লিটন ঘোষ জয়
পুতুল দেখেছো তোমরা! মিষ্টি তুলতুলে লালপুতুল, হলুদপুতুল। জানো! লালপুতুলটি সব সময় হাসে আর হলুদপুতুলটি হাসতে হাসতে লুটপুটি খায়। ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফ দিয়ে নাচানাচি করে। আবার বৃষ্টি এলে ভেজে। ভিজতে ভিজতে জবুথবু হয়ে যায়। কিন্তু আম্মু বকা দিলে তখন আর ভেজে না। আম্মু বলে- বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়! তবুও লালপুতুল, হলুদপুতুল লুকিয়ে লুকিয়ে ভেজে…
লালপুতুলটির নাম মারফি, হলুদপুতুলটির নাম এথিনা। আম্মু মারফিকে লালপুতুল আর এথিনা হলুদপুতুল বলে ডাকে। এই পুতুল দুটিকে আম্মু খুব ভালোবাসেন। ওদের প্রতি আম্মু ভীষণ টেক-কেয়ার। লালপুতুল মারফি শান্ত শিষ্ট্র কিন্তু হলুদপুতুল এথিনা খুব চঞ্চল। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। তাই বলে পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় না! তবে হলুদপুতুল ঘুরে বেড়াতে বেশি পছন্দ করে। আর আইসক্রিম খেতে আরো বেশি পছন্দ করে। প্রতিদিন তার আইসক্রিম চায়। মাঝে মধ্যে আম্মু শাসনের সুরে বলে- এত আইসক্রিম খেতে হয় না, ঠান্ডা লাগবে তো! এটা শুনে হলুদপুতুলের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। আম্মু তখন ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে দেয়। আইসক্রিম পেয়ে হলুদপুতুল খুশিতে লাফাতে থাকে। আম্মু এটা দেখে হলুদপুতুলের গালে চুমু দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লালপুতুল ছুঁটে এসে বলল, ‘আম্মু আমাকেও চুমু দাও আর দুইটা আইসক্রিম দাও।’
‘না একটা খাও।’ তারপর আম্মু ফ্রিজ থেকে আরো একটা আইসক্রিম বের করে লালপুতুলকে দিল। তারপর বলল, ‘আইসক্রিম খাওয়া হলে তাড়াতাড়ি পড়তে বসো। কাল না তোমার ম্যাথ্ পরিক্ষা! আর তুমি কিনা এখন সময় নষ্ট করেছো?’
‘আম্মু আইসক্রিমটা খাওয়া হলেই অংক করতে বসছি। প্লিজ! লক্ষী আম্মু রাগ করো না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে যাও। এথিনা, এথিনা এই হলুদপুতুল তুমি আবার কোথায় গেলে?’
এথিনা আইসক্রিম খেতে খেতে দরজার পাশে লুকিয়ে ছিল। আম্মুকে দেখে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আম্মু এই তো আমি এখানে। তুমি ধরতে পারোনি হি…হি…হি…’
‘তুমি আবার দুষ্টুমি শুরু করলে? যাও সোনা আমার এখন পড়তে বসো।’
‘আম্মু আজ কিন্তু তোমার গল্প বলার কথা। তুমি কাল বলেছিল- আজ রাতে গল্প বলবে!’
‘হ্যাঁ বলবো, কিন্তু রাত তো এখনো হয় নি। তুমি এখন পড়া শেষ করো, আমি রাতে তোমাকে গল্প শোনাবো।’
‘আম্মু আজ কী গল্প শোনাবে?’
‘যে গল্প তুমি শুনতে চাইবে। বলো কী গল্প শুনবে- ভূতের না কী ঠাকুমার ঝুলি?’
‘আম্মু আমি গ্রামের গল্প শুনবো। সবুজ মাঠ, নদী আর পাখির গল্প শুনবো।’
‘আচ্ছা, বেশ তোমাকে তাই-ই শোনানো হবে। তবে তোমার জন্য আরো একটা সারপ্রাইজ আছে। কী বলো তো?’
‘হুম…আমাকে পুতুল কিনে দেবে।’
‘ধুর বোকা পুতুল! হলো না আবার বলো- দেখি পারো কী না?’
এথিনা হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘আম্মু দাঁড়াও বলছি তার আগে একটু ভাবতে দাও।’
‘থাক! তোমাকে আর ভাবতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি- তোমাকে আর আপুকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাব।’
আম্মুর কথা শুনে এথিনা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আম্মু সত্যি!’
‘হ্যাঁ, সত্যি, সত্যি, সত্যি কি এখন খুশি তো!’
‘আম্মু আমরা কবে গ্রামে বেড়াতে যাব বলো না?’
‘তোমার আপুর এগজ্যামিনেশন শেষ হলেই আমরা যাব। আচ্ছা, এখন তুমি পড়তে বসো। তা না হলে কিন্তু গ্রামে যাওয়া বন্ধ।’
‘আম্মু আপু কী জানে আমরা গ্রামে যাব?’
‘না।’
‘তাহলে আমি আপুকে বলে আসি যে, তুমি আমাদেরকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাবে।’ এথিনা এক দৌঁড়ে মারফি আপুর রুমে চলে যায়। তারপর বলল, ‘আপু, আপু জানো! আম্মু বলেছে তোমার এগজ্যামিনেশন শেষ হলে। আমাদেরকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাবে।’
‘আম্মু বলেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, এথিনা তুমি এখন যেতে পারো। দয়া করে আমাকে অংক করতে দাও।’
‘সে কী আপু তুমি খুশি হও নি!’
‘ও এথিনা তুমি কী যাবে? কাল আমার অংক পরিক্ষা। আম্মু, আম্মু এথিনা আমাকে অংক করতে…’
পাশের রুম থেকে আম্মু বলল, ‘এই এথিনা আপুকে বিরক্ত করো না। এ দিকে এসো পড়তে বসো।’
এথিনা আম্মুর ভয়ে তাড়াতাড়ি এসে পড়তে বসে- “কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?/গুড়-মুড়ি খাও? দুধ বাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?”
দেখতে দেখতে মারফির পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় আম্মু টেলিভিশন দেখছিলেন হঠাৎ এথিনা বলল, ‘আম্মু আপুর পরিক্ষা তো শেষ আমরা কবে গ্রামে যাচ্ছি?’
আম্মু টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে এথিনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আগামি শুক্রবার আমরা তোমাদের নানাবাড়ি স্বপ্নপুর বেড়াতে যাব।’
‘ও আম্মু আমার যে, কি মজা লাগছে। তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।’
আম্মু হাসতে হাসতে আস্তে করে হলুদপুতুল এথিনার নাক টেনে বলল, ‘তাই বুঝি! আচ্ছা, তুমি বসো। আমি তোমাদের জন্য লুডুস রান্না করে নিয়ে আসি।’
শুক্রবার আম্মুর সাথে মারফি আর এথিনা স্বপ্নপুর এল। স্বপ্নপুর ওদের নানাবাড়ি। আম্মু সময় পেলেই ওদের নিয়ে এখানে বেড়াতে আসেন। তবে এবার অনেকদিন পর এল। কারণ মারফির পরিক্ষা ছিল। তাছাড়া একটার পর একটা ঝালেমা তো লেগেই আছে। আজ এ কাজ কাল সে কাজ। সবকিছু আম্মুকে একহাতে সামলাতে হয়। কেননা মারফি এথিনার আব্বু দেশের বাইরে থাকেন।
মারফি এথিনা এবার ট্রেনে চেপে স্বপ্নপুর আসছে। ট্রেনটা কু…ঝিক-ঝিক-ঝিক করে ছুটে চলেছে; মাঠ-ঘাট বন-জঙ্গল সবকিছু পিছনে ফেলে। হলুদপুতুল এথিনা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে খুশিতে হাততালি দিচ্ছে। আর লালপুতুল মারফি গান গায়ছে- “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে/ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায় রে…।”
আম্মু মারফির কণ্ঠে রবীঠাকুরের এই গানটা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। মনে মনে বলেন- মারফির গানের গলাতো দারুণ! ও এত সুন্দর গান শিখল কী ভাবে! আম্মু যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না। এটা তার লালপুতুল গাইছে! তাও আবার রবীন্দ্র সংগীত!
আম্মু মারফির গান শুনতে শুনতে তার ছোটবেলার স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যান। এই পথেই একদিন তিনি তার আম্মু আব্বুর সাথে ট্রেনে চেপে গিয়েছিলেন স্বপ্নপুর। তিনিও সেদিন খুশিতে গেয়েছিলেন গান।
ট্রেন যখন কু…ঝিক-ঝিক-ঝিক করে ছুঁটছিল। আম্মু তখনও বাতাসে শুনতে পাচ্ছিলেন লালপুতুলের গাওয়া- “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে…”