যে চিন্তাটা প্রশ্নচিহ্নের মত দাঁড়িয়ে আছে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মেয়েটাকে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল শাহেদ। পূর্বার সাথে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাচ্ছে সে। তবে অমিলও কম নয়। শাহেদ যে পূর্বাকে চেনে সে এক অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে ব্যানার হাতে সামনে দাঁড়াত সে। কপালে বড় টিপ, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা যেমন পরে। অবশ্য পূর্বাও ভালো গাইত রবীন্দ্রসঙ্গীত। ক্যাম্পাসে বিশেষ বিশেষ দিনে যেসব অনুষ্ঠান হত সেখানে পূর্বার উপস্থিতি ছিল সপ্রতিভ। পহেলা বৈশাখ, বসন্ত বরণ, একুশে ফেব্র“য়ারি, বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবসে মানানসই শাড়ি পড়ে তার উপস্থিতি ছিল সহজাত ব্যাপার। সেদিক দিয়ে দেখলে শাহেদ এখন যাকে দেখছে তার সাথে পূর্বাকে একেবারেই মেলানো যায়না। মেয়েটি জিন্সের প্যান্ট পরা, চোখে স্টাইলিশ সানগ্লস। এমনটি পূর্বার ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায়না। তারপরও শাহেদ কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পায়।

এই মূহূর্তে শাহেদ বসে অছে একেবারে সমূদ্র ঘেঁষে। সমূদ্রের বিশাল ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে ওর পায়ের কাছে। এর আগে সে কুয়াকাটা আসেনি। কলেজের সহকর্মীদের ইচ্ছায় এবার এই ভ্রমণের আয়োজন্। প্রতিবারই ছাত্রদেরকে নিয়ে বনভোজনে যাওয়া হয় কলেজ থেকে। এবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো শিক্ষকদের পরিবার নিয়ে দুদিনের জন্য যাওয়া হবে কুয়াকাটা। শাহেদের নববিবাহিত স্ত্রী পলিকে বলতেই দারূণ উৎসাহ দেখাল সে। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি তাই শাহেদেরও উৎসাহ কম ছিলনা।

এখানে এসে দারুণ ব্যস্ত সময় কাঁটছে পলির। এই মুহূর্তে ভাবিদের সাথে গিয়েছে কেনাকাটা করতে। শাহেদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সমূদ্রের দিকে। সমূদ্রের সামনে এলে সত্যিই মন খারাপ হয় শাহেদের। বারবার মনে হয় আমরা কত তুচ্ছ এই বিশালতার কাছে!

শাহেদের চোখ আবারও চলে গেল মেয়েটার দিকে। স্বামী আর বাচ্চার সাথে একটা বল নিয়ে লাফালাফি করছে সমূদসৈকতে। শাহেদের থেকে অনেকটাই দূরে ওরা। শাহেদ এবার ভালোভাবে খেয়ার করল। নাহ! এ পূর্বা নয়। বোধহয় সমূদ্রের পাড়ে এসেছে তাই বারবার পূর্বাকেই মনে পড়ছে তার। খুব বেশিদিনের কথা নয়। ছয় বছর মাত্র। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষাভ্রমণে কক্সবাজারে গিয়েছিল ওরা। চার বছরে যে কথা বলতে পারেনি শাহেদ, সেদিন সমূদ্রের ধারে অবলিলায় বলেছিল পূর্বাকে। গোঁধূলীর শেষ আলোয় অনেক ভীড়ের মাঝে পূর্বা হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি, শুধু ওর হতখানা চেপে ধরেছিল শক্ত করে। মনে হয়েছিল এ বন্ধন খূবই শক্ত, কখনো আলাদা করতে পারবেনা কেউ। রাতে অপূর্ব জোছনায় সবাই বেরিয়েয়েছিল সমূদ্র দেখতে। সবার অলক্ষ্যেই একটু দূরত্বে চলে গিয়েছিল ওরা দুজন। বালির উপর বসে দুজনে মিশে গিয়েছিল জোছনার সাথে। শাহেদের জীবনে সেই প্রথম কোন নারীকে চুম্বনের অভিজ্ঞতা। পূর্বা তার মায়াময়ী কণ্ঠে গেয়ে উঠেছিল- আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব…..। তারপর থেকে শুধুই স্বপ্ন আর স্বপ্ন। ক্যাম্পাসে ফিরে এসে পূর্বার সাথে স্বর্ণালী দুটি বছর পার করা। কিভাবে  শেষ হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শাহেদ যেন বুঝতেই পারলনা।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পরপরই শাহেদ চাকরির খোঁজে চলে যায় ঢাকা আর পূর্বা তার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তখনো মোবাইলের প্রচলন শুরু হয়নি। বেশকিছুদিন চলে চিঠি চালাচালি। হঠাৎ করেই পূর্বা চিঠি লেখেÑ শাহেদ, আমার বাবা ছেলে দেখেছে। ছেলের বাবা চট্টগ্রামের একজন নামকরা ব্যবসায়ী। লণ্ডন থেকে এমবিএ করে ছেলেই এখন বাবার ব্যবসা দেখছে। তুমি এখন কি করবে বল?’ চিঠির উত্তরে তখন কিছুই লেখা হয়নি শাহেদের। কিইবা লেখা যেত? তখনো কোন চাকরির জোগার হয়নি। পূর্বাও কোন সিদ্ধান্ত নিতে চায় বলে মনে হয়নি তার চিঠি পড়ে। বরং ওর চিঠির ভাষায় মনে হয়েছে কিছুই করার নেই তার। শুধু দায় এড়িয়ে যাওয়া পত্র। দু’দিন পর শাহেদ শুধু একটা লাইন লিখেছিল তাকে- আমার অবস্থা তুমি জান। তারপরও যদি আমার কিছু করার থাকে আমি সবসময় প্রস্তত।’ উত্তর আসেনি তার। পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছে পূর্বার বিয়ের কথা।

কেউ কি পূর্বা নাম ধরে ডাকল কাউকে ? শাহেদ এটাকে মনের ভুল ভেবেই আবার ফিরে গেল আত্মচিন্তায়। সেই যে পূর্বার সাথে চার বছর আগে শেষ দেখা তারপর আর কোন যোগাযোগ নেই। বিসিএিস কোয়ালিফাই করার পর শাহেদ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে জয়েন করেছে। তারপর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে পলিকে। তবে দাম্পত্য জীবনে খারাপ নেই ওরা।

বলটা ধর পূর্বা…..এবার ভালো করে খেয়াল করল  সত্যিই মেয়েটাকে তার স্বামী ডাকছে। লোকটা মেয়েটার স্বামী কিনা নিশ্চিত না হলেও অনুমান করা যায়। বলটা প্রায় শাহেদের পায়ের কাছে চলে এসেছিল। মেয়েটা বলটা নিতে একবারে শাহেদের সামনে। দুজনেই কিছুক্ষণ চোখ রাখল দুজনের চোখে। এবার আর ভুল হয়নি শাহেদের। পূর্বা বলে চিৎকার করতে গিয়েও গলা দিয়ে স্বর বের হলোনা কেন যেন। ততক্ষণে মেয়েটাও দেঁঁৗঁড়ে ফিরে গেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পারলেও পূর্বাকে চিনতে ভুল হয়নি তার। অনেকক্ষণ ভাবল শাহেদ। তখনো বল নিয়ে খেলছে ওরা তিনজন। পূর্বা কি চিনতে পারেনি তাকে ? একবার কি যাবে সে কথা বলতে? নাকি ঠিক হবেনা ব্যাপারটা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এবার উঠে দাঁড়ালো সে। এক’পা দু‘পা করে এগিয়ে গেল পূর্বার সামনেÑ

এক্সকিউজ মি, আপনি নিশ্চয় পূর্বা ?

জ্বি আমি পূর্বা। কিন্তু আপনি?

এও কি সম্ভব? এরপর আর কোন কথা থাকতে পারেনা। কি বলবে ভাবতে না ভাবতেই পূর্বার স্বামী এসে দাঁড়ালো পাশে। এবার শাহেদ বলতে লাগল-

তুমি হয়ত মনে করতে পারছনা, আমি শাহেদ। আমরা একই সাথে পড়তাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উত্তরটা কি হতে পারে পূর্বা ভাবার আগেই ওর স্বামী হাত বাড়িয়ে দিল। 

আমি টুটুল। পূর্বার হাজবেইন্ড। সেকি পূর্বা ! ক্লাসমেটকেও চিনতে পারছনা ?

চেহারাটা একটু মনে পড়ছে – কাঁপকাঁপা স্বরে বলল পূর্বা।   

বেশ আন্তরিকভাবেই কথা বলছিল টুটুল। অথচ শাহেদের মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছিল লজ্জায়। কি করেন, কোথায় থাকেন টুটুলের এধরণের প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব সংক্ষেপে শেষ করতে চাইছিল সে। টুটুুল এবার ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে বেশ দাবির সাথেই বলে উঠল- সূর্য় অস্ত যাচ্ছে। চলুন ওদিকটায় গেলে ভালো দেখা যাবে’।

শাহেদ হাত বাড়িয়ে বলল- যান ঘুরে আসুন। আমাকে একটু থাকতে হবে এখানে।’ ততক্ষণে পলিরাও চলে এসেছে সৈকতে।

পূর্বা, টুটুল আর ওদের বাচ্চাটা হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে অস্তগামী সূর্যের দিকে। কখন যেন পলি এসে দাঁড়িয়েছে শাহেদের পাশে। শক্ত করে ধরেছে ওর হাত। শাহেদ তাকিয়ে আছে সমূদ্রের দিকে। হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে যাওয়া সমূদ্র এরকম কত ঘটনার সাক্ষী। মহাকালের পথ চলায় সমূদ্রের কাছে বড় তুচ্ছ এসব স্মৃতি। তার কাজ ক্লান্তিহীন ভাবে বয়ে চলা। শাহেদ মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে অনেক দূরে চলে গেছে পূর্বারা। একবারও কি পিছন ফিরে তাকিয়েছিল পূর্বা ?  

মন্তব্য: