গাশ্মী: বিলুপ্তপ্রায় আঞ্চলিক পার্বণ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সুদেব চক্রবর্তী

গাশ্মী একটি বিলুপ্তপ্রায় আঞ্চলিক উৎসব। বাঙালির অনেক পার্বণ রয়েছে, কোনোটা ধর্মীয়, কোনোটা লোকজ। যেমন- ঈদ, পূজা, নবান্ন। তবে কিছু পার্বণ বা উৎসব আছে যেগুলো ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে আপামর বাঙালির। যেমন- নববর্ষ। গাশ্মী কিন্তু এরকমই একটি পার্বণ। 

তবে গাশ্মী দক্ষিণবঙ্গের মাগুরা জেলার অন্যতম লোক উৎসব-এটা বলা সঙ্গত। কারণ মাগুরাতেই এই পার্বণটি বেশি দেখা যায়। তার মানে এটাও নয় গাশ্মী কেবল মাগুরাতেই হয়। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও এই পার্বণের দেখা মেলে।

গাশ্মীকে বিলুপ্তপ্রায়ই  বলতে হচ্ছে। কারণ খোদ মাগুরাতেই এখন গাশ্মী পালনের মাত্রা কমে আসছে। এখনকার প্রজন্ম তো গাশ্মী কী সেটা জানেই না। গত বিশ বছর আগেও যেভাবে মাগুরাতে এটা পালিত হতো, এখন সেভাবে আর পালিত হয় না। বিশেষকরে বর্তমানে প্রযুক্তির আগ্রাসন ও নানাবিধ কারণে বাংলার বহু ঐতিহ্য অস্তিত্ব সংকটে, অনেকগুলো হারিয়েও গেছে। কর্পোরেটরা অবশ্য কোনো কোনোটার জন্য স্পন্সর করে আয়োজন করে। কিন্তু কিছু পার্বণ রয়েছে যেগুলোর সাথে বাঙালির বিশ্বাস, নিজস্বতা ও রীতি-নীতি রয়েছে; সেগুলোর দখল তো আর কর্পোরেটরা নিতে পারে না। গাশ্মী তেমনই একটি পার্বণ। 

গাশ্মী পালন যেভাবে

আশ্বিন মাস যাওয়ার দিন গাশ্মী পালন করা হয়। এ দিন সবাই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। প্রথমেই তিনবার শাঁখ বাঁজিয়ে সবার ঘুম ভাঙানো হয়। যেহেতু এটা হিন্দু-মুসলিম উভয়েই পালন করে, তাই মুসলিমরা মূলত ফজরের আজান শুনেই উঠে পড়ে। তারপর উঠোনে আগুন জ্বালানো হয়, সেই আগুনে সবাই হাত, পা ও মুখ ছেঁকে নেয়। সবাই তখন হাতে পায়ে সরিষার তেল মালিশ করে নেয়। এখানে একটা বিশ্বাস আছে। সেটা হলো আসন্ন শীতে যেন সবাই সুরক্ষিত থাকে। এজন্য আগুনে একটা তেঁতুল পোড়ানো হয়। সেই পোড়া তেঁতুলের নির্যাস সবাই হাতে, পায়ে, ঠোঁটে মাখায়।

মশা তাড়ানো

এরপর মশা তাড়াবার আয়োজন। বাংলার প্রকৃতিতে মশার উৎপাত চিরায়ত। এই পর্বটিও ওই মশা থেকে সুরক্ষা পাবার বিশ্বাস থেকে করা হয়। একটা কুলা লাঠি দিয়ে তালে তালে পেটানো হয় আর ‘আমাদের বাড়ির মশা-মাছি বহুদূরে যা…’ আবৃত্তি করা হয়। এটা বলতে বলতে দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে দূরে অথবা নদীর পাড়ে কোনো গাছের সাথে কুলাটা রেখে আসা হয়। মশাদেরকে গ-ি কেঁটে দেয়া আর কি। কোথাও দেখা যায় নদীর এক পাড়ের লোকেরা অন্য পাড়ে মশা তাড়ায়, পাল্টা প্রতিযোগিতায় অন্য পাড়ের লোকেরা মশাদের তাদের দিকে পাঠাতে চায়। এটা বৈরিতা নয়। বরং এর ভেতর লুকিয়ে থাকে এক ধরনের সম্প্রীতি। এ সময় কুলার পাশাপাশি অনেকে কাসা বা পিতলের দ্রব্যও বাজাতে থাকে। পুরো গ্রামটা যেন ঝংকার ছন্দে মেতে ওঠে।

বাড়ি ফিরে যা করা হয়

এরপর সবাই বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর সবাই আঁখ খায়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসটা হলো গাশ্মীর প্রভাতে আঁখ খেলে দাঁত ও শরীর ভালো থাকে। এরপর শিক্ষার্থীরা বই নিয়ে পড়তে বসে। গাশ্মীতে জ্ঞানচর্চা ফলদায়ক ও এতে মেধাশক্তি বৃদ্ধি পায় এই বিশ্বাস থেকেই এটা করা হয়। এ সময় বয়স্করা ধর্মীয় গ্রন্থ যেমন- গীতা, রামায়ণ, কোরাণ প্রভৃতি পাঠ করেন। 

গাছের ছাল কাটা

সকালেই একদল কিশোর গাছে গাছে দা দিয়ে কোপ দিতে থাকে। মূলত যেসব গাছে ফল আসতে দেরি হচ্ছে সেসব গাছে কোপ দিয়ে ছাল তোলা হয়। গাশ্মীতে এসব গাছে দা দিয়ে কোপালে পরের বছর আসতে আসতেই ফল আসে-এই বিশ্বাস বাঙালির অন্যতম।

গাশ্মীতে খেলাধুলা

দিনের আলো ফোঁটার সাথে সাথেই শুরু হয় গ্রাম্য খেলাধুলা। গাশ্মীতে পড়াশোনা করলে যেমন মেধা বৃদ্ধি পায়, তেমনি খেলাধুলা করলে দেহ মন সুস্থ থাকে, এমনটাই মনে করা হয়। এসব খেলায় প্রাধান্য পায় কিত্ কিত্ খেলা, হাডুডু, দারিয়াবাঁধা, চি-বুড়ি, কপালটেকা, স্যান্ডেল চুরি, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলা। তবে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতায় সারা দেশে ক্রিকটের ঢেউ লাগে। তখন থেকে গাশ্মীতে ক্রিকেটও প্রবেশ করে। এসব খেলায় শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি মধ্যবয়সীরাও অংশ নেয়। এ এক অনন্য সম্প্রীতি।

গাশ্মীর স্নান, প্রার্থনা ও খাবার

খেলাধুলা শেষে সবাই নিমপাতা, হলুদ শরীরে মাখিয়ে ¯œান করে। যাতে খোস-পাঁচড়া বা চর্ম রোগ প্রতিরোধ হয়। ¯œান শেষে সবাই বিশ্বশান্তি কামনায় সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে। এরপর আসে খাবারের পালা। মূলত হিন্দু মতালম্বীরা সৃষ্টিকর্তা বা দেবতার নিকট যেসব খাবার উৎসর্গ করে সেগুলোই খায়। এছাড়া তারা এ দিন নিরামিষ খাবার গ্রহণ করে। তবে গাশ্মীর প্রধান খাবার তালের ভেতরকার সাদা অংশ। তাল ভাদ্র মাসের ফল। তখন থেকেই গ্রামের মানুষ বাড়িতে তালের বীজ জমিয়ে রাখে, এই গাশ্মীতে লাগবে বলে। আবার তরকারি হিসেবে ওল প্রাধান্য পায়। এছাড়াও চৌদ্দ প্রকারের শাক রান্না করা হয়।

বাংলার অন্য অঞ্চলে গাশ্মী

যতদূর জানা যায়- মাগুরা ছাড়াও খুলনা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহে গাশ্মীর কিছু অংশ দেখা যায়। ময়মনসিংহে অবশ্য যে সকল গৃহবধূর শ্বাশুড়ি মারা যায় তারা গাশ্মীব্রত পালন করত। নারায়ণগঞ্জেও গাশ্মী পালনের খবর মেলে। ওখানে আশ্বিণ মাস যাবার রাতে রান্না করা হতো, সেই খাবার খাওয়া হতো পহেলা কার্ত্তিকে। ওই অঞ্চলে এরকম একটি ছড়া প্রচলিত আছে- ‘আশ্বিনে রান্ধে কার্ত্তিকে খায়, যেই ফল মাগে সেই ফল পায়’। রাজশাহীতে গাশ্মীর দিনে মনসা পূজা হয়। সেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই মনসার কাছে মানত করত। দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও আবার চৈত্র সংক্রান্তিতেও এটা পালন করা হয়।

বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে গাশ্মীর বিক্ষিপ্ত খবর পাওয়া গেলেও এটা সাড়ম্বরে মাগুরাতেই পালন করতে দেখা যায়। এখনও প্রতি বছর আশ্বিন মাসের সংক্রান্তিতে এই পার্বণ চলে। যদিও আগের মতন সাড়ম্বর নেই। কোনো গ্রামে তো এটা বিলুপ্তই হয়েছে। আবার বর্তমান মুসলিম সমাজ থেকেও গাশ্মী উঠে গেছে। কেবল হিন্দুরাই ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরও আগামী বিশ বছরে এই পার্বণটিকে ধরে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

মানুষ ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে উঠছে, বিশ্বায়নের হাওয়ায় ভাসছে, কর্পোরেট দুনিয়ায় ডুবে যাচ্ছে। যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোয়, তবু সবাই একা হয়ে যাচ্ছে। সেই সম্প্রীতিও হারাচ্ছে। ফলে অন্যান্য লোকজ বিষয়গুলোর পাশাপাশি গাশ্মীও বিলুপ্তির পথে।

মন্তব্য: