সব্যসাচী হাজরা ও প্রদীপ চক্রবর্তী

খুঁড়ে আনে। ঘুরিয়ে আনে যে লেখা তার সাথে পরানো চোখ। হাঁটতে হাঁটিতে দেখে নিচ্ছি তার রূপ। অপরূপ বালে তাকে ডাকলে কেন? ডাক পিটিয়ে যারা মেঠো, ঢাক পিটিয়ে যারা ময়দান তাদের সবটুকু নিয়েই এই লেখামক (লেখা+ভ্রামক)।

মার্কেসের এক সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম খারাপ কবিতা লিখতে লিখতেই ভালো কবিতা সন্ধান পায় কেউ। যদিও আজকের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ‘ভালো’ আর খারাপ দুটো শব্দ বড়ই সংশয়ের মুখে ঠেলে দ্যায়। ‘ভালো কারুর কাছে যেমন আমাদের পরিচিত ভালোটুকুর স্বাদ দ্যায় তেমনই তা কারুর কাছে ‘ভালো’ শব্দের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গাত্মক প্রকাশে ‘খারাপ’-কেই বড় করে তোলে। কেউ কেউ খারাপ’ কবিতাই লিখতে চায়। এই খারাপ কি অপ্রচল, গতানুগতিকতার বাইরে এক ভাঙচুরের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকেন্দ্রিক ? না কি তা শুধু মাত্রই বিরুদ্ধে যাওয়ার গিমিক? এসব প্রশ্ন থাকেই।

যাই হোক সাম্প্রতিক বাংলাদেশের তরুণ কিছু কবির কবিতা পড়ার সুযোগ হোলো। এবং তন্নিষ্ঠ পাঠের শেষে মনে হোলো স্থানিক ও ভৌগোলিক জলবায়ুর কিছু মাটি, জল, আকাশ ও স্বপ্নপ্রসূত বিপ্লবের অতীত অতিক্রম ক’রে আবহমান কবিতাচর্চার ইতিহাসে এই কবিরা তাদের মতো ক’রে স্বতন্ত্র স্বাদের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে।

১৫ জনের কবিতা। নির্বাচনের গুণে তাদের প্রকাশ আলাদা আলাদা। সে দিক থেকে সম্পাদককে সাধুবাদ। পড়তে পড়তে একদিকে যেমন আঞ্চলিক গন্ধ, রস, রূপের বাগানো সাজান, অন্যদিকে বিজ্ঞান, গণিত, আবার আরেকদিকে কবিতার ব্যতিক্রমী ভাষা উপস্থাপনার উজ্জ্বল প্রকাশ। অরবিন্দ চক্রবর্তী, তনজিম আতিক, নিষাদ নয়ন, নুসরাত নুসিন, বঙ্গ রাখাল, বাদল ধারা, বিধান সাহা, যাকির যাপন, শাহাদত হোসাইন, সারোক শিকদার, সুদেব চক্রবর্তী, সুবর্ণা গোস্বামী, সোহেল সবুজ, রিফাত বিন নুরুল, হাসান সাব্বির, আহা আলোকিত, উজ্জ্বল, নামঝাঁক।

জীবন, তার গতি। তার বৈচিত্র, রূপ, রস, ভাঙাগড়া, ছন্দ, এবং পতন এভাবেই তার। কেঠা, হেটো, এবং মিঠে অভ্যাসগুলো। আমরা যেমন দেখি লয়, প্রলয়, যুত ও অযুতগুলো। উল্লিখিত এই ১৫ জন নতুনের কবিতা নিয়ে এগিয়ে যাবার আগে আমরা যদি পিছিয়ে যাই? পাঠক এসব তথ্য জানলেও নিজগুণে ক্ষমা করবেন। ক্ষমা চেয়ে নিয়েই তাই দু-চার কথা বলতেই হচ্ছে।

১। বিশ শতক জুড়ে বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে আসতে হয়েছে পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীকে। এ অল্প সময়ে তাদের মানচিত্রে বদল ঘটেছে বার-দুয়েক। প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তাদের জাতিগঠনের কেন্দ্রভূতি পালটে পালটে গ্যাছে দ্রুত। আর এরজন্য বহু রক্ত-মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে তাদের। ১৯৩০-এর দশকে যে আধুনিক বাংলা কবিতার উন্মেষ ঘটে, সেটি আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়েছিলো যতটা না সমাজ বা জনতার উপর তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিমনের ভেতরে। সেখান থেকে রাষ্ট্রীয় চেতনার রূপায়ন ঘটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

২। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য গণদাবী। উর্দু নয়, তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রধান ভাষা হােক বাংলা।

৩। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান।

৪। আধুনিক মৃত্তিকাস্পর্শী মানবিক কবিতার প্রথম প্রাণপুরুষ জসীম উদ্দীন-এর কৃষাণী দুই মেয়ে/পথের কোণে দাঁড়িয়ে হাসে আমার পানে চেয়ে।/ওরা যেন হাসি খুশীর দুইটি রাঙা বোন,/হাসি-খুশীর বেসাত ওরা করছে সারাখন। পাশাপাশি আমরা নাম করতে পারি আহসান হাবীব, আনোয়ার পাশা, শামসুর রহমান, আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন কবির, আলতাফ হোসেন, রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু, শামীম রেজা, শামীম কবির, বদরে মুনীর এভাবেই নব্বই দশক পর্যন্ত অসংখ্য নাম তবুও এই সামান্য কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক।

৫। ঢাকা ও কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলা কবিতার বিস্তার। বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তের প্রগতি পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার আধুনিক কবিতাভাবনার সূত্রপাত। চল্লিশের দশকে কলকাতায় আহসান হাবীব, ফররুখ আহমেদ, আবুল হোসেনের আধুনিক কাব্য ভাবনার উন্মেষ এবং সেভাবে আলোকিত না হওয়া।

৬। আধুনিক বাংলা কবিতার নন্দন চেতনা ও রুচি প্রতিষ্ঠার পুরো ইতিহাস নাট্যটিই রচিত হয় তৎকালীন রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে। ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গে-এর বিশেষ করে এর বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী কোনোভাবেই এর অংশভাগ ছিলো না। কেন ছিলো না তার পশ্চাৎপট জটিল, প্যাঁচালো ও বহুলাংশে বেদনাবিধুর। আধুনিক কবিতার লোকাল ট্রেনে অনেকটা দৌড়ে এসে উঠতে উঠতে তার আরও একটি দশক লেগে গ্যালো।

৭। ১৯৪০ এ কলকাতায় ঠাই নেওয়া মুসলমান কবিরা দেশভাগের পটভূমিকে সামনে রেখে নতুন এই কবিতাকে বয়ে নিয়ে আসেন ঢাকায় (আধুনিক কবিতার বীজ রোপিত হয়।

৮। ধীরে সময়ময়তার সাথে পরবর্তী বাংলাদেশে ধীরে ধীরে আসে বিষয় ভাবনার বৈচিত্র, পলিমাটির ঘ্রাণ, দেশভাগের যন্ত্রণা, নিসর্গ, সম্পর্ক, মিলনের আকুলতা, পরাবাস্তবতা, স্বপ্ন, ধর্ম, মেটাফিজিক্স, রক্ত-মাংস, আবেগ, শরীর, সমাজের বিভিন্ন দিক এবং সবশেষে বিজ্ঞান, অঙ্ক, প্রযুক্তি। অনেক কিছুর সাথে যে পথে এখন হাঁটছে পালটে যাওয়া বাংলাদেশের কবিতার এক অংশ যা শূন্য/প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের কবিতায়।

৯। বাংলাদেশে এই সময়ের কবিতায় একটা বড় অংশে আজও যেমন সেই মায়াবী নকশী কাঁথার মাঠের গ্রাণ কাটেনি তেমনই ছোটো হলেও একটা অংশে স্পর্শ করছে আজকের ভাষা, তার বিজ্ঞান, তার প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন। (আপন+যাপন)-এর এই মিশেলে তারা নির্মাণ করছে কবিতার আগামী। এই ১৫ জনের কবিতায় এই সবদিকই বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে। হয়তো এই সবটারই প্রয়োজন তাই।

লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছোয়নি। সুতরাং কবিতা ধারে ব্যাখ্যা অবান্তর। তাই আগের কথাগুলোর সূত্র ধরেই এই ১৫জনের উজ্জ্বল উচ্চারণ নিয়ে আরও সামান্য কিছু কথা

১। বাংলা দেশের মাটির ঘ্রাণ, তার নিসর্গ, সমাজ, জীবনযাত্রার রংবাহার অথবা সাদা-কালো ছোপ ছোপ, তীব্র অথবা মৃদু ইশারা

২। আবহমানের বহন অন রেখে নিরীক্ষামূলক কবিতাচর্চা

৩। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, অঙ্ক, সাম্প্রতিক সময়ের সোশ্যাল-মিডিয়ার শ্রেণীচরিত্র, বিশ্বায়ন

৪। গ্রামীন লোকজীবনের কথা, নগরকেন্দ্রিক মননের দ্বন্দ্, সংঘাত

৫। নিঃসঙ্গতা ও আত্মপ্রতারণা

৬। পরম্পরা, রক্ত ঘাম, ভাষা নিয়ে আত্মশ্লাঘা, নিসর্গ চেতনার মধ্য দিয়ে নিজের ভাষায় লিখে চলা কবিতা যার সাথে বাংলাদেশের মূল কাব্যিক স্রোতের, গভীরতার এক আত্মিক যোগাযোগ, যা আরোপিত নয়।

৭। সমসাময়িক এক ভৌগোলিক সীমানার অস্থিরতা, নিষ্ঠুরতা, ধর্মের নামে খুন, জখম, রক্তপাত। সামনের মুখোশ, আড়ালের মুখ।

৮। কোথাও কোথাও সংহত, মেদহীন উচ্চারণে ব্যক্তি অনুভবের টুকরো কথা

কয়েকটি পংক্তি এখানে দেওয়া হোলো

‘অলস দিনে কৈতর আসে এক ঘোরের মদ্দি-বুকে তোলে তুফান। কুড়োয়ে নেয় ওম-সন্দেবাতি জ্বেলে যে বালিকারা রাস্তা দিয়ে হাঁটে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে পাড়ার মিনশেরা বটের ছায়ায় আগুনের মানে খোঁজে” (কৈতর (বঙ্গ রাখাল))

‘নির্দিষ্ট আকার ও অবয়ব হারিয়ে প্রিয় পোশাকের মতো প্রিয় দহন উড়ে যাচ্ছে, অদৃশ্যতর-গহীন বিলীন অথচ আগুন মোম গলিয়ে আমি একটা নদীই নির্মাণ করতে চেয়েছি যার নাম হবেদরিয়ানগরের চোরাবালি আর আসঙ্গ পদ্মানগর’ (পদ্মানগর (নুসরাত নুসিন))

‘সমস্ত ব্ল্যাকহোলের নেশা জমে উঠছে চোখে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ থেকে প্রতিনিয়ত উড়ে যাচ্ছে হিগস’ (কার্বন ডাই অক্সাইড (বাদল ধারা))

‘তুমি সত্য, আমি সত্য। আমাদের মধ্যবর্তী নদীটি আপেক্ষিক (নক্ষত্রপতন (বিধান সাহা)

‘কুস্তিখেলার পাশে দাঁড়ানাে উত্তেজনা থেকে লেখা হয় একজন মাসেলম্যানের জীবন।'(কুস্তিজীবন (অরবিন্দ চক্রবর্তী))

‘হদয়ের জেরক্স করলে সেখানে ফড়িংয়ের কংকাল/ বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নিয়ে ধুপধাপ করছে হৎপিন্ড/যে কোন সময় প্রকাশ হবে আততায়ীর মুখ-সে বিনয় জানতো না।”(প্রচুর তোমাকে পানের পর (সারোক শিকদার))

কবিতাশিল্পের নরম সুতোয় গেঁথে দেবো তোমার রঙ্গিন চিঠি(অঙ্গীকার)সোহেল সবুজ))

এরকম কতো কতো উদাহরণ প্রত্যেকের লেখা থেকেই কোনো না কোনোভাবে উঠে আসে।

পড়ার আনন্দে পড়ে ফেলি আমরা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। টের পেতে চাই। তরঙ্গ, রঙ্গ তার অঙ্গটান। শব্দের আলো থেকে, গঠনের গুণ থেকে, পড়ার ধপ আওয়াজটাও জেগে থাকে কোথাও। সমাজ সেখান থেকে মাঝ বরাবর নিয়ে আসে তার সম্পর্কের জোয়ার-ভাটাগুলো। দেখে নেওয়া ভেতর লালন করে, প্রকাশ করে তার মতো করে। পাঠক তার আলোয় পাড়ে ফ্যালে। কেউ কেউ শান্ত ও সুন্দরে বিভোর হাতে চায়। কেউ দোল খেতে চায় কেউ বা তীব্র কম্পনের অনুভবে বলে ওঠে বাহ এইতো লেখা।

দ্বিতীয় দশকের এই ১৫ জনের কবিতায় আশা রাখি পাঠক তার রুচি অনুযায়ী বাহ্  বলে উঠবে এবং বুঝতে পারবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার দিকদিশা, অভিমুখীকরণ।

মন্তব্য: