৈনন্দিন কাজের অবসরে যতটুকু সময় যথেষ্ঠ থাকতো তা তিনি ব্যয় করতেন সাহিত্য-সাধনায়। মূলতঃ কবিতা লিখতেন। গল্প ও প্রবন্ধও লিখেছেন অনেক। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে লিখতেন কবি ভোলানাথ সিকদার- আমাদের প্রিয় ভোলাদা।
ভোলানাথ সিকদার এ প্রজন্মের লেখিয়েদের কাছে হয়তো অজানা, অচেনা। কিন্তু আমি এবং আমার সমসাময়িক লেখক বন্ধুরা তার সান্নিধ্য পেয়েছি, তার সান্নিধ্যে থেকেছি। প্রিয় এই মানুষটাকে চিনেছি খুব কাছ থেকে । বুঝেছি আপন থেকেও আপন করে। সাহিত্য, চায়ের আড্ডা- সবখানেই সরব উপস্থিতি ছিল তার। সহ-সৈনিকদের মাতিয়ে রাখার অপূর্ব কৌশল জানতেন তিনি। প্রতিটি লেখায় শব্দচয়ন করতেন নিপূণতায়। শব্দ বুননে কোথাও হোঁচট খেয়েছেন কিংবা পড়তে গিয়ে লেখা গতিময়তা হারিয়েছে, কখনোই এমনটি মনে হয়নি আমার। তার প্রতিটি লেখাই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যের প্রত্যেক শাখায়ই তার কলম ছুঁয়েছে অনাড়ষ্ঠতায়। কলেজরোডস্থ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যখনই গিয়েছি, তখনই দেখেছি ভোলাদা লিখছেন। অনেক সময় বসতে বসতে কথা বলেছি। অনেক সময় কিছু না বলে চুপচাপ বসেও থেকেছি। ভোলাদা লেখায় এতোটাই মগ্ন থাকতেন যে আমার পায়ের আওয়াজ তার কর্ণকুহরে পৌছতো কিনা সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হতো। আমার দিকে তার মনোনিবেশ ঘুরাতে আমাকে নানান পথ অবলম্বন করেছি। তাতে কখনো কাজ হয়েছে কখনো হতাশ হয়েছি নিজেই।
ভোলাদা’র ছিল অসাধারণ চিন্তাশক্তি। ভাবতেন বেশি। বলতেন কম। তার চেয়ে লিখতেন আরো কম। স্থানীয় পত্র-পত্রিকা, সাহিত্যের ছোটকাগজগুলোতে তার অনেক লেখা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘নবগঙ্গা’, ‘নির্মাণ’, ‘নদীপ্রবাহ’, ‘লেখকজোট’, ‘শেকড়ের সন্ধানে’ এবং কবি সাগর জামান সম্পাদিত ছোটকাগজগুলোতে ভোলাদা’র অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
ভোলাদা’র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকদের আর তেমন কোন আড্ডার জায়গা ছিল না। তাই আমরা সেখানেই সাহিত্যবিষয়ক আড্ডায় মেতে উঠতাম প্রতিদিন। এতে ভোলাদা কখনো বিরক্ত হননি। বরং তাকেই বিরক্ত করতাম আমরা। চা-সিগারেট না খাওয়ানোর অজুহাতে ভোলাদা বেঁকে বসেছেন অনেক সময়। তাতে কি? আমরাতো ভোলাদা’র কাছে আপ্যায়িত হতে চেয়েছি। ভোলাদা তখনই রাজি হতেন, যখন আমরা বিশেষ করে কবি সাগর জামান আর আমি তার রচিত কবিতাপাঠ শুনতে চেয়েছি। তখনই সেই সদাহাস্য মুখ। আমি আর সাগর জামান তাকে এভাবেই মাতিয়ে রাখতাম নিত্যদিন। মাগুরার কবিদের মধ্যে বিবেকানন্দ মজুমদার, মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু, কিশোর গোলদার, বিকাশ মজুমদার, বি এম এ হালিম, এম এ হাকিম, শামীম খান, অনিল দে মনি, এম মনির-উজ-জামান, বীরেন মুখার্জী, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, রাশেদুল ইসলাম সাজ্জাদ, সুজিৎ ঘোষ, কমল হাসানসহ তৎকালীন লেখিয়েদের মধ্যে তার সান্নিধ্য গ্রহণ করেননি এমন কবির সংখ্যা যৎসামান্য।
ভোলাদা কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধের পাশাপাশি ভাল রম্য লিখতেন। বিষয়বস্তু যাই হোক, যথাযথ শব্দ চয়নের মাধ্যমে সেটাকে পাঠকের কাছে পৌছে দিতে পারতেন সহজেই। তার ক্ষুরধার লেখনীতে উঠে আসতো সমাজের নানান চিত্র। জীবনের নানা দিক। তার নিপূণ শব্দগাঁথুনি যেমন আমাদের মনে দাগ কেটে যায় তেমনি তার মন্ত্রময় সাজানো-গোছানো কথাগুলো আজও কানে বাঁজে আমাদের…
ভোলাদা প্রয়াত হয়েছেন এক দশকেরও বেশি সময়। নির্মম স্রোতধারায় বছরগুলো বয়ে যায়। কিন্তু নীরবেই কাটে তার জন্ম আর মৃত্যুদিন। তার জন্য আমরা কিছু করতে পেরেছি এটা বলার সৎসাহস অন্তত আমার নেই। মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন, কীভাবে চলছে তাদের দিনপঞ্জী, আমরা তার খোঁজ কতোটা রাখতে পেরেছি? হয়তো এমনই হয়…
অনুভবের দীর্ঘশ্বাসে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি ভোলাদা। তুমি ক্ষমা করো আমাদের সব অপারগতা । তোমার মতো বঞ্চিত প্রয়াতদের নিকট আমরা সারাজীবন ক্ষমাই চেয়ে যাবো।