ইব্রাহিম আলী মোনাল

ছয় সদস্যের নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসার হাতেম আলীর। অতি কষ্টে দিনমজুরীর টাকায় সংসার চালাতে হয় তাকে। দুই মেয়ে, দুই ছেলে আর স্ত্রী’র মুখে অন্ন তুলে দিতে পঞ্চাশোর্দ্ধ হাতেম আলীর শরীরের হাড়গুলোয় ঘুন ধরেছে অনেক আগেই। যেদিন কাজ থাকে সেদিন খাবার জোটে। না থাকলে উপোস। আজ দু’দিন হলো কাজে যেতে পারেনি, পুরনো অসুখটাও আবার বেড়েছে। ডাক্তার বলেছিল, এ রোগ সারাতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু অর্থের অভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। আরো অসুস্থ হয় সে। রাতে বিছানায় শুয়ে এসব কথাই ভাবছিল সে। ভাবছিল কিভাবে চলবে তার সংসার। এক সময় তারও ছিল সাজানো-গোছানো ছোট্ট সংসার। গরীব ঘরে জন্ম হলেও অভাব ছিলো না সংসারে। বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য চক্রান্তে পড়ে ভিটেমাটি সব হারিয়েছে সে। মাতŸর রায়হান মুন্সী মিথ্যা মাললায় জড়িয়ে আজ তাকে পথে বসিয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানের দয়ায় একটি সরকারি খাস জমিতে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। বিয়ের পর সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় জনে। অনেক ধার-দেনা করে বড় মেয়ে সখিনার বিয়ে দিয়েছে। সে দেনা আজও শোধ হয়নি। মেজো মেয়ে মর্জিনাও পা রেখেছে বিয়ের বয়সে। ছোট দুই ছেলের এখনও স্কুলে যাবার বয়স হয় নি। রাত পোহালে সন্তানদের মুখে কি খাবার তুলে দেবে ভাবতে ভাবতে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি আরো বেড়ে যায় তার। সে সাথে বাড়তে থাকে দীর্ঘদিনের কাশিটাও। বিছানায় বসে অন্ধকারেই হাতেম আলী বুঝতে পারে গলার মধ্য কেমন যেন হালকা একটা গন্ধ বের হচ্ছে। অতি কষ্টে দ্বিতীয় বারের মত মুখ থেকে কাশি ফেলে হাঁপাতে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রী রাহেলাকে ডাক দেয়। যেন এ ডাকের প্রতিক্ষায় ছিলো রাহেলা। বিছানায় উঠে বসে সে। স্বামীর পিঠে হাত রাখে। বলে, এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। অনেক রাত হইছে। সকালে কাজে না গেলি উপায় নেই। বিয়ানে ছেলে মেয়ে খাতি চালি কি দিবানে। যদি পারো বড় মিয়ার কাছে যেয়ে আগাম কিছু টাকা নিয়ে বাজার করতি পারলি ভাল হত। রাহেলার কথা একটুও মাথায় ঢোকে না হাতেম আলীর। বালিশের তলা থেকে ম্যাচ আর বিড়ি বের করে আগুন জ্বালায় একটা বিড়িতে। তারপর লম্বা একটা টান দিতে না দিতেই আবার শুরু হয় কাশি। রাহেলা স্বামীর বুকে হাত রেখে বলে, এ সুময় বিড়ি না খালি চলতো না? এটা ছাড়তি পারিনে রে বউ। ছাড়তি পারলি তো বাচেই যাতাম। কি করব। আর কি করার আছে আমার। এরে কি বাচে থাকা কয়। এরে কি সংসার করা কয়। কী পালাম। কি দিলাম তোরে। আমার কিছু চাইনে, স্বামীর কথার ছোট উত্তর দেয় রাহেলা। তুমি বাচে আছ, সব আছে। ছেলে মেয়েরা আছে। আমার আর কিছু চাইনে। বিড়িতে আর একটা টান দিয়ে অন্ধকারে ধোয়া ছাড়ে হাতেম আলী। সারা জীবন তুই একই কথা কয়ে গেলি। কিছু চাইনে। বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় হাতেম আলী। আরে সবই যদি আছে, তালি ঘরে খাবার নেই ক্যা। অসুখে পড়ে আছি ওষুধ কিনতি পারিনে ক্যা। জানিস বউ, আমাগের মত গরীবগের কিছু নেই। কিছু থাকতি নেই। আমাগের শুধু নেতাগের মত মুখে বড় বড় কথা আছে। আজ যদি সংসারটা ছোট হত, তালি খরচটা তো কমে যাতো। মুকুল ডাক্তার কত করে কইছে ভাই, সংসারডারে এট্টু ছোট রাখ। আর ছেলেপুলে নিয়ো না। তার কথা না শুনে বছর বছর শুধু ঘরে আউলাদ বনেদ আনিছি। সারাদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে রাতে তোর কাছে বসলি মনটা যেন কেমন হয়ে যাতো। তোর কাছে ঘুমাতি গিলি খালি মনে হত তোর এট্টু আদর করি। আদর ভালবাসা করতি যায়েইতো বছর বছর সংসার বাড়িছে। হাতেম আলীর কথা শুনে হাসতে হাসতে আঁচলে মুখ ঢাকে রাহেলা। বুড় হলে তবু তুমার নুছনুছি গিলনা। নেও, এত রাতি আর আদর সুহাগের কতা কতি হবে নানে। এখন ঘুমায় পড়। আমার খুব ঘুম পাইছে। পরদিন বিয়ানে ঘুম থেকে উঠে হাতেম আলী অসুস্থ শরীর নিয়ে বড় মিযার বাড়িতে যায়। ফজরের নামাজ আদায় করে বারান্দায় বসে পান চিবুচ্ছিল সে। রজব সর্দার নাম হলেও এলাকার সবাই তাকে বড় মিয়া বলে ডাকে। এলাকার ছোট বড় সবাই তাকে এক নামে চেনে, জানে। বড় মিয়া হাতে রাখা ম্যাচ বাক্স থেকে একটি কাঠি বের করে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা পানের কুচি বের করতে করতে সামনে তাকায়। এমন সময় হাতেম আলী বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সালাম দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিয়া একবার হাতেম আলীর দিকে তাকিয়ে, নিজ কাজে মন দেয়। এভাবে কেটে যায় অনেক সময়। দাঁড়িয়ে আছে হাতেম আলী। পূবের আকাশে সূর্যের আবির্ভাব, আস্তে আস্তে সূর্যের প্রখরতা বাড়তে থাকে। কাজে যেতে হবে। দেরি হলে আবার টাকা কেটে রাখবে। বড় মিয়া চেয়ারের হাতলে হাত ঠেকিয়ে হাতেম আলীর দিকে তাকায়। কিরে, কাজে যাবি নে? দাঁড়ায়ে আছিছ ক্যা। কিছু কবি? যা কওয়ার জলদি ক। আমি বাইরে যাব। হাতেম আলী কোন কিছু না ভেবে বড় মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ঘরে খাবার নেই। এক’শ ট্যাহা আগাম দিলি চাল কিনতাম। ক্যান? পাউনা আছে নাকি। ছোট্ট উত্তর মিয়ার। না, কাজে যাওয়ার আগে দিলি বাড়িতি কিছু বাজার করে দিয়ে যাতাম। কাজ সারে আয়, সন্ধ্যায় দেবো। মিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বোতল থেকে একটু সরিষার তেল হাতে ঢেলে নিয়ে কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়ায়। হাতেম আলী তার গমন পথের দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রাস্তায় এসে একটি গাছের নিচে বসে। কি হবে এখন। ছেলে পুলেরা কি খাবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবারও সামনের দিকে পা বাড়ায়। আর কিছু ভাবতে পারছে না। খিদেয় তার পেটও চো চো করছে। কিছুদূর এগিয়ে আবারও রাস্তার মাঝখানে বসে পড়ে সে। শরীরে বল নেই। তবু উঠে দাঁড়ায়। পৃথিবীর সকল বোঝা যেন আজ তার মাথায় ভর করেছে। উদ্ভ্রান্তের মত পথে চলতে থাকে সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবু পথ চলতে হবে। পাঁচ পাঁচটি মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাজ না করলে বাড়ি ফিরতে পারবে না। দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে হাতেম আলী। অতিকষ্টে জমিতে গিয়ে হাত লাগায় কাজে। ক্ষুধার যন্ত্রনা সে ভুলে যেতে চায়। কত সময় যে কাজ করেছে তা সে নিজেই জানে না। শরীরে দুর্বলতা নেই। পেটে ক্ষুধা নেই। সংসারে চিন্তা নেই। কাজ, শুধু কাজ করতে হবে। শরীরের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে হাতেম আলী। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। তবুও কোন দিকেই খেয়াল নেই তার। চোখের সামনে কেবলি ভেসে উঠছে অনাহারি পাঁচ পাঁচিট মুখ। খিদে, খাতি দে। ভাত খাবো। ক্ষুধার্ত কর্মচঞ্চল দু’টি হাত হঠাৎই থেমে যায় যখন দুরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে আযান ধ্বনি। ক্লান্ত শরীর। তবু চলতে হবে। এভাবে মিয়া বাড়ির বারান্দার কোনায় দাঁড়িয়ে হাতেম আলী। ক্ষিণস্বরে ব-ড় মি-য়া। হ আছি, আয়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একশত টাকার একটা নোট বের করে হারিকেনের আলোয় ভাল করে দেখে নেয় মিয়া। বাম হাত বাড়িয়ে টাকাটা এগিয়ে দেয় হাতেম আলীর দিকে। বড় মিয়ার ভারি কণ্ঠশুনে দাঁড়িয়ে যায় সে। এক সের চাল রাখিছি, মাটির পাত্রে রাখা চাল হাতেমের দিকে এগিয়ে ধরে। মুহুর্তে তার হাত থেকে চাল নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় সে। একশত টাকার বাজার দিয়ে ছয় জন মানুষের কি হবে। বাজার থেকে তরকারি কিনে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরে আসে। সন্ধ্যা হলেও এখনো বাড়িতে আলো জ্বলেনি। অন্ধকারে বউকে ডাক দেয়। এদিকে সারাদিন স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠায় থেকে অস্থির মনে বারান্দার এক কোনে বসে ছিলো রাহেলা। স্বামীর কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় সে। কাছে এসে বলে, আইছো। ও মর্জিনা। তোর বাজান আইছে। বাইরি আয়। তোর বাপ আইছে। আরে ও মন্টু সন্টু তুরা কুতায় গেলি। হাতেম আলীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় রাখে রাহেলা। স্ত্রীর হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে কোন কথা না বলে সোজা বারান্দায় পাটির উপর শরীরটা এলিয়ে দেয় হাতেম আলী। শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় ঝাপটা তাকে মূহূর্তেই নিয়ে যায় দুঃখহীন কোন রাজ্যে। বাজারগুলো নিয়ে চুলোর কাছে যায় রাহেলা। রাত গড়িয়ে আবার সকাল হয়। রাহেলার ডাকা ডাকিতে চোখ মেলে তাকালেও শরীর নড়াতে পারছেনা হাতেম আলী। মুখে কিছু না বললেও ভেতর থেকে সে উঠে বসতে চাইছে। গোটা শরীর যেন তার মাটি আকড়েঁ আছে। স্বামীর কপালে হাত রাখতেই অনুভব করে তার গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কষ্টে চোখ ভিজে আসে রাহেলার। নিমেষেই বুকের স্পন্দন যেন থেমে যেতে চায়। অশুভ কামনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাকে মর্জিনাকে। তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আয়। তোর বাজানের খুব জ্বর আইছে। মাথায় পানি দিতি হবি। কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাকায় হাতেম আলী। কোন কিছু না বলে উঠে বসে। কি করো, কি করো, তোমার শরীর খারাপ। শুয়ে থাকো। হাতেম আলীকে ধরে পাটিতে শুইয়ে দেয়। বাবার পাশেই ছিল মর্জিনা। তুমি শুয়ে থাকো বাজান। যা হয় তাই হবে। নারে মা, আমার কি শুয়ে থাকলি চলবি। ঘরে বসে থাকলি খাতি দিবি কিডা। আমার কিছু হবি নানে। বউ, কিছু খাতি দে। কিছু না বলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় রাহেলা। পানির মগ এগিয়ে দিতে দিতে বলে, আজ কাজে না গিলি হতোনা। তালি খাবো কি। ঘরে বসে থাকলি খাওয়া এমনি এমনিই চলে আসপি। স্বামীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে রাহেলা। গতদিনের ধকল এখনও সামলাতে পারেনি সে। দু’চারবার খাবার মুখে দিয়ে উঠে পড়ে সে। বিড়ি ম্যাচ কই। মর্জিনা, বিড়ি-ম্যাচ দে। কোন কথা না বলে একবার মেয়ে ও বউয়ের দিকে তাকিয়ে সোজা বাইরের দিকে পা বাড়ায়। রাস্তা ধরে মাঠের দিকে যাচ্ছিল সে। এমন সময় দেখা হয় জয়নাল শেখের সাথে। হাতেম আলী তাকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশকাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। পথ আগলে দাঁড়ায় জয়নাল শেখ। কনে যাচ্ছো ভাই। মিয়ার ক্ষেতে ধানের চারা লাগাতি হবি। আবার কথা বলে জয়নাল শেখ। আরে ভাই এত তাড়া কিসের। সারাদিন মাঠে পড়ে থাহো। দেহা হয় না। মন খুলে দুডে কতা হয় না অনেক দিন। তাছাড়া সারাদিন মাঠে পড়ে থাকলি তো হবি নে ভাই। বাড়ির খোঁজ খবর কিছু রাহো। বাড়ির কি খোঁজ রাখপো। সব ঠিক আছে। আমি যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে। জয়নাল শেখ খোঁচা দেয়ার জন্যই পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথম খোঁচা মেরে সফল হওয়ায় দ্বিতীয় বার সুযোগ নেয় সে। শয়তানি হাসি মুখে রেখে খোঁচা খোঁচা দাড়ির ভাজে পাঁচটি আঙ্গুল এনে বলে, তুমি গরীব মানুষ বাপু, সারাদিন পরের জমিতে জোন দেও। এদিকে মেয়ে যে সেয়ানা হইছে। পাড়ার ছেলে পুলেরা তার পিছে ঘুরঘুর করে। মেয়ের হাবভাব কিন্তু মোটেই ভাল লাগতিছেনা, কাল বিকেলেও দেখলাম রমজান বিশ্বাসের ছেলে রাজুর সাথে…. কি করিছে তা আমি দেহিনি। সত্যি কচ্ছি আমি দেহিনি। যাই বলো। সেয়ানা মেয়ে। ভুল করে যদি কিছু করে ফেলে, তালি গিরামে মুখ দেখাবা কেমন করে। শুধু কাল না, প্রায়ই আমার চোখে পড়ে তারা একসাথে ঐ বাগানের দিকে যায়। এখানে ওখানে দাঁড়ায়ে কথা কয়। ওগের রকম সকম আমার কিন্তু মোটেই ভাল ঠেকতিছে না। যত তাড়াতাড়ি পারো বিয়ে দিয়ে দেও। আমি যাই। তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে হাতেম আলী খোলা আকাশের দিকে তাকায়। কী কথা শুনায় গিলো জয়নাল শেখ। বখাটে ছেলের সাথে মিশে যদি কিছু একটা হয়ে যায় তালি গিরামে থাকা দায় হবে। সকালের সূর্যটা এখনও মাথার উপর আসেনি। গোসল সেরে রাহেলা ভেজা শাড়িটা রোদে দিয়ে বারান্দায় এসে বসে। একটু দুরে বসে কি যেন চিন্তা করছিল মর্জিনা। মেয়ের দিকে না তাকিয়ে ছেঁড়া গামছা দিয়ে ভিজে চুল মুছতে মুছতে রাহেলা বলে, সেই তখন থেকে দেখতিছি কি যেন চিন্তা করতিছিস। যা, বেলা অনেক হইছে গোছল করে আয়। আনমনা হয়ে তাকিয়ে ছিল মর্জিনা। মায়ের কোন কথায় তার কানে প্রবেশ করেনি। এবার রাহেলা বিরক্ত হয়েই মর্জিনার দিকে তাকায়, কানে কিছু ঢুকতিছে তোর? আমি এতো করে কচ্ছি কথা কানে যাচ্ছে না? আমার ভাল লাগতিছে না উত্তর দেয় মর্জিনা। এভাবে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে সে। গত কয়েকদিন হল তার বমি হচ্ছে। একথা সে কাউকে বলতে পারছে না। রাজুর কাছে নিজের শরীর সপে দিয়ে আজ তার এ অবস্থা। মর্জিনার পেটে নড়াচড়া করছে রাজুর ভালবাসার ফসল। এখন কি করবে সে, কোথায় যাবে। কাকে জানাবে এ কথা। এদিকে দিন দিন মর্জিনার শরীরে বেশ পরিবর্তন হচ্ছে। সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে মন চায়। কোনই কাজ করতে ভাললাগেনা। বাবার কথা ভেবে আরও ভেঙ্গে পড়ে মর্জিনা। আবারও বমি আসে তার। মর্জিনার এমন অবস্থা দেখে প্রথমে কিছু না ভাবলেও একসময় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে রাহেলার মাথায়। দ্রæত মেয়ের কাছে যায়। এই হারামজাদী কনে কি করিছিস। এমনি করে বমি করতিছিস ক্যা। তোর কি হইছে। এই পোড়ামুখি তুই কতা কচ্ছিসনে ক্যা। কি হইছে আমারে ক? সোজা উত্তর দেয় মর্জিনা কিছুই হইনি মা? এমনি পেটের মদ্যি ব্যথা করে বমি চলে আইছে। মর্জিনার চোখে মুখে কেমন যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করে রাহেলা। বারান্দার খুঁটি ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। গোছল করে আসি। দিনের সূর্য ওঠা আকাশটা হাঠাৎই যেন কালো মেঘে ছেয়ে যায়। কোন রকমে গোছল সেরে বাড়ি আসে। মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রাহেলা। ভাতের প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে একবার মর্জিনার দিকে তাকায়। কিডা তোর এ সব্বনাস করিছে। কতদিন ধরে চলতিছে এ কাজ। চুপ করে থায়িছসে। কার সাথে এ জঞ্জাল বাদালী। তোর বাপেরে আমি কি জবাব দেব। পাড়ায় মুখ দেখাব কেমন করে। কথা ক পুড়ামুখী, মুখ বুজে থাকিসনে। এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁপাতে থাকে রাহেলা। মর্জিনা মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে, আমি এখন কি করব মা? আমার যে সব শেষ হয়ে গেছে। আমি যে মা হতি চলতিছি। রমজান চাচার ছেলে রাজুর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেউ। আর তা না হলি আমারে গলাটিপে মারে ফেলো। মরা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। রাজু কইছে আমারে বিয়ে করবি। এমন সময় বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে হাতেম আলী। বারান্দায় মা ও মেয়ের বসা দেখে সেও পাশে গিয়ে বসে। কি হইছে? মুখ কালা করে বসে রইছিস ক্যা। বড্ড খিদে লাগিছে। কিছু থাকলি দে। মাঠে যাতি হবি। আজ কাজটা শেষ করতি না পারলি মিয়া ট্যাহা দিবিনানে। হাতেম আলীর কথা শেষ না হতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রাহেলা। ও মর্জিনার বাপ। আমার মর্জিনার সর্বনাশ হইছে। এখন ওর কি হবি। হঠাৎ করে রাহেলার এমন কান্না দেখে চমকে ওঠে সে। কি ব্যপার, কি হইছে তোগের। কানতিছিস ক্যা, কি হইছে? আমারে খুলে ক। আমিতো তোগের কতা কিছু বুজতিছিনে। রাহেলার মুখে কথাগুলো শোনার পর হাতেম আলী যেন পাথরের মুর্তি বনে যায়। এতক্ষণে মনে পড়ে রায়হান শেখের কথা। তালিতো রায়হান শেখ ঠিকই কইছে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। বউ ও বউ, আমার হাতে বটিটা দেতো, এমন মেয়ের জীবন আমি শেষ করে দেই। দ্রæত মর্জিনার কাছে গিয়ে এলাপাথাড়ী চর মারতে থাকে। তুই মরে যা, তোর মরে যাওয়াই ভাল। শয়তানী এই ছিল তোর মনে। তুই, ক্যান আমারে এতো বিপদে ফেললি। গলায় দড়ি দিয়ে মরলিনে ক্যা। তালি আমার এ জ্বালা সহ্য করতি হতো না। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার মাথায়। রাহেলা বলে, তুমার মাথা এতটু ঠান্ডা কর। মিয়ার কাছে যায়ে সব কতা খুলে কও। সে আমাগের একটা না একটা ব্যবস্থা করবেই। ও মর্জিনার বাপ, মাথা ঠান্ডা করে যা হয় কিছু কর। বড় মিয়ারে জানাও। রাহেলার কথা শুনে কোন কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায় হাতেম আলী। পাটির উপর রাখা গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে দ্রæত মিয়ার বাড়ীর দিকে পা বাড়ায়। বারান্দায় বসেই পান চিবচ্ছিল মিয়া। হাতেম আলী হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে মিয়ার সামনে দাঁড়ায় এবং সব কথা খুলে বলে। কথা শোনার পর কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকে মিয়া। অন্য সময় সে এত পান খায়না। কিন্তু আজ ঘটনাটি শুনার পর প্রায় দশ মিনিটের ব্যবধানে পাঁচ থেকে সাতটি পান চিবিয়েছে। সর্বশেষ আরও একটি পান মুখে তুলে হাতেম আলীর দিকে তাকিয়ে বলে এর একটা বিহিত করতেই হবে। আর সেটা আজই। তুই এলাকার সবাইরো সন্ধ্যায় আমার কাচারি ঘরে আসার কথা কয়ে আয়। হাতেম আলী কোন কথা না বলে বেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যায় মিয়ার কাচারি ঘরে একে একে গ্রামের সব বয়সি লোকজনের ভীড় জমে। চৌকির উপর বসে আছে মিয়াসহ গ্রামের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা। পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে হাতেম আলী। তারই একটু দুরে রাজু ও তার বাবা বসে আছে। কাচারী ঘরের বাইরে গ্রামের কিছু নারী-পুরুষ, আর মর্জিনাকে নিয়ে বসে আছে তার মা। সবাই মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মিয়া রমজানের দিকে তাকিয়ে বলে সবইতো শুনিছ তুমি। এবার কি করবো, তুমিই কও। রাজুর বাবা এতক্ষণ কোন কথায় বলেনি। সে রাজুর কানে মুখ লাগিয়ে আস্তে আস্তে বলে, শয়তানের বাচ্চা শয়তান, যা করিছিস তার কোন ক্ষমা হয়না। এর থেকে বাচতি হলি মর্জিনারে তোর বিয়ে করতি হবি। বড় মিয়া যদি থানা পুলিশে খবর দেয় তালি সারা জীবন জেলের ভাত খাতি হবি। দুনিয়ার আলো বাতাস আর দেখতি পারবিনে। এবার রমজান উঠে দাঁড়ায়। মিয়ার দিকে জোড় হাত করে বলে আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আমার ছেলেরে থানা পুলিশি পাঠায়েন না। আপনি যে শালিস বিচার করবেন, আমরা তাই মানে নেব। আমার ছেলে যে এমন একটা কাজ করবি আমি বুঝতি পারিনি। এই হারামজাদা উঠে দাঁড়া। যা মিয়ার কাছে ক্ষমা চা। তারপর উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে মিয়া বলে, তোমরা সবইতো শুনলে, আমাগের চোখের সামনে দু’ডে জীবন নষ্ট হয়ে যাক ইডা আমরা চাইনে। তাছাড়া হাতেম আলী জন দিয়ে খায়। তার মায়েডার যদি এমন অবস্থা হয় তালি সে কনে যাবি। তাই আমি কচ্ছি, ওগের বিয়ে দিয়ে দেও। উরা ছেলে মানুষ, ভুল করে একটা অন্যায় করে ফেলিছে। ওরা যেন মিলেমিশে থাকতি পারে আমাগের সেইডেই করা উচিত। কি কউ তুমরা। উপস্থিত সবাই হাততুলে মিয়ার এ কথার সমর্থন জানায়। তোমরা সবাই যদি চাও তালি ওগের বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়। এবার রাজুর বাপ তুমি কও তোমার কি মত তুমার। উঠে দাঁড়িয়ে রমজান বলে, আমার আর কি কওয়ার আছে। গিরামের সবাই যহন আমার মনেরই কথা কচ্ছে এতে আমার আর আপুত্তি থাকার কথা না। এবার রাজু উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড়করে বলে, আমি ভুল করিছি, আমারে আপনারা ক্ষমা করে দেন। আপনারা যা করবেন তাই মানে নেব। এই শালিসের মদ্যি কচ্ছি মর্জিনারে আমি বিয়ে করবো। এবার মিয়া মসজিদের ইমাম আতিয়ার রহমানকে বলেন, ইমাম সাহেব আপনি কই। এতক্ষণ সবইতো শুনলেন, এবার ওগের বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন? এখন, এখানেই ওগের বিয়ে হবি। বড়মিয়ার এমন কথা শুনে উপস্থিত সবার মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। কাছারী ঘরের পাশে বসেছিল মর্জিনা। অন্ধকারে সে শুধু একবার মায়ের দিকে তাকায়। মনের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। সেটা কষ্টের না আনন্দের, নাকি অনাগত সন্তানের পৃথিবিতে আশার স্বীকৃতি কোনটাই সে বুঝতে পারে না। বড় মিয়া ও গ্রামবাসীর এমন সিদ্ধান্তে চোখের পানি মুখে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নীরবে শুকরিয়া আদায় করে রাহেলা। এদিকে হাতেম আলী দাঁড়িয়ে বড় মিয়ার পায়ে হাত রাখতেই তিনি তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। যাও, বাড়ী নিয়ে যাও ওগের। রাজু হাতেম আলীর কাছে এসে বলে, চাচা আমারে ক্ষমা করেন। আমি ভুল করিছি। রাজুর কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে হাতেম আলী।

মন্তব্য: