মাগুরার লোক শিল্পী সুরত আলী বয়াতি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শামীম খান

মাগুরার লোক শিল্পীদের মধ্যে সুরত আলী বয়াতী উলে­খযোগ্য একটি নাম। বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার হাটবাড়িয়া গ্রামে। বাবা মৃত: জয়নাল মন্ডল। মায়ের নাম- তারাবিবি। জন্ম ১৯৪৮ সনের ১৫ আগস্ট ইংরেজি তারিখে। স্ব-শিক্ষিত সুরত আলী বয়াতীর গান গাওয়া শুরু ছেলেবেলা থেকেই। হাতে খড়ি পার্শ্ববতী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জের ঘনু মাস্টার নামের আরেক প্রখ্যাত বয়াতীর কাছে।

লোকসংগীত জীবনের দীর্ঘ সময়ে তিনি মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর নড়াইল ও যশোরসহ বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথম দিকে দীক্ষাগুরুর সাথে পরবর্তীতে নিজস্ব দল নিয়ে গেয়ে বেড়িয়েছেন চমকপ্রদ কাহিনী সমৃদ্ধ জারিগান, কবি গান পালা ও লোক গান। তার পরিবেশিত কাহিনীনির্ভর পালা গানগুলোর মাধ্যে উলে­খযোগ্য হলো- জামাল-জরিনার কেচ্ছা, হাসানের বিষপান, সোহরাব-রোস্তম, মোসলেমের পুত্রবধ ইত্যাদি। 

এ সবের মধ্যে জামাল-জরিনার পালায় মালির মেয়ে জরিনার সাথে ফুল বাগানে দেখা হয় রাজার পুত্র জামালের। গানে গানে গড়ে ওঠে গভীর প্রেম-পরিণয়, অতঃপর বিয়ে। কিন্তু রাজপুত্র জামালের ইতঃপূর্বে লালবানু নামে এক রাজকুমারীর সাথে বিয়ে হয়েছিল এটা জানার পর শুরু হয় বিচ্ছেদের পালা। এক পর্যায়ে ডাকাতি হামলায় লালবানু মারা গেলে নতুন করে সম্পর্ক জোড়া লাগে। পুরো পালাটি পরিবেশিত হয় ছান্দিক অবয়বে। জামাল-জরিনার কেচ্ছাটির রচয়িতা শালিখার ঘনু মাস্টার।

সুরত আলী বয়াতী  প্রায় ১৯ বছর যাবত ঘনু মাস্টারের সাথে থেকে এসব জারি ও পালা গান গ্রামে গ্রামে গেয়েছেন। পরবর্তীকালে তিনি তার নিজ গ্রামে মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী নামের অন্যতম লোকসংগীত শিল্পীর সান্নিধ্যে আসেন। এখানে তিনি গ্রামে গ্রামে তার সাথে দল বেঁধে জারিগান ও পালাগানের পাশাপাশি ধুয়োগান, আঞ্চলিক লোকগান, মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী এবং নিজের লেখা লোকগান পরিবেশন করতেন। তাদের দলটি ছিল ৭থেকে ৮জনের। যার মধ্যে ঢুলি হিসাবে থাকতেন মৃত শরত কুমার, হারমনিয়ামে শ্যাম বাবু। আর মূল গায়কের সুরের বেশ ধরে কণ্ঠে থাকতেন একই এলাকার আছের উদ্দিন শিকদার, গহর উদ্দিন শিকদার ও আব্দুল গনি। সুরত আলী বয়াতী, মহেন্দ্র নাথ গোস্বামীর দলে পরবর্তীতে নিজ নের্তৃত্বাধীন দলে যে জারি কিংবা সমবেত পালা গান গাইতেন সেগুলো পরিবেশনের ধরন ছিলÑ প্রথমে মূল বয়াতি পালা/জারি গানের বন্দনা করবেন। তারপর দোহারী হিসাবে পরিচিত শিল্পীরা সমবেত সুরে জারি বা পালা গান শুরু করবেন। তার সমবেত গানের রেশ ধরেই মূল গায়ক সুর ও ছন্দে কাহিনী কিংবা বিষয়বস্তু উপস্থাপন করবেন। তার রেশ ধরেই আবার সমবেতরা গাইবেন। এভাবেই চলবে গোটা পালা। এই লোক পালা, জারি কিম্বা গানের উপস্থাপনা সময় হিসাবে বেছে নেয়া হয় রাত্রিবেলাকে। যেহেতু এটির মূল ক্ষেত্র গ্রামাঞ্চল আর সেখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষক। সে কারণে সারাদিনের কাজের শেষে তারা এটি উপভোগ করতেই বেশি সাচ্ছন্দবোধ  করবেন। কবে কোথায় জারি, কিংবা লোক গানের আসর হবে তা স্থানীয় হাট বাজারে কাড়া পিটিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে মাইকিং এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়। এক এক গ্রাম থেকে দল বেধে রাত জেগে এই অনুষ্ঠান দেখতে মানুষ ছুটে যায় অন্য গ্রামে।    

সুরত আলী বয়াতীর কাছ থেকে জানা যায় মহেন্দ্রনাথ গোস্বামীর বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন লোক মুখে পাওয়া একাধিক গান পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি নিজের লেখা অসংখ্য গান বিভিন্ন আসরে গেয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া এসব গানের মধ্যে ‘ধুয়ো’ নামের একটি গান এরকম- 

আমার হাল বেয়ে/কালা কেটে গেল/ফসল হলো না,/এসব বিধির ঘটনা।/আমার হালের ষোল দামড়া/কথা শোনে না,/জমির জো না চিনে/ফসল বুনে মহাজনে/হলাম দিনা।/আমার ফসল গেল চলে/গুরু ধন-/উপায় বল না।/বয়স ষোল যখন হলো/করতে এলাম চাষ/চাষে হলো সর্বনাশ,/আমার চোদ্দ পোয়া/জমির মাঝে কোন জমি খান খাস/খান জমি চিনলি/ভাল করে চাষ/তাতে দিতাম বারোমাস/কোন জমি বসত বাড়ি আমারি/যেখান করি বসবাস।/চোদ্দ পোয়া জমির মালিক/আছে তিনজনা/খাজনা কার কত পাওনা/দুইজনা আমার মালিক/একজন দশ আনা/ষোল আনা হিসাব দিবে/হিসাবেতে গোল রেখ না।/তামাদির সময় এলো নিকটে/মহেন্দ্র ভাবছে সেই ভাবনা ।

[এখানে ষোল আনার যে/প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সেখানে/১ মুষ্টি সমান ১ পোয়া ধার্য।/জমির মালিক ৩ জন।/বাবা, মা ও আল্লাহ।/১৮ আনার মধ্যে ১০ আনা/বিধাতা ৪ আনা বাবা ৪ আনা/মা মিলিয়ে ১৬ আনা।/যার অপর অর্থ সম্পূর্ণ]

তার কাছ থেকে সংগৃহিত মহেন্দ্র নাথ গোস্বামীর আরেকটি গান এরকম:

তুমি পড়রে মন তুতাপাখি/ভজন স্কুলে/বৃথাদিন যায় তোমার চলে \/হাস্যরসে মায়ার বশে/এদিন কাটালে/পরীক্ষা আসবে যখন/ও বোকা মন/পাশ করলি তুই/কি বোল ব’লে ।/ফেল করলে সেই দিনেতে/মন আমার/পড়বি তুই কালের কবলে ।/ইতিহাসের ইতি দিয়ে/ভূগোল শেখ মন/সঙ্গেতে রেখ ব্যাকরণ/কোনখানে বস্তু আছে জানিবি তখন ।/বস্তু না চিনলে পরে/কেমন করে খুললো তোমার জ্ঞানের নয়ন।/বীজগণিত ঠিক রাখিও/মন আমার নইলে তোর সকল অকারণ ।/আট আটা চৌষট্রি/ঘরের অংক যাও কষে/পাশ করবি দশটি ক্লাসে/তখন প্রথম ভাগের ভাগ/পাবি তুই বুঝবি অনায়াসে ।/স্বরবর্ণ ব্যঞ্জন বর্ণ নয়রে ভিন্ন/দুই বর্ণ এক যুগে আসে/তুই হলিরে বেয়োগের পড়–য়া/তাই দেখে মহেন্দ্র হাসে।

[এই গানে দেহ উপাদান চৌষট্রি ভাগে দেখানো হয়েছে। বীজ গণিত অর্থ মুর্শিদের নিরিখ। ভূগোল অর্থ সরেজমিন দেহ। স্বরবর্ণ মানে অসীম আর। ব্যঞ্জন বর্ণ অর্থ সসীম]

সুরত আলী বয়াতির গাওয়া মহেন্দ্র নাথ গোস্বামীর একটি ইসলামী গান এরকম। যা তার  অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের পরিচায়ক:

‘নূর নবীজীর তজবী ধরো বলে সকলে/নইলে এ জনম যাবে বিফলে।/পেলে নবীর দেখা/যেত ধোকা রাখিতাম দিলে/করিতাম সঙ্গের সাথী দিবারাতি উঠতো জ্বলে হৃদ কোমলে/সাফায়াত করবেন নদী আখেরে/একথা লিখে দলিলে।

কোন নবী হয় বান্দার হায়াত/কোন নবী উফাত/কোন নবী করবেন সাফায়াত/কোন নবীর নূরেতে পয়দা/এফুল মাকলুফাত/নবীর ভেদ পেলে পরে/এসংসারে জানতাম/নবীর জাত কি সেফাত।/কোন নবীর মজার আছে মদিনায়/যে কথা বলগো নেহাত।’

সুরত আলীর গাওয়া মহেন্দ্র গোস্বামীর আরেকটি ইসলামী লোক ও আধ্যীত বাদ গান এরকমঃ

‘শোন ভাই মুমিন/পাঞ্জেগানা  ৩০মতি/এই কার সঙ্গের সাথী/জ্বলবে তোর নূরের বাতি/নবী হবেন সখা/সেদিন আঁধার ঘর উজ্জল হবে/যাবে রূপ দেখা/শোনার মন বোকা/মহেন্দ্র তাই বলেছে ডেকে/তোর চোখে অঙ্গান চশমা ঢাকা।/যেতে পুলসেরাত পারে/চুলের পুর হিরের ধীরে/সেখানে কে নিস্তারে/ওমন রসনা/আছে ১৯ খানা চুলের পার/দালিলে জানা যেতে পুলসিরাত পারে/তোর চুরি খাটবে না/নবীর উম্মত হলে পরে মন/কোন আর চিন্তা থাকবেনা।’

সুরাত আলীর কাছ থেকে সংগৃহীত ‘একানী’ নামের হিসাবে পরিচিত একটি গান এরকম। এটি একটি লোকজ ফসলী গান: 

‘আমরা ভাতো বাঙ্গালী/নইতো ভাতের কাঙ্গালী/কৃষি কাজে সবাই লাগাও মন ।/আয়ে বিয়ে করে পাশ/বেকার বসে বার মাস/চাকরির জন্য ঘোর কী কারন ।/লাগাও বিআর বারো-এগারো/সময় মত সার  মারো/লক্ষ্য রেখ সদা সর্বক্ষণ ।/মুক্তাগাছি ধানের নাম/আরো লাগাও বিরি বালাম/একর প্রতি ফলন হবে/ সত্তর আশি মন।/বিরি দশ আর বিরি চার/আরো ইরি ছিয়াত্তর/অফিস হইতে লইতে হয় বেছন।/মোদের সরকার ডেকে বলে/কৃষক সবে এসো চলে/কৃষি কাজে আমি দিব লোন ।/কর সবে গমের চাষ /আর খাদ্য শস্য কর উৎপাদন/আখ সবজী আর কলা কচু/আলু মুলা লাগাও কিছু/বৃক্ষদি করতে হবে রোপন।/করতে হবে জন্মরোধ/সময় থাকতে হওগো অপারেশন/মহেন্দ্রনাথ ডেকে বলে/ছোট্ট সংসার গড়াইলে/সুখ শান্তিতে করবে কালযাপন।’

মাগুরার লোক সংগীতের একটি প্রধান অংশ জুড়ে আছে পরম আধ্যত্ববাদ। এরকমই একটি লোকগান হচ্ছে:

‘ও নবীকে এজবাদ করে/যাও ফানা কিল্লার ঘরে/চার কুতুবর চৌদ্দ খান্দান দেখবি নজরে/ফানা ফিন্নার ঘরে যেয়ে/নূর তাজিলার দেখবি চেয়ে/বাকা ফানা কয় যারে।/৩ জাগায় হলে ফানা/আপনে সাঁই রাব্বানা/হিসাব তার লাগবে না/অনায়াসে যাবি জান্নাত মাজারে।’

[এখানে ফানা ফিল্লাহ অর্থ বিলীন হওয়া]

বয়াতী সুরত আলীর বয়স এখন ৬০ উর্দ্ধ। তবু বায়না পেলে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন আসরে তিনি লোক সংগীত ও পালা গানে অংশ নেন এখনো।

মন্তব্য: