সাহান আরা মিশি

ঘুম ভাঙতেই দেখি এক যুবক ঘরে ঢুকে এলো। গায়ে পাঞ্জাবি, পরণে পাজামা। হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো- ঠিক মতো ঘুম হয়েছে? মশারির ভিতর থেকে আমি ভালো করে দেখতেই চমকে উঠলাম! এ কে? আমি শুধাতেই সে বললো- সে অনেক কথা…

পাটখড়ির বেড়া। টিনের চাল। মেঝেতে পাটি বিছানো। সেখানে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে অনেকগুলো বই। কিছু জিনিষপত্রও-। চারচালা ঘরের সাথে লম্বা বারান্দা। পুরোটা ঘেরা…

ঘুমের জড়তা ভাঙতেই উঠে বসলাম। ভাবছিলাম সাধনের ঘরে কি করে এলাম। তেমন ভয় করছিল না। তবে একটু চিন্তিত ছিলাম। সাধন আমার বাল্যবন্ধু। ওর বাবা আমার বাবার বন্ধু। ওর দাদা আমার ভাইজানের বন্ধু। আমার ভাইজান যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। রাজাকাররা মেরে ফেলেছে। খুনিকে খুঁজে পাইনি আজও-। এ কারণেই ওরা আমাদের পরম আত্মীয়। কিন্তু ওর ঘরে কেন আমি? তাও আবার মশারির মধ্যে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। যুবকটি সামনে আসতেই আমি আতঙ্ক বোধ করতে লাগলাম। এ চেহারা তো আমি কখনো দেখিনি। সাধনের মতো লাগছিল মশারির ভেতর থেকে। মশারি খুলতেই ওকে দেখে আমি অবশ হয়ে যাচ্ছিলাম। পীতবর্ণ চেহারা। ক্লিন শেভ। গায়ে সাদা লম্বা পাঞ্জাবি। চোখের দৃষ্টি প্রখর। নিকটে আসতেই আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। নিমেষে মিলিয়ে গেল সব। ওর চেহারায় ভয়ঙ্কর কিছু ছিল…

বর্ষা কাল। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। লোকটি এমনভাবে কথা বলছিল যেন আমার সাথে কত কালের চেনা-জানা। আমি কিছু স্মরণ করতে পারছিলাম না। অবশেষে আমিও চেনা মানুষের মত করে বললাম- তোর বাবা কেমন আছে? ও মুখটা কালো বর্ণ করে ফেললো। মনে হলো- কারও মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু অপমৃত্যু? জিজ্ঞেস করতেই ও আরও স্তব্ধ হয়ে গেল। আমিও আর কিছু বলিনি। 

দরজা খট করে শব্দ হলো। বাইরে কেউ এসেছে। ঘরের মধ্যে আমি একা এবং লোকসহ অবস্থান করছি। অপ্রস্তুত লাগছিল ভেবে যে, কী করে এলাম এখানে! কিছুতেই মনে পড়ছিল না। দরজার খট খট বাড়তে লাগলো। লোকটি ইশারায় পেছন দরজা দেখিয়ে দিল। বেরিয়ে যেতেই দুজন মহিলা আমার মুখোমুখি হলো। ওরা নানান প্রশ্নে আমাকে বিভ্রান্ত করছিল। ওদের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম আমার এ বিষয়টি ওরা জানে। আমি জিজ্ঞেস করতেই ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। কিন্তু কিছুতেই বললো না- এখানে আমি কীভাবে এলাম। ওদের মধ্যে একজন বৃদ্ধা, অন্যজন বিধবা। শতবার প্রশ্ন করা সত্তেও ওরা আমার কথার একটিও উত্তর দেয়নি। হতাশ হলাম, ক্লান্ত হলাম। এক সময় রাগে, অপমানে দুঃখে কাঁদতে লাগলাম। 

দুধারে দূর্বা ঘাস। মাঝখানে সরু সাদা মাটির পথ। পথের দু’ধারে নারিকেল সুপারি গাছ। দক্ষিণে বাড়িটি। ওখানেই কাঁদছিলাম। চেনা হলো না কাউকেই…

হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে তাকিয়ে দেখি আমার ছোট্ট ছেলেটি বলছে- মা কাঁদছো কেন? স্বপ্ন দেখেছো…?

মন্তব্য: