ফিরোজ আহমদ
লিখবার জন্যে যত মানুষের কাছে কবিতা নিজেকে মেলে দিয়েছে বোধ করি তার থেকে বেশী মানুষের কাছ থেকে পড়বার জন্যে হয়তো কবিতা নিজেকে গুটি নিচ্ছে। কবিতা কি ক্রমশ কবিদের নিজস্ব চর্চার বিষয় হয়ে উঠছে? নিজেদের ভেতরকার যুগযন্ত্রণা, পরিবর্তিত হতে থাকা মূল্যবোধ ইত্যাদির চাপে কবিতা কি ব্যাক্তিক অভিব্যাক্তির নামান্তর হয়ে পড়ছে? সীমান্ত চিহ্নহীন বিশ্বের কল্পনা, ব্যাক্তিগত অভিরুচির চরমতম স্বাধীনতার দাবি তুলে কবিতা কি একেবারেই ব্যাক্তিগত হয়ে উঠবার পথের দিকে দৌড়ে এগুচ্ছে? এইই কি কবিতার ভবিষ্যৎ! হয়তো সেটাই, হয়তো সেটাও নয়Ñ হয়তো আরো কিছু!
এতদূর ভনিতা করে এসে এবার আসল কথার দিকে আসা যাক। কবিতা নিয়ে এই যে আলোচনাটা আনপারা যারা পড়ছেন আমি প্রায় নিশ্চিত, তাঁরা কবিতার বিষয়টা অনেকেই আমার থেকে ভালো বোঝেন। অনুরোধের ঢেঁকি যে আগে আমি কখনো গিলিনি এমন নয়- তবে এবার যে একটা আস্ত রাইচমিল আমাকে গিলতে হবেÑ সেইটে ভেবে আমার নিদারুণ দুঃখ বোধ হচ্ছে- এই পত্রিকাতে যাঁরা গ্রন্থিত হয়েছেন কবি হিসেবে তাঁদের নাম আমার নামের থেকে অনেক উজ্জল- তবু কাপড়গুলো কাউকে না কাউকে তো ধুতেই হতো-
এখন কবিতা-সীমানা এবং সঙ্গাকে অস্বীকার করেছে। সেজন্যেই কবিতার আলোচনা দূরুহ হয়ে পড়ছে দিন দিন। এটা স্বীকার করেই নিতে হচ্ছে যে- উপজীব্য হয়ে উঠবার মতো বিষয়গুলোর চালান সবসময়েই পরবর্তী দশক কিংবা শতকের কবিদের জন্যে সুপ্রচুর হয়ে উঠছে। প্রযুক্তিমন্ত্র মুখস্থ করতে পারা জাতিগুলো অন্য জাতিগুলোকে খোপের মুর্গি বানিয়ে ফেলতে পেরে- একযোগে মুর্গি হবার এবার মুর্গি বানাবার বেদনা ও তুষ্টি অমনোযোগেই সরবরাহ করে চলেছে কবিদের জন্যে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্য এবংং পরবর্তী সময়ের বিশ্বপরিস্থিতি, হাঙ্গেরী, পোল্যাণ্ড কিংবা চেক কবিদের অভিজ্ঞতায় একদম অচেনা নতুন এক কাব্যবোধের চালান এনে দিয়েছিলো। তথাকথিত স্বাধীন থাককেত দিয়েও যে প্রকারান্তরে অন্যদেরকে পরাধীন করে রাখা যায় আজকের কূটনীতি- সেই উৎকর্ষকেও অতিক্রম করেছে। ল্যাটিন, এশিয়া, আফ্রিকায়Ñ এখন প্রতারিত হবার কাব্য বোধ কবিতায় নতুন নতুন অভিব্যাক্তির জন্ম দিয়েছে। নোবেলের সাান্তনা জনজীবনের ত‚রীয় ব্যর্থতাকে, তার তীব্রতাকে আরো কবিতা লিখবার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে- কিন্তু সমস্যাটার সমাধানের ব্যবস্থা নিচ্ছে না বা আঙ্গুলও তুলছে নাÑ এসব এখন সবার জানা।
এই সংকলনটিতে কবিরা… আর কিছু নয়, সেই বেদনাবোধকেই আকারে প্রকারে চিহ্নিত করেছেন। আন্দে উদ্বেল কোনো কবির পংক্তি তাই প্রায় অনুপস্থি এই সংকলনটিতে। রনি অধিকারী ‘একটা উজ্জ্বল ঘোড়া’ শিরোনামটিতে একটা উজ্জ্বল নাচদৃশ্যের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেও শেষমেস লিখতে বাধ্য হন-
‘মধ্যরাতে অশ্বক্ষুর নিরন্তর
জলন্ত চিতায় দেখি মৃত্যুর নোঙর’। আঁদ্রে এটাই লিখেছিলেন-
‘আমাকে ছেঁড়া খোঁড়া বন্ধ করো- শয়তান
কারণ আমি হাঙ্গেরিয়ান
-আমার জীবন মর্মন্তুদ
এবং অদ্ভুত।’
আলোচ্য দু’জনকে পড়ে মনে হচ্ছে- জীবন আমাদের বেদনাবোধেই বৈচিত্র এনে দিচ্ছে কেবল- সুখানুভ‚তি নয়! দেখা যাচ্ছে রিঙকু অনিমিখের মতো একটা দারুণ যুবক স্বর প্রেমাষ্পদের শুধু নামেই সন্তুষ্ট হয়ে লিখেছেন-
‘কেউ যদি ভুল করে বলে তার নাম
মুখে তাচ্ছিল্য, অন্তরে হাজার প্রণাম’।’
তার দ্বিতীয় কবিতায় এসেই বোঝা যাচ্ছে তিনিও ভুল করেই এতক্ষণ প্রেমাবিষ্ট বোধ করেছেন- তার অন্তর্গত বক্তব্যটা যেন এটাই- ‘যে একটা মাতাল ভ‚মিকম্পের অপেক্ষা করছি এখন’-। চকলেটের ভেতরটায় আমরা ঝাল, টক, নোনতা যে আস্বাদ অথবা ফ্লেবারই ব্যাবহার করি না কেন, বাজারে আনছি বেদনাবোধের মোড়ক পরিয়ে। আমরা যারা কবিতা লিখি এইই আমাদের ভবিতব্য…
বরাবরের মতো শেষ লাইনে অসামান্য চমক রেখে দারুণ একটা সমাপ্তি এনে দিয়েছেন রবু শেঠ। যদিও লাইন ভাঙার ব্যাপারে ক্ষীণ একটু অমনোযোগ কখনো লক্ষ্য করা যায়- যেমন-
‘দলিলে লেখা প্যাঁচানেরা প্যাঁচানো
অক্ষরের মতো উচ্চারিত কিছু ঠোঁট’- লাইন দুটো এভাবে না হয়ে
‘দলিলে লেখা-
প্যাচানো প্যাচানো অক্ষরের মতো
উচ্চারিত কিছু ঠোঁট’- এভাবে হলেই যেন পড়তে সুবিধা হতো।’
শফিক সেলিমকে যে ‘তুমি’ কে অবলম্বন করেছেন, বোঝা যায় কবিতাটা লিখবার সময় তাকে কবি দেখতে পেয়েছিলেন। ‘বেলতলা’ শব্দটায় অনেকের আপত্তি থাকতে পারে- তোমার বাড়ি/কলতলা/ফুলবাগানের বেড়া পর্যন্ত… এই রকমই আশা ছিলো যেন আমাদের।
শামীম হোসেন নিজের জন্যে লিখেছেন। মগ্ন হবার চেষ্টার চিহ্ন রয়েছে তবে তা জেঁকে বসেনি- তিনি কীভাবে নেবেন জানি না, তবে তিনি নিজেই প্রচুর শব্দ বাদ দিতে পারতেন- তাহলে ইঙ্গিতময়তা বেড়ে যেতো হয়তো। আবু বকর সিদ্দিক স্যার একবার বলেছিলেন- যে কোন কবিতারই আরো সুন্দর হয়ে উঠবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। হতে পারে আমরা যতো সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করবোÑ কবিতা ততো সুন্দর হয়ে উঠবে। আপনি, আমি সবাই…
ইদানিং আমার কখনো মনে হয় যে- বাংলা কবিতায় কী যেন একটা হচ্ছে। ঠিক এই মূহুর্তে কবিতায় কোনো একক নাম নেই। বহু মানুষ একসাথে ভালো কবিতা লিখছেন- এই সংকলনটিতেও আমরা একসাথে মিলেই যেন ভালো কবিতা লিখেছি- আবার এটাও বোধ করেছি যে আমাদের কবিতাগুলোও আরো ভালো হয়ে উঠতে পারতো। কখনো মনে হয় কবিতা আর মাতৃত্ব যেন সম অর্থ বহনকারী চৈতন্যের মানুষি স্তরÑ কোনো নির্দিষ্ট একটা সন্তানের জন্ম দিয়ে জন্মদাত্রী মা’টা মাতৃত্বের মহামহিম অনুভূতির অংশিদার হয়ে উঠে একীভ‚ত হয়ে যান- কবিত্বও যেন সেইরকম একটা জোৎস্নায় ঝিকমিক করতে থাকা মহাসমুদ্র কবিরা তাদের একার কবিতা নিয়ে এসে- একীভূত হয়ে যান সেখানে। সেজন্যেই বোধ করি কবিতার শব্দগুলো সম্ভাব্য বৃহত্তর সংখ্যক মানুষ পাঠকের উপযোগী করে তোলা- কবির দায়ীত্বৈর ভেতরে পড়ে যায়। এবং সেখানেই হয়তো জনবিচ্ছিন্নতার দোষারোপ থেকে কবিতাকে মুক্ত করে তোলার সম্ভাবনার বীজ বুনে রাখা আছে। শিকদার ওয়ালিউজ্জামান- ‘মরিচভাতে সুভাস ঢালে; রোদ্দুর হাঁটে পায়ে পায়ে’ এরকম অদ্ভুত একটা কল্পদৃশ্য সৃষ্টি করার পরপরই ভুলে গেলেন- কাঁচি বলতে এখনো বেশিরভাগ পাঠক চুলকাটা কাঁচিকেই বোঝেন- যাতে দাঁত থাকে না। তিনি অবশ্যই কাস্তে লিখতে পারতেন। যা দিয়ে আমরা ধান কাটি খাঁজকাটা, দাঁতওয়ালা কাস্তে।
ধর্মচেতনা প্রেমাবলম্বন ছেড়ে এসে কবিতা এখন প্রায় অনিশ্চিত এক সম্ভাবনার নাম। অনেক কবিতাই এখন ছোটগল্পের মতোন। আনিফ রুবেদ ছোটগল্পের অমোঘ দার্শনিকতা ভর করিয়েছেন তার কবিতায়- কথোপকথনের ভঙ্গিতে। মোহাম্মদ রফিক স্যার লিখেছেন- ‘কবির জগৎ সর্বভূক। আগুন থেকে মানুষ, শূন্য থেকে মাটি সমস্ত কিছুই সে আহার করে এবং পরিপাকও করে।’ আহমেদ শিপলুকে তাই আমরা অটল বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।
কমল হাসানের ‘আধো বোলে ব্যাক্ত অভিমান’ পাঠককে একটু হলেও মরমী অনুভূতি এনে দেবে- তার কবিতা আরো নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হোক। কাব্য মোস্তফার লেখা নিঃসন্দেহে তৃপ্তিকর। যদিও রোদ্দুরের পিতা হিসেবে সারা পৃথিবীতে সূর্য স্বীকৃত তবুও তিনি রোদকে বেওয়ারিশ বলেছেন, আবার বলেছেন- দূর অরণ্য থেকে বর্ষার গান ভেসে আসে… বাতাসের ডানায়… এখানে এসেও যারা ভেসে যাবেন না- তারা নাইবা পড়লেন কবিতা!
গালিব- ছোট লেখায় বিশ্বাসী, বেদনার্ত এই কবি দেখতে পেয়েছেন প্রতিবেশী কাক লুটে নিল ইতিহাস….। চানক্য বাড়ৈ এ সময়ে অনেকেরই প্রিয় কবি- যিনি তার নাম বন ঘুঘুদের পালকে লিখে দিকে দিকে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে দিয়েছেন তবে বাইসনের মতো একটা বড় প্রাণীকে তিনি তীরবিদ্ধ না করে বর্শা বা বল্লমবিদ্ধ করতেই পারতেন- তাহলে সেটা সম্ভাব্যতার আরো নিকটবর্তী হতে পারতো- তবে কবি স্বাধীন।
মাহমান্য জাতিসংঘকে তার উপযুক্ত পাওনা শোধ করে দিতে পেরেছেন জয়নাল আবেদীন শিবু। তবু তাকে মনে করে দেবো- জন্মগতভাবে আলকাতরা বিবর্ণ নয়- তবে যে কোনো কিছুই বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে সময়ের বিবর্তনে। জাহিদ সোহাগ দারুণ লিখেছেন। বিনে খরচায় আমাদের ঘুরিয়ে এনেছেন অনেক। আমরা জানি হাইনে আর চন্ডিদাস একই কবিতা লিখেছিলেন- প্রিয় কবি পরিতোষ হালদারের একটা লাইন আছে ঠিক ঠিক জাহিদ সোহাগের মতো-
জাহিদ লিখেছেন- ‘নীরবে, রাত্রির কাছে এসো, এসো নতজানু হই’
পরিতোষ লিখেছেন- ‘এসো নদীর কাছে নতজানু হই।
এসো, শিশুদের সাথে আরো একবার বড় হয়ে উঠি।’
এই উল্লেখটুকু দয়া করে কেউ অন্য অর্থ করবেন না। আমি নিজেই কোথায় যেন লিখেছিলাম- আমরা কবিরা পরস্পরকে আহার করে বেঁচে থাকি। আমিও, অন্যরাও।
তুষার প্রসূন অনেকের প্রিয় নাম-। লিখেছেন- ‘একদিন শূন্য থেকে পড়ে গিয়ে অনুভূতি ভেঙে যায়’ এটা যেমন একটা অসম্ভব প্রকাশ তেমনই একই কবিতায়- কবিতার নয়, এমন একটা বাক্য কেন যে তিনি লিখলেন! তিনি লিখেছেন- ‘অর্থাৎ মনের প্রতিটি মেরুতে চলে নির্মাণ এবং বিনির্মাণ।’ বাক্যটা খুবই সাদামাটা। তাঁর নামের সঙ্গে যায় না। তুহিন তৌহিদকে ভালো লাগবে আশা করছি। অবশ্য ‘হাত’ কবিতায় আমি হলে ‘লোমশ’ না লিখে রোমশ লিখতাম। অবশ্য কবির ইচ্ছাই সর্বোচ্চ মূল্যবান।
তুহিন দাস দারুণ। তার ‘আমি’ শব্দটার ওপর নির্ভরতা কমে আসুক- তার দৃশ্যকল্প অপূর্ব লেখেছে। পাথরের মূর্তির নিতম্ব ছুঁয়ে দেখা- এ এক অন্যরকম অনুভূতি। লাজুক লাজুক, দুষ্টু দুষ্টু। নাসির জুয়েল তার বেদনাবোধকে দারুণভাবে চিহ্নিত করেছেন। এই লাইনগুলোতে-
‘-তোমার জন্যে অপেক্ষায় থাকা-লাল আপেল
কেটে দেখি, তার সমস্ত মাংস জুড়ে
-কী সতেজ রক্তক্ষরণ।’
যদিও ডোর-বেল এর সামগ্রিক অভিব্যক্তি পাঠকের কাছে প্যাঁচালো লাগতে পারে- যেমন-
‘ডোর বেল বাজলেই বুঝতে পারি
আজ কেউ আসেনি’- তাহলে বেলটা বাজালো কে? আবার তিনি বলেছেন-
‘না তুমি
না আমার অচেনা অতথিগন’- তার মানে তুমি বাদে আর আমার যারা চেনা- তারা কেউ- একটু ঘোরালো লেগেছে ব্যাপারটা।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের প্রায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন বাক্যগুলোতে শিল্পমান আরোপ করবার চেষ্টা- এখানে দারুণভাবে লক্ষণীয়। মুজাহিদ আহমদ এর কিছু ঠুস্-ঠাস্ শব্দ ও কিছু হায় হায় রি-রি- স্বর সরপুটির লোটা…সুপারি পাতার মতোন দোলাতে দোলাতে উত্তরসূরীদের দিকে চলে গেছে… আমরা জানি সেটাই কবিতার ধর্ম।
আমরা আমাদের কবিতা নিয়ে এতক্ষণ যে বলাকওয়া করলাম সেসব আমাদের কবিতা নিয়ে আমরাই বলেছি। আমরা সবাই মিলে কবি। জলসিঁড়িতে প্রথম দশকের যে কবিগন সংকলিত হন নি তাঁরাওÑ তাঁরাও আমরা।