বাংলাদেশের পাল পরিচয়

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

বিপুল কুমার রায়

মৃতশিল্পের পৃথিবী জয়

পৃথিবীজুড়ে রয়েছে মৃতশিল্পের ঐতিহ্য। প্রায় সকল সভ্যতাই মৃতশিল্পের সূচনা করেছে। যতদূর জানা যায় প্রাচীন মৃৎশিল্পের শুরু হয় খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০০০ অব্দে। পুরাতন প্রস্তর ও নবপ্রস্তর যুগে প্রচুর পরিমান মৃৎশিল্পসামগ্রী উৎপাদিত হয়। প্রায় ৬০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ান সভ্যতায় মাটির পণ্য তৈরি হতো। সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো ও হরোপ্পার হাত ধরেই উপমহাদেশে মৎশিল্পের বিস্তৃতি ঘটে।

বাংলায় পাল

বাংলাদেশে যারা মৃৎশিল্পের ধারক-বাহক এবং বংশ পরম্পরায় মাটির কাজ করে আসছে তারা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ‘পাল’ সম্প্রদায় হিসেবে সমধিক পরিচিত। ‘পাল’ শব্দটির একাধিক অভিধানিক অর্থ রয়েছে। ‘পাল’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘পালা’ থেকে এসেছে যার অর্থ পালক বা রক্ষক। (তন্মধ্যে বাংলার মৃৎশিল্পিদের ‘পাল’ উপাধি ধারণ অর্থে) বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধান অনুসারে- পালনকর্তা, প্রতিপালক, রক্ষক বা দলের পাণ্ডা বা সর্দার বলা যায়। তাছাড়া ‘পাল’ শব্দটির আরো কতকগুলি অর্থ আছে- যেমন রাজ্যপাল, চাঁদোয়া, নৌকার পাল, গবাদিপশু প্রজনন এবং ‘পালই’ শব্দটি দ্বারা খড়ের গাদা, পালা বা স্তুপ বুঝায়।

কীভাবে জাতি গঠিত হলো

প্রাচীনযুগে বাংলার শিল্পীদের সংঘবদ্ধ জীবনের কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপিতে উক্ত হয়েছে- বনিক শূলপাণি, “বারেন্দ্র শিল্পিগোষ্ঠী চূড়ামণি’ ছিলেন। এইরূপ সংঘবদ্ধ শিল্পিজীবনের ফলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পিগোষ্ঠী ক্রমশ বিভিন্ন বিশিষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছে, যেমন তন্তুরায়, স্বর্ণকার, কর্মকার, কুম্ভকার(পাল) ইত্যাদি। কালক্রমে এরা সমাজে এক একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকারপূর্বক বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বাংলার এই সকল জাতি বিভাগ হতে তৎকালে বিভিন্ন শিল্পবৃত্তি ও ব্যবসায়ের প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব বাংলাদেশের এই পাল সম্প্রদায় সম্ভবত পাল বা দলগতভাবে বসবাস অথবা পরস্পর শিল্পগত সংঘবদ্ধতা হেতুই পাল উপাধিপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ ‘পাল’ শব্দটি দল বা সমষ্টি অর্থও প্রকাশ করে। 

মৃৎশিল্পীদের আচরণ ও কর্মগত বৈশিষ্টের সাথে ‘পাল’ শব্দটির আভিধানিক অর্থের বড় একটা সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে যেহেতু পাল সম্প্রদায় দলগতভাবে গুচ্ছাকারে বসবাস করে, তাই ‘পাল’ শব্দটির সাথে সম্প্রদায়গত মিল দেখা যায়। আবার ‘পালই’ শব্দের অর্থের সাথেও তাদের হাড়ি পোড়ারবার চুল্লীর কাজে ব্যবহার্য্য পলের গাঁদার বিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যাহোক, এই বাংলায় মৃৎশিল্পীরা প্রাচীন কাল থেকেই ‘পাল’ পদবী দ্বারাই পরিচিত। যে কারণে বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীগ্রামই হোক আর শহর বা নগরই হোক- সর্বত্রই দেখা যায় পালপাড়া, পালবাড়ী ইত্যাদি। নদীমাতৃক প্রাচীন সভ্যতার এই বাংলায় নদীর তীর বা বৃহৎ খালের পাড়ে পাল আদ্যাক্ষরযুক্ত অজস্র নামের পল্লীকুঞ্জ খুঁজে পাওয়া যায়। 

দু’জন বিশিষ্ট পাল

প্রাচীন বাংলার মৃৎশিল্পীদের বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে সপ্তম বা অষ্টম শতকে দুজন মৃৎশিল্পীর নাম জানা যায়। একজন হচ্ছেন ধীমান পাল এবং অপরজন হচ্ছেন তাঁর পুত্র বিটুপাল। উভয়েই ধাতব মুর্তিশিল্পে বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। অবশ্য তাঁরা মৃৎশিল্পী সম্প্রদায়ের লোকই ছিলেন। 

মন্দির গায়ে মাটির ফলক

বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতি বিহারে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক দেখতে পাওয়া যায়। সৃদৃশ্য মাটির ফলক দিয়ে মন্দিরগাত্র সাজিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিল মৃৎশিল্পীদেরই। কারণ বাংলাদেশে পাথরের প্রাচুর্য ছিল না, যা দিয়ে শিল্পীগণ মন্দির সাজাবেন। তাছাড়াও এই বাংলায় পাথরের মূল্য ও আনয়ন খরচ ছিল বেশি। মৃৎশিল্পী পালগন সে যুগের নীচুতলার লোকশিল্পীই ছিলেন। 

মাটির ঐ সমস্ত ফলকে সেকালের লোকায়ত কৃষিজীবনেরই সুস্পষ্ট ছাপ পড়েছে। মন্দিরগায়ে দেখা যায় গ্রামের কাদামাটিমখা অনাড়ম্বর সহজ-সরল মানুষের বিচিত্র জীবনের মিছিল। গ্রামীণ পাল বা কুমোর শিল্পীগণ স্বল্প সময়ে ছাঁচে ঢেলে অথবা আঙ্গুলে টিপে টিপে অপেক্ষাকৃত অনায়সলব্ধভাবে ক্ষুদ্র বৃহৎ মাটির ফলক তৈরিপূর্বক সাজিয়ে দিত মন্দিরগাত্র। খ্রীষ্টীয় শতকের প্রারম্ভ থেকে প্রায় অষ্টম-নবম শতক পর্যন্ত প্রস্তুতকৃত প্রচুর সংখ্যক মাটির ফলক বাংলার নানা প্রত্নস্থান থেকে পাওয়া যায়। এই সব পোড়ামাটির ফলকগুলো দৈনন্দিন জীবনের চলমান প্রবাহের লোকায়ত কথা ও কাহিনীর স্থায়ী জীবনরূপ। 

কুমার/পাল পদবী কীভাবে এলো

সংস্কৃত শব্দ ‘কুম্ভ’ থেকে কুম্ভকার শব্দটি এসেছে। কুম্ভ বা বাংলা প্রতিশব্দ ‘কলস’ নির্মাতাদেরকে কুম্ভকার বলা হয়। দ্রাবিড় ভাষাতেও কুম্ভ বা ভান্ড বলা হয়। এই সংস্কৃত শব্দ কুম্ভকার থেকে হিন্দিতে ‘কুমহার’ শব্দটি এসেছে। এই ‘কুমহার’ থেকেই বাংলায় কুমোর বা কুমার বলে কথিত হয়। তাই পালবাড়িকে গ্রাম বাংলায় কেউ কেউ কুমোরবাড়িও বলে থাকে। সমগ্র ভারতর্বষ, পাকিস্তানেও এই মৃৎশিল্পীগনের ‘কুমহার’ বলে কথিত হয়। ভারত ও পাকিস্তানে অনেক মৃৎশিল্পীদের কুম্ভকার পদবীতে দেখা যায়। বাংলাদেশে পাল বা কুমার শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘কুম্ভকার’ থেকে এসেছে। যার অর্থ মাটি পাত্র নির্মাতা। দ্রাবিড় শব্দেও মোটামুটিভাবে অনুরূপ অর্থ প্রকাশ করে। শব্দের উৎপত্তিগত প্রবাহটি নিম্নরূপ-

সংস্কৃতে কুম্ভকার- হিন্দিতে কুমহার- বাংলায় কুমার বা বিবর্তিত হয়ে ‘পাল’ শব্দটি এসেছে। 

পাল পৌরাণিক উৎপত্তি

ভারতর্বষীয় পুরাণের আলোকে সকল মানুষই ‘মুন’ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টিকালে চৌদ্দজন মনু থেকে সমগ্র মানবকুল এসেছে। তবে কুমারদের একটি শাখা অত্যন্ত আত্মসম্মানের সাথে বিশ্বাস করে যে, বেদান্তের আলোকে ব্রহ্মাপুত্র ঋষি প্রজাপতি যিনি এই বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টি করেছেন, কুমার বা পালগণ তাঁরই সন্তান। পৌরাণিক সৃষ্টি সম্পর্কে কুমার বা পালদের মধ্যে একটি মিথ প্রচলিত আছে- 

একদা স্বয়ং ব্রহ্মা একখানি আখ তাঁর সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। প্রত্যেক সন্তানই তার অংশ সমানভাবে পেল। কিন্তু কুমার বা পালগণ তাদের মাটির কাজে এতটাই মগ্ন ছিল যে সেই আখের প্রাপ্য অংশটুকু খাবার কথা তারা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। ফলে আখের কর্তিত অংশটুকু কাদার পাশে যেখানে তারা রেখে দিয়েছিল, সেখানেই আখখানি শিকড় ও কিশলয় গজিয়ে উঠলো এবং কিছুদিন পরে একখানি পূর্ণাঙ্গ আখগাছে পরিনত হলো। একদিন এল, যখন ব্রহ্মা কেন যেন তাঁর সন্তানদের নিকট আখখানি চাইলেন। কিন্তু ব্রহ্মাপুত্রগণ কেউই আখখানি ফিরিয়ে দিতে পারলো না শুধুমাত্র কুমার ব্যতিত। কুমার তার পিতা ব্রহ্মাকে একখানি পূর্ণাঙ্গ আখ উপহার দিলেন। ব্রহ্মা ভীষণভাবে প্রীত হয়ে পাল বা কুমারদের প্রজাপতি নামে সম্বোধিত করলেন। 

প্রজাপতি কে

হিন্দুপুরাণ অনুসারে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরে ব্রহ্মা চার কুমার সৃষ্টি করেন। কিন্তু ঐ চার কুমার ব্রহ্মাকে তাদের পিতৃত্বে বরণ না করে তার বিষ্ণুর প্রতি তাদের আনুগত্য স্বীকার করেন। অতঃপর ব্রহ্মা তার মন থেকে দশটি পুত্র বা প্রজাপতি সৃষ্টি করেন, যাদেরকে মানবজাতির পিতা বলে বিশ্বাস করা হয়। যেহেতু ঐ সকল পুত্র তাঁর ঔরসজাত নয়, বরং মন থেকে সৃষ্টি, তাই প্রজাপতিগণকে ব্রহ্মার মানসপুত্র নামে অভিধা দেয়া হয়। 

বৃহদ্ধর্মপুরাণে পাল

বৃহদ্ধর্মপুরাণ একটি উপপুরাণ। এই পুরাণটি আনুমানিক খ্রীস্টিয় ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি বিজয়ের অব্যবহিত পরেই রাঢ় দেশে রচিত হয়। গ্রন্থটিতে ব্রাহ্মন বর্ণ ব্যতিরেকে সমসাময়িক বাংলাদেশের ৩৬টি জাতির বিভক্তির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। ব্রাহ্মনেতর এই ৩৬টি জাতিকেই শূদ্র জাতিরূপে বিভক্ত করা হয়। 

বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বর্ণিত আছে যে, রাজা বেন আর্স্ব প্রবর্তিত বর্ণাশ্রম ধর্ম নষ্ট করবার অভিপ্রায় বলপূর্বক বিভিন্ন বর্ণের নরনারীর সংযোগ সাধন করেন। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন মিশ্র বর্ণের উৎপত্তি হয়। এই মিশ্র বর্ণগুলি যতদূর জানা যায় সবই প্রায় শূদ্রজাতীয়। এই বর্ণগুলিকে উত্তম, মধ্যম ও অধম এই তিন সংকর শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। মৃৎশিল্পী কুমার বা পালগণ উত্তম সংকর শ্রেণিভূক্ত। ব্রহ্মবৈবত ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণে, এরা উত্তম শিল্পীজাতি হিসেবে বর্ণিত। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে যে, যাদের পিতামাতা উভয়ই ছতুর্বর্ণভূক্ত তারা উত্তম সংকর হিসেবে বিবেচিত। 

নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি

নৃতাত্ত্বিকভাবে যতদূর অনুমান করা যায় কুমার বা পালগণ দক্ষিণ এশিয়ার আদিম জনগোষ্ঠিী যাদেরকে আদি-অস্ট্রেলীয়’ বা অস্ট্রিক (Austro-Asiatic) বলা হতো। নৃতাত্ত্বিকগণ এখন অবশ্য এদেরকে ‘ভেড্ডিড’ (Vedid or Veddoid) নামে অভিহিত করেন। বাঙ্গালী জাতির প্রায় সকল স্তরেই ভেড্ডিড জনগোষ্ঠির রক্ত মিশে আছে। প্রাক-আর্থ দ্রাবিড় ও ভেড্ডাপ্রতিম মানুষেরা মূলত: একই রক্তধারার। শত শত বছরের আবহাওয়া, পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে তাদের চেহারা একটুখানি বদলে গেছে। তবে সামগ্রিভাবে তাদের প্রায় একইরকম চেহারা দাড়িয়েছে। বাংলাদেশে মৃৎশিল্পী পালদের সংখ্যা জরিপ অনুসারে সাড়ে পাঁচ লক্ষ থেকে ছয় লক্ষ। সনাতন হিন্দু সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই বিবাহ, পূজা অর্চনা এবং নানাবিধ শ্রাদ্ধাদি কার্যে গোত্র পরিচয় প্রয়োজন হয়। এই গোত্র পরিচয়টি অলিখিতভাবে মানুষের মুখে মুখে স্মরণাতীতকাল থেকে চলে আসছে।

গোত্রগত দুটি থাক আছে (আলিমন, কাশ্যপ)

গোত্রগত দিক থেকে পালদের মধ্যে দু’টি থাক রয়েছে। গোত্র দু’টি যথাক্রমে কাশ্যপ ও আলিমন গোত্র। কাশ্যপ ও আলিমন দু’জনই প্রাচীন ঋষি। কাশ্যপ হলেন প্রাচীন মুনি যিনি সপ্ত ঋষির অন্যতম।

পাল প্রাকৃতজন মাটির গন্ধে কাকডাকা ভোরে জেগে ওঠে আবার মাটির গন্ধে ঘুমিয়ে পড়ে। মাটির মানুষ পাল নরনারীগণ মাটির কাদা গায়ে মেখে চাকা ঘুরিয়ে দিনভর নানা প্রকার মাটির পাত্র তৈরি করে। গ্রাম বাংলার প্রান্তিক ব্রাত্যজন যারা চাষাবাদ ও নানা কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকে; পালগণ সেই সকল চাষিভূষাদের নিত্য প্রয়োজনীয় নানাবিধ মাটির পাত্র তৈরি করে। শুধু তাই নয়, নগরসভ্যতারও অজস্র মানুষের ব্যবহার্য নানাবিধ মাটির পাত্র তৈরিপূর্বক সরবরাহ করে।

মানবসভ্যতার বিনির্মাণে মৃৎশিল্পী পালগণের ভূমিকা অপরিসীম। সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ আগুন আবিষ্কারের অব্যবহিত পরেই যখন রান্না করতে শেখে, ঠিক তখন থেকেই এই মাটির পাত্রের ব্যবহার শুরু হয়। গৃহ নির্মাণ শিল্পে গৃহ আচ্ছাদনের টালী আবিষ্কার এক অপূর্ব নান্দনিকতার পরিচয় প্রকাশ করে ঘরবাড়ির তথা বড় বড় ভবনের টালিনির্মিত ছাদ ভবনগুলোর এক অপূর্ব শোভা বর্ধন করে। 

মূর্তি তৈরি শিল্পে মৃৎশিল্পীগণের জুড়ি নেই। এই বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বনের প্রচলন আছে। এই সকল পূজা অর্চনায় নানবিধ দেব-দেবী প্রতিমা নির্মাণপূর্বক পূজারীদের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, গ্রামের কুমোরের গড়া নানারকম মাটির পুতুল ও খেলনা বাংলার শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনের এক অনবদ্য অনিন্দসুন্দর সৃষ্টি। এই সমস্ত শিল্পরূপ কালজয়ী, কালাতীত। কালপ্রবাহকে অতিক্রম করে এগুলো আজও জনমানুষের মাঝে বেঁচে আছে। সেই প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার যুগে সিন্ধু নদের তীরে বসে সমসাময়িক মৃৎশিল্পিগণ যে পুতুল তৈরি করতো, বাংলার গ্রামে গ্রামে আজও বাঙ্গালী কুমোর তথা বাঙ্গালী নারী নানা ব্রতে তাই-ই করে। গ্রাম্য মেলায় মৃৎশিল্পী পালগণ মাটির পুতুল ছাড়াও নানা নিত্য ব্যবহার্য মাটির পণ্যের পসরা নিয়ে বসে। এই সমস্ত পুতুল ও খেলনা শিশু-কিশোরদের আনন্দ দান তথা নর-নারীর শিল্প সৌন্দর্যের পিয়াস মিটিয়ে থাকে। দিনান্তে প্রতি সন্ধ্যায় বাংলার নারী তুলসীতলায় যে মাটির প্রদীপের আলোয় অন্তরাকাশ আলোকিত করে ভক্তিভরে পরম প্রভূর স্মরণে যে প্রণামটি দেয় সেই মাটির প্রদীপটি এই গ্রাম্য অনামী কোন এক কুমোরের আবিষ্কার। যে কোন মাঙ্গলিক আয়োজনের শুভ সূচনা এই মাটির প্রদীপ জ্বেলেই শুরু হয়।

মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবন, প্রতিদিনের অশন-বসন, বিলাস-ব্যসন, চলন-বলন, আমোদ-উৎসব, খেলাধুলা প্রভৃতি যে মনন ও কল্পনা, অজ্ঞান ও সংস্কারকে ব্যক্ত করে এগুলোই মানুষের মানসসংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।

কুমোর বা পালদের মানসসংস্কৃতিও তাদের চলন-বলন, চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, মনন ও কল্পনা, দৈনন্দিন অভ্যাস ও আচরণের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায়। পালগণ প্রাকৃতজন প্রদোষে প্রকৃতিগতভাবেই জেগে ওঠে। এরা মাটিকাদা মাখা মাটির মানুষ মাটি দিয়েই জীবনসংগ্রামে ব্রতী। 

পালদের মন-মানসিকতায় অস্ট্রিক ভাষা-ভাষী আদি অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড়ভাষী এই দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের মনের ছোঁয়া দেখা যায়। এরা কিছুটা সহজ-সরল প্রকৃতির। তবে এরা শিল্পীজাতি হিসাবে এদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা, শিল্পনিপুণতা, আতিথেয়তা, ধর্মপরায়নতা, কর্মতৎপরতা ও উদ্যমশীলতা পরিলক্ষিত হয়। পালগণ বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠান, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও পূজা পার্বণপ্রবণও বটে। এরা কিছুটা কল্পনাপ্রবণ, কতকটা রহস্যসম্পন্ন ও কতকটা ভক্তিময়তাসম্পন্ন। এরা বেশিরভাগই অত্যন্ত পরিশ্রমী, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন এবং এদের মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তি, নিষ্ঠুরতা বা ক্রুরতা নেই বললেই চলে। এদের ধর্মীয় পরিবর্তনও তেমন ঘটেছে বলে মনে হয় না। তবে অল্প-বিস্তর চতুরতা, হিংসাবৃত্তি এবং কিছু মানবিক দুর্বলতা যে এদের মধ্যে নেই, তা বলা চলে না। সর্বোপরি এরা আপনভোলা, আপন কাজে মগ্ন।

মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে শিল্পবিপ্লব হেতু লোকায়ত মৃৎশিল্পের ¤্রয়িমানতা পরিলক্ষিত হয়। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য নানাপ্রকার ধাতব সিরামিক ও প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রী মৃৎশিল্পের বিকল্প হিসাবে ব্যবহারের ফলে পালগণ তাদের অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তবে পালগণ তাদের পিতৃপুরুষের পেশা মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার মানসে দেশীয় তথা আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুসারে গৃহনির্মাণ পণ্যসহ নানারকম উন্নততর মাটির পণ্য উৎপাদন করছে। আবার এটাও দেখা যায় বিশ্বায়নের ফলে অনেক শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত পালগণ তাদের পৈত্রিক পেশা পরিত্যাগ করে অন্য পেশায় গমন করছে। যাহোক পরিশেষে এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায় যে, প্রাগঐতিহাসিক মৃৎশিল্প যেন পালদের প্রত্যক্ষ প্রণোদনায় ও পরিশ্রমে উন্নততর মৃৎপণ্য সামগ্রী বিশ্ব বাজারে প্রবেশপূর্বক অতীত ঐতিহ্য সমুজ্জল রাখুক।    

মন্তব্য: